অলিম্পিক নিয়ে উদাসীনতা ভারতীয় খেলোয়াড়দের

ভারতবর্ষের ১৪০ কোটি মানুষের বাস। অলিম্পিক গেমসের জন্য খরচ ৫০০ কোটি টাকা। পদক এলো মাত্র ৬ টি। তাতে আবার একটাও সোনার গন্ধ নেই। সদ্য শেষ হওয়া প্যারিস অলিম্পিকের এই হচ্ছে আজাদি কা অমৃত মহোৎসব পালনের নির্যাস। ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে অলিম্পিকের মত প্রেস্টিজিয়াস গেমস নিয়ে ভারতীয়দের কেনো এই এলার্জি বা ঔদাসিন্য?
আসলে টি-২০ ক্রিকেট এবং যৎসামান্য নীতা আম্বানির আইএসএল ফুটবল ভারতবর্ষের ক্রীড়া মানচিত্র ও সমাজের সর্বস্তরে এমনভাবে থাবা বসিয়েছে যে দেশের অন্যান্য খেলাগুলো বাস্তবিকই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না । এমন কি অলিম্পিক ও, পৃথিবীর অন্যতম সেরা ক্রীড়াযজ্ঞ ও এদেশের টি-২০ বিশ্ব কাপের অসীম ঔদ্ধত্যে তার বর্ণময় ঐতিহ্য, গ্ল্যামার, শিরোপার খেতাব ও ম্লান করে দিচ্ছে। অলিম্পিক গেমস দুনিয়ার এমন একটা প্রতিযোগিতা যেখানে কোনও দেশের কোনো ও খেলোয়াড় যদি দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায় তার জীবনের একটা স্মরণীয় মুহূর্ত বলে মনে করে থাকে। আর যদি পদক প্রাপ্তি ঘটাতে পারে তো তার খেলোয়াড় জীবন স্বার্থক হয়েছে বলে স্বীকৃতি মেলে।

স্বাধীনতার পর বেশ কয়েক দশক একটা অলিম্পিক পদকের জন্য এই দেশের মানুষ মুখিয়ে থাকতো। পঞ্চাশের দশকে মিলখা সিং বা আশির দশকে পিটি ঊষা আশা জাগিয়ে পদকের কাছাকাছি এসে পড়েও হাত ছাড়া হওয়ায় তখনকার ভারতবাসীদের শোকস্তব্ধ হতে দেখেছি। গেমস চলা একপক্ষ কালীন প্রতিদিন সংবাদের পাতায় চোখ বড় করে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা পদক তালিকা দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম ভারতের নাম ছাপা হচ্ছে কিনা। অলিম্পিকের এই পদক তালিকায় ভারতের নাম উঠত মোটামুটি ভাবে হকি দল মাঠে নামলে।

নব্বই দশকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত আর্থিক ক্ষমতার বলে কিছু খেলোয়াড় বিদেশে গিয়ে বা বিদেশি কোচের আধুনিক ট্রেনিংয়ে নিজেদের সর্বোচ্চ প্রতিদ্বন্দিতার মানে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় । তখন আবার নতুন আঙ্গিকে সীমিত ওভার ক্রিকেটের দাপটে হকির পদক ও হাতছুট হয়ে যায় দীর্ঘ তিন দশক।


স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশকে অলিম্পিক সহ বিদেশে কোনও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যোগদানের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের ভূমিকা ও অবশ্য খুব প্রশংসনীয় নয়। সেই পরিবেশ থেকে আজকের দিনের কেন্দ্রীয় সরকার অনেকটা নিম্নচাপের ঘেরাটোপ থেকে মেঘমুক্ত করতে পেরেছে ,সেকথা স্বীকার করতেই হবে। অলিম্পিকে পদকের সম্ভবনা আছে এমন ইভেন্ট গুলোকে বাছাই করে মোদি সরকার আর্থিক বরাদ্দও করেছিল। উদ্দেশ্য একটাই খেলোয়াড়রা যেন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় এই খেলার মঞ্চে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দেশকে গর্বিত করুক। দুর্ভাগ্য এই যে পরিমাণ অর্থ সরকার বরাদ্দ করেছিল তার বিনিময়ে ক্রীড়াবিদরা বাস্তবিকই দেশের মানুষের স্বপ্ন সার্থক করতে পারেনি।
তুলনামূলক বিচার করে দেখলে টোকিও অলিম্পিকের আগে কোভিডের প্রতিকূলতা ও দুঃসময়েও বরং ভারতীয়দের পারফরমেন্স অনেকটা ভালো ছিল। ভারত মোট ৭ টা পদক জিতেছিল এবং দেশের স্থান ছিল ৪৮ তম । এই প্যারিস অলিম্পিকে ভারত জিতেছে ৬ টি পদক, তার মধ্যে ৫ টিই ব্রোঞ্জ, একটি মাত্র রুপো, হাতছাড়া হয়েছে টোকিওর জ্যাভেলিনে নীরজ চোপড়ার সোনা। স্বাভাবিক কারণে টোকিও অলিম্পিকে ভারতের স্থান ৪৮ তম স্থান থেকে প্যারিসে নেমে গেছে ৭১ তম স্থানে, অর্থাৎ ২৩ ধাপ নিচে।

আরও একটা কথা বলে রাখা ভালো অলিম্পিকেও পাকিস্তানের যে পরিচয় ছিল সেটা এই হকিকে ঘিরে । স্বাধীনতার পর পাকিস্থান ৪ বারের অলিম্পিকের সোনা জয়ী ও ৪ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। সেই পাকিস্থান আজ হকিতে অস্তমিত সূর্য । বহুদিন পর নিরজ চোপড়ার সোনাটা আরশাদ নাদিম ছিনিয়ে পাকিস্তানকে আবার অলিম্পিক মঞ্চে এনে দাঁড় করালো।

এর সঙ্গে আরও একটা কথা বলে রাখা ভালো অলিম্পিকেও পাকিস্তানের যে পরিচয় ছিল সেটা এই হকি কে ঘিরে। স্বাধীনতার পর পাকিস্থান ৪ বারের অলিম্পিকের সোনা জয়ী ও ৪ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। সেই পাকিস্থান এখন হকিতে অস্তমিত সূর্য। বহুদিন পর নীরজ চোপড়ার সোনাটা আরশাদ নাদিম ছিনিয়ে পাকিস্তানকে আবার অলিম্পিক মঞ্চে এনে দাঁড় করালো।

এখনও অর্থ আছে, সরকারি সাহায্য আছে সহযোগিতা আছে , আনুকূল্য আছে, তথ্য প্রযুক্তির পূর্ণ সুযোগ আছে, প্রচার মাধ্যমের দৌলতে দেশ-বিদেশের প্রতিটি প্রতিযোগিতার টাটকা লড়াই দেখছে, সেরার সেরা প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে উপভোগ করছে, সঙ্গে সঙ্গে সমাজ মাধ্যমে প্রশংসার বন্যা বইয়েও দিচ্ছে। তবু কেনো এই উদাসীনতা ভারতীয় খেলোয়াড়দের। কেন এই এলার্জি অলিম্পিকের মত মহান ক্রীড়াযজ্ঞ এ দেশের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময়?

অথচ বিশ্বে মূল আসরে ক্রিকেট খেলিয়ে দেশ মাত্র ১২ টি , ওডিআইতে ১৬ টা আর টি-২০ আসরে ২০ টা দেশ যোগ্যতা পায়। সেখানে ১৪০ কোটি দেশের মানুষ ৫০০ কোটি খরচ করে মাত্র ৬টা পদক তার মধ্যে সোনা নেই একটাও, অনুশোচনা হয়না, আক্ষেপ হয় না একজন ভারতীয় হিসাবে?

অথচ এই এশিয়ারই দেশ জাপান দীর্ঘদিন এই মহাদেশের পতাকা নিয়ে অলিম্পিক মঞ্চে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। আজ তার চেয়েও বেশি শক্তি নিয়ে এই মঞ্চে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে চিন। দীর্ঘকায় ইউরোপিয়ানদের সরিয়ে তারা টক্কর নিচ্ছে শীর্ষ স্থানাধিকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তারা মার্কিনীদের সঙ্গে সমকসংখ্যক ৪০ টা সোনা জিতে দ্বিতীয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রর মোট পদক ১২৬ আর চীনের মত পদক ৯১ টা। জাপান তৃতীয় ২০ টা সোনা সহ মোট ৪৫ পদক। চিন-জাপান এই এশিয়ার ই দেশ এই দেখেও ভারতীয়রা আর কবে ভাববে?

আজ ও কিন্তু ভারতীয় ক্রীড়াবীদরা মনে মনে সেই ধারাই বহন করে চলেছে । দেশের প্রতি আন্তরিকতা, ভালোবাসা, দায়বদ্ধতার চূড়ান্ত অনীহা যা সমাজ মাধ্যমে লিখে চূড়ান্ত হতাশা প্রকাশ করেছেন একদা অলিম্পিকে সোনা জয়ী শুটার অভিনব বিন্দ্রা।