ভারতীয় ফুটবলের আইকন সুনীল ছেত্রীর অবসরের ঘোষণায় কুর্ণিশ দেশবাসীর

পূর্ণেন্দু চক্রবর্তী

আলবিদা৷ হঁ্যা, ফুটবলকে বিদায় দিতে চলেছেন ভারতীয় ফুটবলের আইকন সুনীল ছেত্রী৷ বিদায়ী ম্যাচ খেলবেন তিনি কলকাতাতেই৷ আসলে কলকাতা তাঁর প্রিয় শহর এবং জাতীয় দলে খেলার ছাড়পত্রটা পেয়েছিলেন এই কলকাতা থেকেই৷ তাই বিদায়ী ম্যাচটা কলকাতায় খেলবেন বলে ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন৷ আগামী ৬ জুন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণে সুনীল ছেত্রীর বিদায়ী ম্যাচে ভারত মুখোমুখি হবে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বের খেলায় কাতারের বিরুদ্ধে৷ তাই সেদিন হয়তো সারা কলকাতা উপচে পড়বে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণ৷ ফুটবলজীবনে প্রথম চার বছর তিনি মোহনবাগানে খেলে গেছেন৷ তারপরে দু’বছর খেলেছেন ইস্টবেঙ্গলে৷ কলকাতার প্রিয় ফুটবলপ্রেমীদের আবেগকে কোনওদিনই তিনি ভুলতে পারেননি৷ কলকাতায় এলেই সেই কথাই বলতেন৷ যেখানেই খেলি না কেন, কলকাতায় এলে ফুটবলের আলাদা একটা প্রাণ খুঁজে পাওয়া যায়৷ দর্শকদের মধ্যে যে উন্মাদনা চোখে পড়ে, তা মনের গভীরে গেঁথে রাখা যায়৷ তাই কলকাতার প্রেমে তিনি হাবুডুবু খেয়েছেন৷ সেই টানেই কলকাতায় তাঁর শ্বশুরবাড়ি পছন্দের তালিকায় রেখেছেন৷ ভারতের অন্যতম সেরা ফুটবলার সুব্রত ভট্টাচার্যের মেয়ের সঙ্গে সুনীল বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন৷ কলকাতা ছেড়ে তিনি কোথাও থাকতে চান না৷ যখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এবারে ফুটবলকে বিদায় জানাতে হবে, তখনও তিনি কলকাতার কথা মনে রেখে এবং ফুটবলপ্রেমীদের কাছে পাওয়ার জন্য আগামী ৬ জুন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণে সবাইকে আহ্বান করেছেন৷ কলকাতাতেই দেশের জার্সি গায়ে জীবনের শেষ ম্যাচটা খেলতে চেয়েছেন৷

বিদায়ী ম্যাচে কোনও চমক দেওয়া নয়, বড় কোনও অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাও নয়, তাঁর কাছে বড় প্রাপ্তি হবে যদি ভারতীয় দল কাতারের মতো দলকে হারাতে পারে, সেটাই বড় প্রাপ্তি৷ সেই কারণেই সারা ভারত ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কল্যাণ চৌবেকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন সুনীল, কোনওরকম সংবর্ধনার আয়োজনের ব্যবস্থা না করতে৷ সুনীল ফুটবলকে বিদায় জানাচ্ছেন, এই খবরটা প্রথমে তাঁর বাবা-মা ও স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন৷ তারপরেই এই খবরটা দেন শ্বশুর সুব্রত ভট্টাচার্যকে৷ সুনীল কলকাতা ময়দানে যতদিন না খেলেছেন, তার চেয়েও বেশি খেলেছেন ভিনরাজ্যের ক্লাবে৷ কিন্ত্ত কখনওই কলকাতাকে ভুলতে পারেননি তিনি৷ বেশ কিছুদিন ধরেই সুনীল ছেত্রীকে নিয়ে নানারকম খবর ছড়িয়েছিল৷ তিনি হয়তো আর ফুটবল নিয়ে মাঠে নামবেন না৷ টানা উনিশটা বছর ফুটবলের সঙ্গে যে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, তা ভুলে যাওয়ার কোনও জায়গা নেই৷


সেকেন্দ্রাবাদে তাঁর জন্ম হয়েছিল৷ বাবা ছিলেন সেনাবিভাগে৷ তখন থেকেই সুনীল উপলব্ধি করেছিলেন, দেশপ্রেম কাকে বলে৷ দেশ তাঁর কাছে অনেক বড়৷ তা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না৷ আন্তর্জাতিক স্তরে তিনি যতবার খেলতে গেছেন, তখন তিনি মহান ভারতবর্ষের কথা পৌঁছে দিয়েছেন সেখানকার মানুষের কাছে৷ সেকেন্দ্রাবাদ থেকে দিল্লিতে এসে সেখানে মানুষ হয়েছিলেন৷ দিল্লিতেই তাঁর ফুটবলের প্রথম ক্লাব৷ তারপরেই তিনি চলে এসেছিলেন কলকাতায়৷ তাই কলকাতার প্রতি তাঁর আলাদা অনুভূতি ও অনুভব৷ এককথায় বলা যায়, সুনীল ছেত্রী ভারতীয় ফুটবলের একটা মাইলফলক৷ ভারতীয় ফুটবলের কিংবদন্তী৷ যেখান থেকে তাঁর ফুটবলজীবন সেই অর্থে শুরু হয়েছিল, সেই মাঠেই তাঁর অবসরের ম্যাচটা খেলবেন৷ ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁর ১৫০টি ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে৷ গোল করেছেন ৯৪টি৷ জানা নেই ভারতীয় ফুটবলে এমন গৌরবময় অধ্যায় কারও জন্য লেখা রয়েছে কিনা৷ ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, লিওনেল মেসির পরে তাঁর নামটা উজ্জ্বল হয়ে থাকবে৷ কিন্ত্ত অনেকেই হয়তো বলবেন, রোনাল্ডো ও মেসি যে স্তরে ফুটবল খেলেছেন, সেইভাবে সুনীল ছেত্রীকে তুলনা করা যাবে না৷ তবুও ভারতীয় ফুটবলের তিনি যে উজ্জ্বল নক্ষত্র, তা নিয়ে কারও দ্বিমত নেই৷ তাঁর খেলোয়াড়ি জীবন নিয়ে যদি রূপকথা লেখা যায়, সেখানে ভারতীয় ফুটবলে চুনী গোস্বামী, পি কে ব্যানার্জি ও বাইচুং ভুটিয়ার সঙ্গে বিজয়নের নামটাও উল্লেখ থাকবে৷ ভারতীয় ফুটবলে ১০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার কৃতিত্ব রয়েছে সুনীল ছেত্রীর৷ যখন ভারতীয় ফুটবলের খুবই খারাপ অবস্থা চলছে, ঠিক সেই সময় কোচ ইগর স্টিম্যাকের সঙ্গে সুনীল ছেত্রী হাল ধরেছিলেন৷ সেই সময় বেশকিছু তরুণ প্রতিভাকে ভারতীয় ফুটবলে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল৷ অধিনায়ক হিসেবে ভারতীয় ফুটবলে তাঁর দক্ষতা আজও অম্লান রয়েছে৷ তিনি কখনওই নিজের জন্য খেলতেন না৷ যখনই মাঠে নামতেন, তখনই দেশ ও ক্লাবের হয়ে খেলার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে যেতেন৷ তাঁর আদর্শ তরুণ প্রতিভাদের কাছে নতুন দিক চিহ্নিত করে৷ দ্রোণাচার্য কোচদের তিনি কখনওই অসম্মান করতে জানতেন না৷

সুনীল ছেত্রী ২০০৫ সালে ১২ জুন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতীয় দলের জার্সি পেয়েছিলেন৷ অভিষেক ম্যাচেই গোল করেছিলেন৷ সুনীলের প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ছিল ২০০৭ সালে নেহরু কাপ ফুটবলে৷ প্রথম ম্যাচে কম্বোডিয়াকে ভারত হারিয়েছিল ৬-০ গোলের ব্যবধানে৷ এই ৬টি গোলের মধ্যে দু’টি গোল করেছিলেন সুনীল ছেত্রী৷ এমনকি সিরিয়া ও কাজাকাস্তানের বিরুদ্ধে ভারত হেরে গেলেও ওই দুই ম্যাচে সুনীলের গোল ছিল৷ ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন৷ বাইচুং ভুটিয়া অবসর নেওয়ার পরে ভারতীয় ফুটবলের মুখ ছিলেন সুনীল ছেত্রী৷ নিজের প্রতিভা ও দক্ষতার মধ্য দিয়ে তিনি সবাইকে টেক্কা দিয়ে গেছেন৷ জাতীয় দলের হয়ে তিনি মাঠে নামলেন কখনওই নিজের দেশকে ভুলে যেতেন না৷ এমনকি লজ্জার হার থেকেও বাঁচিয়েছেন সুনীল ছেত্রী৷ সুনীলের অবসর অবশ্যই একটা যুগের অবসান৷ প্রায় একদশক ধরে সুনীল ছেত্রী যেভাবে ভারতীয় ফুটবলের পতাকাকে উজ্জ্বল করেছেন, তা অভাবনীয়৷ তিনি অর্জুন ও পদ্মশ্রীর মতো পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন৷ সবচেয়ে বেশি বর্ষসেরা ফুটবলার হিসেবে সারা ভারত ফুটবল ফেডারেশনের পক্ষ থেকে সম্মানিত হয়েছেন৷

প্রথম ভারতীয় ফুটবলার হিসেবে তিনি তিনটি উপমহাদেশে খেলেছেন৷ খেলেছেন ভারতের সেরা ক্লাবগুলির হয়ে৷ এছাড়া বিদেশে স্পোর্টিং ক্লুব দ্য পর্তুগাল এবং উত্তর আমেরিকার ক্লাব কানসাস সিটি উইজার্ডরে হয়ে খেলেছেন৷ দু’বার এএফসি চ্যাম্পিয়ন লিগে খেলেছেন চার্চিল ব্রাদার্স ও বেঙ্গালুরু এফসি’র হয়ে৷ আইএসএল ফুটবলে ভারতীয় ফুটবলার হিসেবে সুনীল ছেত্রীর দু’টি হ্যাটট্রিকও রয়েছে৷ বাইচুং ভুটিয়া উত্তরসূরি হিসেবে অধিনায়কের আর্মব্যান্ড পরিয়ে দিয়েছিলেন সুনীল ছেত্রীকে, যা ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে এক বিরল নজির৷ সুনীল ছেত্রীর অবসরের কথা জানতেই সারা ভারতের সর্বস্তরের মানুষ তাঁকে স্যালুট জানাতে ভুল করেননি৷ যাঁরা সুনীলকে দেখেননি, তাঁরাও দূর থেকে স্যালুট করছেন তাঁর অমায়িক ব্যবহার ও অসাধারণ ফুটবল জীবনকথা জানতে পেরে৷