নিজস্ব প্রতিনিধি— ভারতীয় ফুটবলের আইকন সুনীল ছেত্রী আগামী সোমবার তাঁর ফুটবল জীবন প্রবাহের ইতি টানছেন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে৷ ওই দিন বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বের খেলায় ভারত মুখোমুখি হবে কুয়েতের বিরুদ্ধে৷ দীর্ঘ ১৯ বছরে ফুটবলের ইতিহাসকে গুটিয়ে নেবেন৷ কিছুদিন আগেই তিনি অনুভব করেছিলেন, ফুটবলের গতিতে নিজেকে আর বেঁধে রাখা যাবে না৷ অবসর নিতেই হবে৷ সেই অবসরের কথা ভেবে সবচেয়ে সঠিক সময় হল ভারতকে নেতৃত্ব দিয়ে ছুটি নেওয়া৷ আর সেই ম্যাচটা হবে কলকাতাতেই৷ আসলে সুনীল ভালোভাবেই জানেন ফুটবলের আবেগ ও আন্তরিকতা বলতেই বাংলা৷ তাই বাংলাতেই বিদায়ী ম্যাচটা খেলা সঠিক ভাবনা৷ এই কথা ভেবেই প্রিয় শহর কলকাতাকে বাছাই করেছেন৷ সুনীল যখন বিদায়ী ম্যাচ খেলবেন, স্বাভাবিকভাবে ফুটবলপ্রিয় দর্শকরা ওই ম্যাচটা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে রয়েছেন৷ সোমবার আইএফএ’র অফিসে টিকিটের জন্য বিভিন্ন ক্লাবের প্রতিনিধিরা ছোটাছুটি করছেন৷ চাহিদা এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যা সবাইকে সন্ত্তষ্ট করা যাচ্ছে না৷ যে কোনও মূল্যে টিকিট হলেই তাঁদের চাহিদা পূরণ হবে, একথা বলতে কেউই অস্বীকার করছেন না৷ হঠাৎ কেন টিকিটের চাহিদা এমনভাবে উচ্চমার্গে পৌঁছে গেল, তা ভাবার অবকাশ নেই৷ আইএফএ’র পক্ষ থেকে সুনীল ছেত্রীকে সেদিন বিশেষ সংবর্ধনা জানানো হবে৷ থাকবে চমক৷ সব মিলিয়ে কুয়েতের বিরুদ্ধে ভারতীয় দলের লড়াইটা একটু অন্যরকম হবে, তা বলতে দ্বিধা নেই৷
এদিকে, কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক ক্লাবের একটি বিশেষ আলোচনাচক্রে প্রাক্তন ফুটবলার ভাস্কর গাঙ্গুলি বলেছেন, সুনীল অবশ্যই বড় মাপের খেলোয়াড়৷ ক্লাব ফুটবল থেকে ভারতীয় দলের হয়ে তাঁর খেলা নজর কেড়েছে৷ কলকাতা ফুটবলে সেইভাবে সুনীলকে দেখতে পাওয়া যায়নি৷ তাই কলকাতা ছেড়ে কখনও জেসিটি, কখনও গোয়া, পরে অবশ্য বেঙ্গালুরুতে গিয়ে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন৷ হয়তো অনেকে বলবেন, কলকাতা ছেড়ে যাওয়ায় সুনীল বড় ফুটবলার হয়েছেন৷ সুনীল বড় খেলোয়াড় হওয়ার পিছনে অধ্যবসায়, অনুশীলন, আত্মবিশ্বাস এবং সংযত থাকার গুণগুলির কথাই বলেছেন৷ তবে, এটা ঠিক যদি কলকাতার তিনপ্রধানের হয়ে ফুটবল জীবনটাকে কাটিয়ে দিতেন, তাহলে এই সুনীলকে সেইভাবে পাওয়া যেত কিনা, তা বলা যাবে না৷ কারণ মনে রাখতে হবে, কলকাতা ফুটবল বলতেই প্রচণ্ড চাপ, সেটা অন্য কোনও রাজ্যে দেখতে পাওয়া যায় না৷ এমনকি, কলকাতায় যত ফুটবল খেলা হয়, তা অন্য কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না৷ তবে, সুনীলের উত্তরসূরী হিসেবে কাকে পাওয়া যাবে, সেই ভাবনাকে কখনও মানতে রাজি নন ভাস্কর গাঙ্গুলি৷ বাংলায় প্রতিভাবান ফুটবলাররা রয়েছেন, তাঁদের সেইভাবে সুযোগ দেওয়া হয় না৷ তার জন্য দায়ী কর্মকর্তা থেকে ক্লাব ও আইএফএ৷ বিভিন্ন জেলায় গিয়ে সেইসব প্রতিভাবানদের তুলে আনতে হবে৷ আর কারওর জন্য শূন্যস্থান ভরাট হবে না, সেটাও ঠিক নয়৷ আবার প্রাক্তন ফুটবলার দ্বিপেন্দু বিশ্বাস বলেছেন, সুনীল ছেত্রী নিজেকে অত্যন্ত নিয়মের মধ্যে ধরে রাখতেন৷ সময়কে তিনি কখনওই অবহেলা করতেন না৷ তিনি জানতেন, লড়াই করেই বড় হতে হবে৷
পাশাপাশি, খাওয়াদাওয়ার দিকেও নজর রাখতেন৷ যখন সুনীল, সুনীল হননি, তখনও তিনি বই পড়ার মধ্যে দিয়ে ফুটবলের জ্ঞানটা রপ্ত করতেন৷ বই পড়তে ভালবাসতেন৷ বিদেশি খেলোয়াড়দের খেলা দেখে খেলার চেষ্টা করতেন৷ প্রাক্তন ফুটবলার মেহতাব হোসেন বলেন, সুনীল ছেত্রীর সঙ্গে আরেকজন ফুটবলারকে দেখেছি বড় হওয়ার স্বপ্নকে কীভাবে বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়৷ তবে সুনীল যেভাবে নিজেকে মেলে ধরেছেন, সেই ফুটবলার নিজেকে প্রকাশ করতে পারেননি৷ তাঁর মধ্যে প্রচুর গুণ ছিল৷ কিন্ত্ত ভাগ্য অনেক সময় এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে না৷ সুনীলের বুদ্ধিকে তারিফ করতেই হবে৷ কোন পজিশনে খেলে গোল করা যাবে, তা তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতেন৷ প্রথমে শুরু করেছিলেন ডানদিক দিয়ে উঠে এসে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে চাপ সৃষ্টি করা৷ সেক্ষেত্রে সফল না হওয়ায় তিনি ডানদিক থেকে বাঁদিকে চলে এসে আক্রমণে ঝড় তুলতে শুরু করেন৷ সফলও হলেন৷ বাইচুং ভুটিয়ার সঙ্গে যখন তাঁর তুলনা করা হচ্ছে, তখন কেউই ভাবতে পারেননি, আগামী দিনে সুনীল ছেত্রীই হবেন ভারতীয় ফুটবলের আইকন৷ প্রাক্তন ফুটবলার রহিম নবি দীর্ঘদিন সুনীলের সঙ্গে খেলেছেন৷ রহিম নবির মতে, সুনীলের ব্যবহার অনেকটাই তাঁকে এগিয়ে নিয়ে গেছে ভালো খেলার জন্য৷ কারও সঙ্গে কটু কথা বলতেন না৷ মিষ্টি খেতে ভালবাসতেন৷ যখনই প্র্যাকটিসের পরে খাবারের টেবিলে বসতেন, তখন তাঁর জন্য মিষ্টি বরাদ্দ থাকত৷ আবার কখনও কখনও নিজেকে সরিয়ে রেখে আড্ডায় মেতে যেতেন৷
তাই সুনীলের বিদায়ী ম্যাচকে দেখার জন্য সারা কলকাতা যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণে আছড়ে পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷