রনজিৎ দাস: বাংলাকে ফুটবলে একসময় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বলা হতো। টাইগার অর্থাৎ এই বাঘকে কিন্তু সাধারণত তার শিকারের হিংস্রতায়– এরকম রয়্যাল টাইপের দাদাগিরির ভূমিকায় দেখা হয়। শিকারের পর শিকার ভক্ষণের স্টাইল দেখেছেন? রক্ত, হাড়,মাংস খাওয়াতে তার কত তৃপ্তি? রক্তমাখা মুখটা হাঁ করে যখন কপালে চোখ তুলে তাকায়–ঐ রূপ দেখে স্বপ্নে কেউ বাঘের ধড় কেন, আতঙ্কে ল্যাজ দেখতেও চাইবেনা। অথচ তার চেহারার সৌন্দর্যকে প্রশংসায় আনা হয়না। কেবল তার হিংস্র রূপকে তুলে ধরা হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের বাংলার গর্বের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। তার সৃষ্টিতে প্রকৃতি থেকে প্রেম, বিরহ, ভালোবাসার বর্ণনা– গান কিংবা কবিতায় এমনভাবে বাঙালিকে জড়িয়ে ফেলেছেন, বাঙালি সুখ, দুঃখ, কষ্টে তাঁকে স্মরণ করেন। ঠাকুরের সৃষ্টির সৌন্দর্যে বাঙালি আজও বুক ঠুকে বলে– আমরা কবিগুরুর বাংলার বাঙালি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাঘ শিকারের দারুণ একটা গল্প আছে। প্রতিদিনকার সান্ধ্য বৈঠকের মত সেদিন ঠাকুরের বাড়িতে এসে শিকারী কুমুদনাথ, ঠাকুরকে তার বাঘ শিকারের বীরত্ব জাহির করতে এসে রবিঠাকুরকেই জিজ্ঞেস করে বসলেন– ঠাকুর কটা বাঘ শিকার করেছেন? বেশ গম্ভীর হয়ে ঠাকুর সেদিন বলেই ফেললেন– অনেক বাঘ মেরেছি। শিকারী কুমুদনাথ তো নিজেকে জাহির করতে এসে অবাক হয়ে পড়ল। পাশ থেকে একজন ঠাকুরের কানের সামনে এসে মৃদুস্বরে, তাঁর অনেক বাঘ শিকারের রহস্য জানতে চাইলেন। রবি ঠাকুর বললেন– হ্যাঁ রে, অনেক অনেক বাঘ মেরেছি। ঐ যে B-U-G, ছারপোকা বিরক্ত করলেই হত্যা করি।
কোথায় হারিয়ে চলেছে– বাংলার সেই সোনালী দিনগুলো? অনুপম রায়ের একতারায় এখন কেবল বিরহের সুর শুনলে চলবে না।
সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল। ইষ্টবেঙ্গল টানা দুটো ম্যাচ জেতেনা। ঢাক পিটিয়ে এএফসির লক্ষ্যে টিম করে মোহনবাগান সুপার জায়েন্টস এখন দেশে নয়, বিদেশে বিপক্ষের বিরুদ্ধে ১৩ জনের টিম নামায়। ইষ্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য ওদের টিমে বাঙালি ফুটবলার কোথায়? ভারতীয় টিমেও বাঙালি ফুটবলার নেই বললেই চলে। ভিন রাজ্যের ফুটবলার ও বিদেশি নির্ভর হয়ে ইষ্টবেঙ্গল সুপার কাপ ও মোহনবাগান এসজি আইএসএল লিগ জিতেছে। মহামেডানে স্পোটিং ক্লাব আইলিগ জিতেছে। কিন্তু কোথাও বাঙালি ফুটবলারের প্রাধান্য নেই।
বাংলা দলও বাঙালি নির্ভরতায় সর্বভারতীয় স্তরের কোনও পর্যায়ে কোনও ট্রফি জিততে পারেনি। এই ব্যর্থতায় এখন ভারতীয় ফুটবল দলে টিম টিম করে ১/২জন বাঙালি ফুটবলার জ্বলে থাকছে।
এখানেই কলকাতা লিগের প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। মুখে আমরা বাঘ শিকার করে চলেছি। কলকাতা লিগ দেশের সেরা লিগ বলে গর্ব করি। এই লিগের ছোট দল থেকে বড় দলে প্লেয়ার নিতে টানাটানি চলতো। এখন গত ১০ বছরে ছোট টিম থেকে ইষ্ট বেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডানে বাঙালি ফুটবলার সাপ্লাই করেছে–ক’টা টিমের নাম করা যাবে? কলকাতার বড় দলে যেখানে প্লেয়ার সাপ্লাই নেই, সেখানে ভারতীয় দলে নিজেদের ক্লাবে বেড়ে ওঠা প্লেয়ারের কাহিনী থাকবে কোথা থেকে?
কিছুদিন আগে আসানসোলে জর্জ টেলিগ্রাফ ক্লাব সেমিফাইনালে বিএসএস ক্লাবের মুখোমুখি হয়েছিল। সোদপুর সুখচর ফুটবল ক্লাবের কোচ সমর দেব জর্জ টেলিগ্রাফ টিমের দায়িত্বে ছিলেন।
এবার কলকাতা লিগে সমরের প্রশিক্ষণের সুখচর ক্লাবের ১০জন ফুটবলার কলকাতা প্রিমিয়ার লিগে জর্জ টেলিগ্রাফের হয়ে খেলেছে। সমরের প্রশিক্ষণের ১৭ জন ফুটবলার প্রিমিয়ারের ক্লাবগুলোতে খেলেছে। তার মধ্যে ৭জন ফুটবলার মিলে প্রিমিয়ারে ২০টা গোল করেছে। এই সুখচর ক্লাবেই গড়ে ৭০/৮০ টা ৯/১০ বছরের ছেলেরা ফুটবলের প্রশিক্ষণ নেয়। ওরাই বড় হয়ে কলকাতার বিভিন্ন দলে খেলে থাকে। এবারের প্রিমিয়ার লিগের অবস্হানে প্লেয়ার সাপ্লাইয়ের নিরিখে সমরের প্রশিক্ষণের সুখচর ক্লাব, গড়ের মাঠের পরিচিত উত্তরপাড়ার নেতাজী ব্রিগেডকে কড়া চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।
এখন এই জেলার টিম সুখচর ক্লাবের পাশে কে দাঁড়াবে? প্লেয়ার তৈরিতে সমরের পিঠে কে হাত রাখবে? জেলার ফুটবল দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আবার নাকি শুরু হতে চলেছে। শুরু হলে ভালো হয়।
সমরের ছেলেদের প্রিমিয়ারে ২০ গোলের কথা বলা হল। আবার, এবারের প্রিমিয়ারের পাঠচক্রের সাহিল হরিজন খুব ভালো পরিচিতি পেয়েছে। প্রিমিয়ারের এবারের সম্ভবত সেকেন্ড হায়েষ্ট স্কোরার। আইলিগ-টুতে ইউনাইটেড স্পোর্টসের হয়ে ২য় সবোর্চ্চ গোলদাতা হয়েছে। ওর বেড়ে ওঠার কাহিনী বেশ রূপকথার মতন শোনাবে।
সাহিলকে ৬বছর বয়সে ফুটবলে হাতেখড়ি দেন অশোকনগর ফুটবল কোচিং ক্যাম্পের কোচ সৌরজিৎ দাস। অশোকনগরের ফুটবলে সৌরজিৎ অর্থাৎ পলদাকে গড়ের মাঠেও সবাই চেনেন। তাকে যখন ফোনে ধরা গেল, তখন তিনি রিলায়েন্স ইয়ুথ স্কুল টুর্নামেন্টে অশোকনগর স্কুলের টিমের কোচিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তার ফাঁকেই বললেন, “সাহিলের চেহারাটা ছোটখাটো বলে এবার ওকে অনেক প্রিমিয়ার ক্লাব হয়তো বা পছন্দ করত না। ও পাঠচক্রে সুযোগ পেয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছে। পাঠচক্রে খেলার আগে অভিজ্ঞতা বলতে এটিকে-র হয়ে অনূর্ধ–১৩ আইলিগ ও এ্যডামাস বরানগরের হয়ে যুব লিগ খেলেছে। সাহিলের যে বাইসাইকেল গোলটা প্রিমিয়ারে বিখ্যাত হয়েছে, সেই বলটা যে বক্সে ভাসিয়ে ছিল, সেই সুমনও আমার ক্যাম্পের ছেলে। পাঠচক্রে এবার আমার ক্যাম্পের ৬জন খেলোয়াড় ছিল।”
এবার ধরুন সাহিলের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে ইষ্টবেঙ্গল ক্লাব তাকে দলে নিতে চাইল। ইষ্টবেঙ্গল ক্লাবকে তো তার জন্য ট্রান্সফার ফ্রী দিতে হবে। টাকাটা স্বাভাবিকভাবেই পাঠচক্র ক্লাব পাবে। কারণ পাঠচক্র ক্লাব থেকেই সে পারফরম্যান্স করে নজড়ে পড়েছে।
ঠিকই! আর,অশোকনগর ফুটবল কোচিং ক্যাম্প তো আর কলকাতা লিগে খেলে না। ফলে সাহিলেরা পলদার কাছে খেলা শিখে ছড়িয়ে পড়ছে। আর পলদা সেই বাবুন কর, সুজয় দত্ত থেকে বছরের পর বছর কোচিং করিয়ে এখনও সাহিল, সুমনদের খেলোয়াড় বানাচ্ছেন। আরও আগামীর সাহিলদের খুঁজে পেতে রিলায়েন্স ইয়ুথ স্কুলের টুর্নামেন্ট নিয়ে ব্যস্ত আছেন।
পলদা বা সমর দেবদের মত এমন অসংখ্য কোচিং ক্যাম্পগুলোর প্রতি কারা নজর দেবে? সর্বভারতীয় স্তরে এখন সাজানো স্টারের এ্যকাডেমিরা খেলার সুযোগ পায়।সেখানে লোকাল ক্যাম্পগুলো অবহেলিত হয়ে পড়েছে। ন্যূনতম ৫টা বল দিয়েও কেউ তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না।
বল আসছে! অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন থেকে লক্ষ লক্ষ বল সারা ভারতবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হবে. কাজ শুরু হতে চলেছে। আপাতত ৬টা রাজ্যকে নিয়ে সূচী তৈরি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে বাংলার নামও নিশ্চয়ই থাকবে। আইএফএর মাধ্যমে তা বিলি বন্টন হবে। কিন্তু সেই বিলি বন্টনের তালিকায় অশোকনগর ফুটবল কোচিং ক্যাম্প বা সুখচর ফুটবল ক্লাবের নাম থাকবে কিনা নিশ্চয়তা নেই।
ওরা বল নিয়েই বা করবে টা কি? ওদের তো কৌলিন্যের পরিচয় দিতে হবে। এলিট, অ্যাডভান্স, বেসিকে বিভক্তের কৌলিন্যে আসতে ওদের লাইনে দাঁড়াতে হবে। কি অদ্ভুত! এভাবে ওদের যোগ্যতা দেখানোর পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে বাংলার ফুটবল নিয়ামক সংস্হার উদাসীনতা উপেক্ষা করা যায় না।
বাংলায় যেখানে বাঙালিরা বঞ্চিত হয়– তারা তো সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও বঞ্চিত হবে, এটা স্বাভাবিক ঘটনা। ফলে আইলিগের তৃতীয় বিভাগ থেকে অদ্ভুত সূচীতে ডায়মন্ড হারবার ক্লাব গোল পার্থক্যে বিদায় নেয়। ওদের বদলে ব্যাঙ্গালরুর স্পোটিং ক্লাব বেঙ্গালরু গেল। এবং ব্যাঙ্গালরুর টিম আইলিগের দ্ধিতীয় বিভাগের পাশাপাশি আইলিগেও প্রমোশন পেয়ে গেল। ডায়মন্ড হারবারকে কি অদ্ভুত সূচীর শিকার হতে হল!
অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন খেলাটাকে স্বচ্ছ রাখতে চাইছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ গ্রুপ বিন্যাসের ক্ষেত্রে গ্রুপে কেন জোড় সংখ্যার টিম রাখা হবেনা? কেন একসাথে গ্রুপের সব টিমের খেলা দেওয়া হবেনা? এর আগে আইএসএলের রির্জাভ টিমগুলোকে এভাবে আইলিগের গুরুত্বপূর্ণ খেলার সাথে যুক্ত করে কম্পিটিশনে লঘু করে দেওয়া হয়েছিল? বিলম্বিত বোধোদয়ে তা সংশোধন হল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইলিগ-টু নিয়েও নানা সন্দেহজনক প্রশ্ন উঠে গেছে।
খেলা ছড়িয়ে দেওয়ার নামে দেশের ১৭টা রাজ্যের মধ্যে ২৫টা দল বেছে আইলিগ-এর তৃতীয় বিভাগ চালু হল। কিন্তু তার মধ্যে অর্ধেক টিম মিলে ৫০টা ম্যাচের মধ্যে ১০টা ম্যাচ জেতার ক্ষমতা নেই। এমন টিমের আধিক্যের মাঝে বাংলার ক্লাবগুলো যাতে বঞ্চিত না হয়, তা আইএফএ-র দেখা উচিত। প্রয়োজনে বাংলাকে একটা ভেনু হিসেবে বিবেচনা করার জন্য আইএফএ নজর দিক।
অল ইন্ডিয়া ফেডারেশনের কার্যকলাপে যেন রাজনৈতিক ছায়া প্রকট না হয়। ফেডারেশনের সভাপতি একজন প্রাক্তন ভারতীয় দলের ফুটবলার। এবং বাঙালিও বটে।বাংলার ফুটবলের অলিগলি চেনা আছে। নিরপেক্ষতা বজায় রেখেও বাংলার হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। একাডেমিগুলো নিয়েও কত বির্তক হয়নি।
সর্বভারতীয় স্তরে বাংলার টিমগুলোর অংশগ্রহণের আগে আইএফএ-কে সদা সর্তক থাকা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সামনেই কলকাতা লিগের প্রিমিয়ার ডিভিশনের খেলা শুরু হবে। কিন্তু এর পাশাপাশি আইএফএ-র এখন থেকেই যুবলিগ থেকে সিনিয়র লিগে বাংলার অংশগ্রহণকারী দলগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করুক।