আপাতত ১২দিনের বিরতিতে আইএসএলের কোনও ম্যাচ হচ্ছেনা। ভারতীয় দলের ১২ অক্টোবরের ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে ফ্রেন্ডলি ম্যাচের জন্য এই বিরতি আছে। ফ্রেন্ডলি ম্যাচে ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে ভারতীয় দলের খেলা ১-১ গোলে অমিমাংসিত থাকে। ২৩জনের ভারতীয় দলে একমাত্র বাঙালি ফুটবলার মোহনবাগানের অধিনায়ক শুভাশিস বসু। বাঙালির শ্রেষ্ঠ খেলা ফুটবলের আগামী ১৯ অক্টোবরের ডার্বিতেও দু’দলের মধ্যে একমাত্র বাঙালি ফুটবলার হিসেবে শুভাশিসের স্হান পাকা বলা যায়। ইষ্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের ডার্বিতে বাঙালি ফুটবলারদের এমন উপস্হিতির হার বেদনাদায়ক বটে। এমনটাই হয়তো বা স্বাভাবিক ঘটনা বলা যায়। নচেৎ, এআইএফএফ ভারতীয় ফুটবলের উন্নতির লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গকে উপেক্ষা করে রাজস্হানের মত ভিন্ন রাজ্যের ফুটবলে জোর দেবে কেন? এদিকে, এআইএফএর মাথায় প্রাক্তন বাঙালি ফুটবলার বসে আছেন।বাংলা কি তবে নিজের ছেলের কাছেই লাঞ্ছিত হচ্ছে?
গত মরশুমে আইএসএলের লিগ চ্যাম্পিয়ান মোহনবাগান এসজি। সুপার কাপ চ্যাম্পিয়ান ইষ্টবেঙ্গল এফসি। আইলিগ চ্যাম্পিয়ান মহামেডান এসসি। দেশের প্রথমসারির তিন টুর্নামেন্টে বাংলার জয়জয়াকার ছিল।
অবশ্য ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে নির্বাচিত ২৩ জনের দলে বাংলার দুই প্রধান থেকে ৮জন ফুটবলার সুযোগ পেয়েছে। মোহনবাগানের ৬জন ফুবলার ও ইষ্টবেঙ্গল এফসির ২ জন ফুটবলার ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়েছে। মহামেডান এসসি থেকে কোনও ফুটবলার সুযোগ পায়নি। অর্থাৎ, ইষ্টবেঙ্গল এফসি ও মোহনবাগান এসজি থেকে একাধিক ফুটবলার ভারতীয় দলে সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু ওই দুই বড়দলে বাঙালি ফুটবলাররা জায়গা করে নিতে পারছে না। ফলে ভারতীয় দলেও সুযোগ মিলছে না।
বাঙালি ফুটবলাররা বড় দলে জায়গা করে নিতে পারছেনা,নাকি বড়দলের কর্মকর্তারা বাঙালি ফুটবলারদের জায়গা দিচ্ছে না?
এবিষয়ে নানা বির্তক আছে। এরফাঁকে বড়দলের মালিকানা আর আদৌ বাঙালিদের হাতে আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এমনটি হলে,বাঙালির আবেগের দাম কে দেবে? উমাপতি কুমার বা শৈলেন মান্না থেকে জ্যোতিষ গুহদের রক্তে বয়ে যাওয়া ভালোবাসার ফুটবলটা বড়দলে কৌলিন্য এনে দিয়েছিল। কিন্তু ৯০ দশকের খোলা হাওয়া ও তৎপরবর্তী রাজনৈতিক আবহে বাঙালির সেরা খেলার পীঠস্থানে এমন পট পরিবর্তনের পূর্বাভাস
এত সহজেই মিলে গেল?
সহজেই যা মিলিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না….
১৩ বছর আইলিগে খেলে ইষ্টবেঙ্গল ক্লাব একবারও সর্বভারতীয় ট্রফিটা জিতেত পারলো না। অতিকষ্টে অবশ্য মোহনবাগান ক্লাব ২বার জিততে পেরেছে। সর্বভারতীয় স্তরে বাংলার বড় দলগুলোর এমন অবস্হা কল্পনায় ছিল না।
কিন্তু হুঁশ ফিরছে কোথায়?
৫ বছর ধরে ইষ্টবেঙ্গল এফসি আইএসএলে খেলছে। ৮৬টা ম্যাচ খেলে ৪৭টা ম্যাচ তারা হেরেছে। অর্ধেকের বেশি ম্যাচ ইষ্টবেঙ্গলের মত ঐতিহ্যবাহী দল হেরে চলেছে–এটা মানা যায়? ভালো দল গড়েও এবার টানা ৪ ম্যাচে হারতে হবে? গত ৪ বছর ধরে ১১/১৩ দলের মধ্যে ইষ্টবেঙ্গলের অবস্হান ৯ থেকে ১১তম স্হান হয়েছে। তবুও তাদের দলে একাধিক বাঙালি ফুটবলার সুযোগ পায়নি। লিগ টেবিলের নীচের দিকে থাকা ইষ্টবেঙ্গল দলে যেখানে বাঙালি ফুটবলাররা সুযোগ পায়না, সেখানে লিগ টেবিলের উপরেরদিকে থাকা মোহনবাগান দলে একাধিক বাঙালি ফুটবলারদের সুযোগ পাওয়া কি করে আশাকরা যায়? গত ৪বছর ধরে তো মোহনবাগান আইএসএলে ১ থেকে ৩ এর মধ্যে থেকেছে। ইষ্টবেঙ্গল যেখানে ইতিমধ্যে আইএসএলে অংশগ্রহণ করে ৪৭টা ম্যাচ হেরেছে, সেখানে মোহনবাগান ৪৭টা ম্যাচ জিতেছে। এবছররে হিসেব ধরলে সামনের ডার্বি ম্যাচ মোহনবাগান জিতলে,আইএসএলে অংশগ্রহণের পর তাদের ৫০তম ম্যাচ জেতা হবে।
এমন ৫০টা জয় মহামেডান ক্লাবও গত ৪বছরে কলকাতা লিগে পেয়ে টানা ৩বার লিগজয়ী হয়েছে। দীপু হালদার,তন্ময় ঘোষেরা অপর দুইপ্রধানে ডাক পায়নি। এতো কলকাতা লিগের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে।এদিকে,তিন বড়দলের পর টালিগঞ্জ ও ইউনাইটেড স্পোর্টস উঠল বটে, কিন্তু তারাও তো হারিয়ে গেল। কোনক্রমে লিগে টিকে থাকছে,তবে সুপার সিক্সে তাদের দেখা নেই।
যারা দেখা দিচ্ছে–তাদের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার কেউ নেই। সাম্প্রতিক সময়ের দুটো উদাহরণ দেওয়া যায়।
প্রথমত: এবার আইলিগ তৃতীয় বিভাগে ডায়মন্ড হারবার এফসি চ্যাম্পিয়ান হলো। তাদের জয়ে স্টাইকার নরহরি শ্রেষ্ঠা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে। দলের ২৩গোলে তার ৮টা গোল আছে। কলকাতা লিগে তার গোলগুলো যুক্ত করলে সংখ্যাটা ১৫তে দাঁড়ায়। এই নরহরি ও রবি হাঁসদার জুটি বাংলাকে জাতীয় গেমস্ এনে দিয়েছে। কোচ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের প্রশিক্ষণে সেবারের বাংলা দল জাতীয় গেমস ছাড়া সন্তোষ ট্রফির প্রাথমিক পর্বেও গ্রুপস্টেজ উইনার্স হয়। রবি ও নরহরিরা তাদের ক্লাবদল কাষ্টমস ছাড়া বাংলা দলের হয়েও প্রচুর গোল করেছিল। কিন্তু সেবারের সন্তোষ ট্রফির মূলপর্বের আগে রবির চোটে ওদের জুটি ভেঙে যায়। বাংলা দলও সাফল্য পেলনা। কিন্তু সেই ব্যর্থতা নিয়ে তুমুল বির্তক তৈরি হলো।
দ্ধিতীয়ত: ৪০বছর পর বাংলা দল কেরলের মাটিতে সন্তোষ ট্রফির ফাইনালে উঠেছিল। কিন্তু ট্রাইব্রেকারে হেরে চ্যাম্পিয়ান হতে পারেনি। তথাপি রার্নাস বাংলা দলকে নানা জায়গায় সংবর্ধিত করা হয়। বেশকিছু বাঙালি ফুটবলারকে ইষ্টবেঙ্গল ক্লাব তাদের দলে নেয়। বাংলার বিপক্ষে জয়ী কেরল দলের কোচকে ইষ্টবেঙ্গল ক্লাবের দায়িত্বে আনা হলো। কিন্তু কেমন করে যেন তাদের দল থেকে অধিকাংশই বাঙালি ফুটবলার হারিয়ে গেল।
কিন্তু এখনো হারিয়ে যাননি, কোচ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য ও রঞ্জন ভট্টাচার্য। তাদের প্রশিক্ষণেরই দুই দল কাষ্টমস ও সুরুচি সংঘ সুপার সিক্সে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। নিশ্চয়ই তারা চ্যাম্পিয়ানশিপের লড়াই থেকে ছিটকে গেছে। চ্যাম্পিয়ানের পথে ইষ্টবেঙ্গল ক্লাব ঘরের মাঠে অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু বাইরের তিনটে মাঠেই ইষ্টবেঙ্গলের জয় আসেনি। বারাকপুরে ইষ্টবেঙ্গল জিতলেও নৈহাটিতে দুটো ম্যাচ ড্র করতে হয়েছে। সৌভাগ্যের যে,তাদের উলুবেড়িয়া ও চ়ুঁচড়া মাঠে খেলতে হয়নি। লিখে শেষ হবে না। কিন্তু লিখতে তো হয়–ইষ্টবেঙ্গল এফসি আইএসএলে তাদের শেষ জামশেদপুর ম্যাচে হেরেছে। কোচ বিনু জর্জ কিন্তু ম্যাচে ৪র্থ পরিবর্তনটা নেওয়ার সাহস দেখাননি। সেখানে বাঙালি ফুটবলারদের সুযোগ থাকবে কি করে? আগামী ডার্বির আগে বাংলার ফুটবলে বাঙালি ফুটবলারদের প্রেক্ষিত আলোচনা করতে হলো।
১২দিনের অপেক্ষা শেষে আবার আইএসএলের খেলা শুরু হবে। এবং ১৯ অক্টোবরের ডার্বি দিয়ে ইষ্টবেঙ্গল এফসি ও মোহনবাগান সুপার জায়েন্টেস তাদের আইএসএলের অভিযান পুনরায় শুরু করবে। কিছুদিনের মধ্যেই এই ডার্বি নিয়ে বাঙালির উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকবে। যদিও বা দুটো দলই তাদের প্রত্যাশিত পারফরম্যান্সের কাছাকাছিও নেই।
ইষ্টবেঙ্গল এফসি ইতিমধ্যে ৪টে ম্যাচ খেলে ৪টে ম্যাচেই হেরেছে। ৩ ম্যাচ হারের পরেই তাদের কোচ পরিবর্তন হয়েছে। দেড়বছরের মধ্যেই কোচ কার্লোস কুয়াদ্রাতের চাকুরি গেল। অথচ এই কোচের হাত ধরে ইষ্টবেঙ্গল এফসি ডুরান্ড কাপে রার্নাস হয়েছে। দীর্ঘ ১২বছরের খরা কাটিয়ে সুপার কাপ জিতেছে। এবছর চমক দিয়ে মোহনবাগান সুপার জায়েন্টস থেকে ভারতীয় ফুটবলার আনোয়ার আলি ও বিদেশি ফুটবলার হেক্টর ইউসা কে নিয়েছে।
মাঝমাঠকে শক্তিশালী করতে কেরল ব্লার্ষ্টাস থেকে ভারতীয় দলের ফুটবলার জিকসন সিংকে নিয়েছে। গত মরশুমের আইএসএলের সর্বোচ্চ গোলদাতা ও সাহায্যকারী গোলদাতা দুই বিদেশি যথাক্রমে দিমিত্রি দিয়ামান্টোস ও মাহিদ তালালকে দলে নিয়েছে। গতমরশুমে আইলিগ জয়ী মহামেডান স্পোটিং ক্লাব থেকে নজরকাড়া মিজোরামের ফুটবলারকে দলে নিয়েছে। এককথায় দলবদলের বাজারে চমক দিয়ে সেরা দল ইষ্টবেঙ্গল এফসি বানিয়েছে। তথাপি ৪ ম্যাচেই তাদের পরাজয় মানতে হয়েছে। ৪ ম্যাচে গোল দিয়ে ৮ গোল খেয়েছে।
পক্ষান্তরে গতমরশুমে আইএসএল লিগ জয়ী মোহনবাগান সুপার জায়েন্টস তাদের কোচ হাবাসের পরিবর্তে আরেক লিগ জয়ী কোচ মোলিনাকে এনেছে। এছাড়া দলে ৪ জন নতুন বিদেশি নিয়েছে। রডরিগেজ, স্টুয়ার্ট, আলরেড, ম্যাকলারেনদের দলে সংযুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি ভারতীয় দলের মাঝমাঠের সেরা ফুটবলার আপুইয়াকেও তারা দলে নিয়েছে। কিন্তু এবারের মরশুম তাদের ভালো শুরু হয়নি। ইতিমধ্যে ৩ ম্যাচে তারা ৭ গোল খেয়েছে। ফলে দুটো দলই তাদের রক্ষণ নিয়ে চিন্তিত আছে। বাংলার দুই বড়দল আবার ডার্বিতে মাঠে নামবে। গুরুত্বপূর্ণ সেই ম্যাচে কোনও বাঙালি ফুটবলারের অবদান কিভাবে প্রতিষ্ঠা পাব? একা শুভাশিসের পক্ষে ম্যাচের বিশেষ ভূমিকা নেওয়া কি সম্ভব হবে? বাঙালির সেরা ডার্বির উৎসবে বাঙালি তবে উপেক্ষিত থেকেই যাচ্ছে।