টি-২০ বিশ্বকাপে ভারতীয় দল নিয়ে স্বপ্ন না দেখাই ভালো

শোভনলাল চক্রবর্তী

টি-২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ঢাকে কাঠি পডে় গেছে৷ পৃথিবীতে যে কয়েকটি দেশ ক্রিকেট খেলে তারা সবাই প্রস্তুত৷ ভারতীয় দলও পৌঁছে গেছে আমেরিকায় বিশ্বকাপ খেলতে, তবে দলের যা অবস্থা তাতে এই দল নিয়ে স্বপ্ন না দেখাই ভাল৷ বর্তমানে ভারতীয় ক্রিকেট দলের চেয়ে অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড! বিভিন্ন দেশের বোর্ডের মধ্যে খেলা হলে ভারত যে বিশ্বকাপ জিতবেই এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়৷ ভারতীয় বোর্ডের কানমলা খেয়েই বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থা আইসিসি রাজি হতে বাধ্য হয়েছে – ভারতের মাটিতে দু’মাস ব্যাপী আইপিএল নামক টি-২০ ক্রিকেট সার্কাস কাম কার্নিভাল শেষ হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে টি-২০ বিশ্বকাপের মত গুরুত্বপূর্ন একটি টুর্নামেন্টকে ক্রিকেট ক্যালেন্ডারে রাখতে৷ এখন এমন অবস্থা যেন আইপিএল ক্রিকেট বিশ্বকাপের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ন৷ কেন? ক্রিকেট ক্যালেন্ডারে বিশ্বকাপ আগে তারপর আইপিএল রাখা যেত না? মুশকিল হচ্ছে যে খেলোয়াড়দের কাছেও আইপিএল বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে৷ কারণটা খুব সহজ, টাকা৷ ক্রীতদাসদের যেমন একটা সময়ে নিলাম হত, তেমনি আইপিএলেও দল তৈরি হয় মালিকদের মধ্যে ক্রিকেটারদের নিয়ে নিলামের মাধ্যমে৷ এমন একটি বিশ্রী ব্যবস্থায় বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থাকে রাজি হতে হয়েছে কারণ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের দাদাগিরি৷ টাকার অঙ্কে আইসিসির থেকেও বড়লোক ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড! তবে এক হাতে তালি বাজে না, এ কথাও ঠিক৷ সুমনের গানের মত, গোলাম মালিক খোঁজে, মালিক গোলাম৷

ক্রিকেটারদেরও নিলাম থেকে মোটা টাকা আয় হয়৷ বহু ক্রিকেটার আছেন যাঁরা দেশের হয়ে না খেলে শুধু আইপিএল খেলতে আগ্রহী৷ আবার অনেক ক্রিকেটার দেশের মাটিতে হওয়া রাজ্য স্তরের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট না খেললেও আইপিএলে তাঁরা নিয়ম করে খেলেন৷ ভারত এবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটের একমাত্র দল, যে দলের প্রতিটি খেলোয়াড় আইপিএল ক্রিকেটে অংশ নিয়েছে৷ যদিও আইপিএল ফাইনাল খেলেছে যে দুটি দল, তাতে ভারতীয় বিশ্বকাপ দলের কোনও ক্রিকেটার ছিলেন না, একমাত্র ব্যতিক্রম রিঙ্কু সিং, তিনি বিশ্বকাপ দলে বিকল্প ক্রিকেটারদের একজন৷ যে দলে সর্বোচ্চ সংখ্যক ভারতীয় বিশ্বকাপ দলের ক্রিকেটার, সেই দল শেষ করেছে আইপিএল লীগ টেবিলের সবচেয়ে নিচের দল হিসেবে৷ এতেই ভারতীয় দলের ক্রিকেটারদের ফর্মের একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে৷ দুই মাস ধরে লাগাতার খেলা, তার সঙ্গে ভারতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাতায়াতের ফলে ক্লান্তি, এরপর বিশ্বকাপ খেলতে আমেরিকায় গিয়ে আগে তো ক্লান্তি দূর করতে হবে, পারফরমেন্স তো অনেক পরের কথা!


ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক রোহিত শর্মা এবং সহ-অধিনায়ক হার্দিক পান্ডিয়া দু’জনের কেউই ফর্মে নেই৷ ক্রিকেট দলের অধিনায়কের কাজটাই হল দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া৷ সেখানে অধিনায়কই যদি স্বাভাবিক ছন্দে খেলতে না পারেন, ফর্মে না থাকেন তবে দলকে পরিচালনা করা মুশকিল হয়ে পরে৷ ভারতীয় দলের সহ-অধিনায়কের অবস্থা আরও খারাপ৷ তিনি দলে ঠাঁই পেলেন কি করে সেটাই এক মস্ত ধাঁধা৷ না বলে, না ব্যাটে কোনোটাতেই তিনি বর্তমানে স্বচ্ছন্দ নন, অথচ দলে তিনি জায়গা পেয়েছেন একজন নির্ভরযোগ্য অলরাউন্ডার হিসেবে৷ বোর্ড সভাপতি স্বয়ং তাঁর হয়ে সাফাই গেয়ে বলেছেন, যে তাঁকে বর্তমান ফর্ম নয়, বিগত তিন বছরের ফর্মের ভিত্তিতে দলে নেওয়া হয়েছে৷ এমন আজব যুক্তি কেউ কখনও শুনেছেন বলে মনে হয় না৷ এরপর না সৌরভ, সচিনকে তাঁদের বিগত দশকের ফর্মের ভিত্তিতে আবার ভারতীয় দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়!

ভারতীয় দলের প্রথম পাঁচে যে ব্যাটসম্যানেরা রয়েছেন তাঁদের মধ্যে এক বিরাট কোহলি ছাড়া আর কেউ বর্তমানে নির্ভরযোগ্য ফর্মে নেই৷ বাকি সবাই অন-অফ ফর্মে৷ মানে এই ভালো, এই খারাপ৷ অধিনায়ক রোহিত শর্মার সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেটে অভূতপূর্ব সাফল্য পাওয়া, কিন্ত্ত টি-২০’তে আশানুরূপ ফল না করতে পারা যশস্বী জয়সওয়াল যদি ওপেন করেন তা হলে প্রথম ছয় ওভারে মানে পাওয়ার প্লে’তে রান রেট দশ রাখা যাবে কিনা সে সম্পর্কে বড় প্রশ্ন চিহ্ন আছে৷ তবে ডানহাতি বাম হাতি জুডি় সাফল্য পাবে এই আশা৷ অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন পাওয়ার প্লে’র সুবিধা নিতে বিরাটকে ওপেন করতে, সে ক্ষেত্রে তিন নম্বরে কে খেলবেন সেটা একটা প্রশ্ন যার উত্তর ভারতীয় শিবিরে নেই৷ সূর্যকুমার যাদব তিনে খেলতে অভ্যস্ত নন, যশস্বীও নন, সেক্ষেত্রে রোহিতকে নেমে আসতে হবে তিনে৷ একে ফর্মে নেই, তার উপর অধিনায়কত্বের চাপ, এর সঙ্গে নতুন পজিশনে ব্যাট করতে হলে রোহিতের অবস্থা হবে ত্রাহি মধুসূদন৷

তাহলে যশস্বী, রোহিত, বিরাট, সূর্যকুমার থাকছেন এক থেকে চারে৷ পাঁচে শিবম দুবে থাকবেন নাকি হার্দিক থাকবেন তা অনিশ্চিত৷ শিবম আইপিএলের শুরুতে ব্যাটে ঝড় তুললেও, দল ঘোষণার পর থেকে তিনি যেন হয়ে গেলেন নিজের চ্যাট জিপিটি সংস্করণ৷ তবে তিনি আইপিএলের শেষের দিকে মাঝের ওভার গুলিতে ভালো স্পিন বল করেছেন৷ সেটা তাঁর পক্ষে যাবে৷ উইকেট রক্ষক হিসেবে দলে অন্তর্ভুক্তি প্রায় পাকা করে নিয়েছেন ঋষভ পন্থ৷ দুর্ঘটনায় পড়ার পর এবার আইপিএল’এ তাঁর ফিরে আসা দেখে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন ‘‘এভাবেও ফিরে আসা যায়?’’ যেমন ব্যাটে ঝোড়ো ইনিংস খেলেছেন, তেমনই উইকেটের পেছনে ক্ষিপ্রতায় তিনি অন্য উইকেট রক্ষক সঞ্জু স্যামসনকে অনেকটাই পিছনে ফেলে দিয়েছেন৷ হার্দিকের যা অবস্থা তাতে তাঁকে ঋষভ-এর পরে খেলানো উচিত বলেই মনে করছেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা৷

বোলিংয়ে ভারতীয় দলের বড় বাজি যশপ্রিত বুমরাহ ফর্মে আছেন এটা ভারতীয় শিবিরের জন্য একটা ভালো খবর এবং আশার আলো, কারণ মহম্মদ সিরাজ ভালো বল করলেও তাঁর উইকেটের খরা কাটছে না৷ আর্শদ্বীপ সিং-এর প্রথম এগারোয় জায়গা করে নেওয়া মুশকিল৷ তিনি যে দলে এই বছর আইপিএল খেললেন সেই দল শেষ করেছে লীগ টেবিলের একবারে নিচের দিকে, আর্শদ্বীপ নিজেও যে দুর্দান্ত বল করেছেন এমন নয়৷ বিশেষ করে শেষের পাঁচ ওভারে বল করতে এসে তিনি প্রচুর রান দিয়েছেন৷ তবে ভারত যদি তিন পেসার খেলায় সেক্ষেত্রে তিনি দলে থাকবেন৷

স্পিন ত্রয়ীর মধ্যে কুলদীপ সিং ভালো বল করেছেন, কিন্ত্ত উইকেটের মধ্যে নেই, সেদিক থেকে চাহাল বরং বলে ভালো ফর্মে আছেন, কিন্ত্ত চাহাল একেবারেই ব্যাট করেননি৷ অন্যদিকে অক্ষর প্যাটেল ব্যাটে-বলে অনেকটাই স্বচ্ছন্দ রয়েছেন৷ সেদিক থেকে দেখতে গেলে অক্ষর প্যাটেল, জাদেজা এবং শিবম দুবে তিনজনেই অলরাউন্ডার হিসেবে খেলতে পারেন৷ জাদেজা নিশ্চয় খেলবেন, কিন্ত্ত বাকি দুজনের স্থান নির্ভর করছে ভারতীয় দলের বোলিং কম্বিনেশন নির্বাচনের উপর৷ আশা করা যায় ভারত চারজন বোলার খেলাবে৷ সেক্ষেত্রে বোলারদের মধ্যে জাদেজা, কুলদীপ, বুমরাহ এবং সিরাজ পছন্দের হতে পারে৷ হার্দিক দলে থাকলে শিবম হয়ত দুবে বাদ পড়বেন, সেক্ষেত্রে অক্ষর প্যাটেলের দলে জায়গা হতে পারে৷

ভারতীয় দল শেষ পর্যন্ত কোন এগারোকে খেলায় সেটাই এখন দেখার৷ ইতিপূর্বে ৫০ ওভারের ওয়ান ডে বিশ্বকাপে দেখা গেছে ভারতীয় দল একেক দিন একেক দল নামিয়েছে৷ সেক্ষেত্রে, গোটা টুর্নামেন্ট চলে গেল কিন্ত্ত ভারতীয় দল তাদের প্লেয়িং ইলেভেন খুঁজে পেল না! এবারও সেরকম হওয়ার সম্ভবনা প্রচুর৷ কোচ রাহুল দ্রাবিড় কয়েকটা প্র্যাকটিস ম্যাচ পেলে হয়ত সঠিক কম্বিনেশনটা খুঁজে পেতেন, কিন্ত্ত সে গুডে় বালি৷ ভারতীয় দল আমেরিকা পোঁছে মাত্র একটা প্র্যাকটিস ম্যাচ পাবে৷ তাও সেটা নড়বডে় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যারা সদ্য সিরিজ হেরেছে আনকোরা আমেরিকার ক্রিকেট দলের কাছে৷ ৫ জুন ভারতের প্রথম ম্যাচ আয়ারল্যান্ড-এর বিরুদ্ধে৷ তার পরেই ৯ জুন ভারতের হাই ভোল্টেজ ম্যাচ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে৷ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের জেতার পাল্লা ভারী, আপাতত সেটাই আশা জাগাচ্ছে৷ ভারতীয় দলের বাকি সূচি যা আছে তাতে ভারত সুপার এইটে যাবে, কিন্ত্ত তারপর কি হবে বলা শক্ত৷ ২৯ জুন ফাইনালে ভারত খেলবেই, না, এমনটা বলা যাচ্ছে না৷ ভারতীয় দলে কেউ একজন বা কয়েকজন ব্যক্তিগতভাবে জ্বলে না উঠলে এবার বিশ্বকাপে ভারতের কপালে দুঃখ আছে৷ ভারতের দলগত অবস্থা ভালো নয়, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷ বরং ভারতীয় দলের বিকল্প ক্রিকেটাররা ফর্মে আছেন, খেলার জন্য মুখিয়ে আছেন৷ শুভমন গিল, রিঙ্কু সিং, আবেশ খান, খলিল আহমেদ, প্রত্যেকে৷ অদ্ভুত পরিস্থিতি! ভারতের মূল দলের থেকে রিজার্ভ বেঞ্চ এই মুহূর্তে অনেক বেশি শক্তিশালী৷