• facebook
  • twitter
Sunday, 20 October, 2024

জাতীয় লিগ থেকে আইএসএল, ভারতীয় ফুটবল সেই তিমিরেই পড়ে রইল

সংস্হার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। বিভিন্ন রাজ্য ফুটবল নিয়মক সংস্হার প্রতি সঠিক বোঝাপড়া নেই। সর্বভারতীয় জুনিয়র লিগ প্রচণ্ড গরমের মধ্যে খেলতে বাধ্য করা হচ্ছে। প্রতিভাবান ফুটবলারদের বাছাই করে উপযুক্ত ট্রেনিং দেওয়ার নিজস্ব পরিকাঠামোর সঠিকভাবে ব্যবহারে তাগিদ নেই।

সল্টলেক স্টেডিয়ামের গতকালের রাতের ডার্বি আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ভারতের মাটিতে ফুটবলের বাজার আছে। ভারতীয় ফুটবলেই তার নিজেস্বতা নিয়ে এশিয়ার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকার সবরকম রসদ মজুত আছে। প্রবল রাজনৈতিক অস্হিরতার অসময়েও দুই দলের ডার্বিতে ৬০ হাজার সমর্থক মাঠে হাজির থেকেছে। এত দর্শক যেখানে ফুটবলের টানে ছুটে আসে সেখানে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে এত পিছিয়ে পড়া কেন? টিকিট থেকে তো ভালো টাকাই রোজগার করা যায়। এই বিশাল দর্শকদের কাছে ফুটবলটাকে ভালো করে মার্কেটিং করা যাচ্ছেনা? বাংলার দুই দলের ডার্বি হয়েছে। দুটো দলকেই সরকার আর্থিক সাহায্য করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি ক্লাবের নিজস্ব আর্থিক অবস্হা কখনও ভালো হয়নি। এর অন্যতম কারন হিসেবে বলা যায় যে, ক্লাব পরিচালানায় স্বচ্ছতার অভাব আছে। নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে তুলে ধরায় অভাব আছে। দুটো ক্লাবেই সমাজের বিশিষ্টজনেরা এলেও তাদের ক্লাবের মুখ হিসেবে সামনে আনা হয়নি। ক্লাবের এই প্রশাসনের সাথে রাজ্য ফুটবল নিয়ামক সংস্হার প্রশাসনের কোনো পার্থক্য নেই। রাজ্য ফুটবল নিয়ামক সংস্হার অবস্থানের নিরপেক্ষতা নিয়েই ভিতরের অংশ থেকে প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। ফলতঃ ক্লাব প্রশাসনের মধ্য থেকে রাজ্য প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করার এখনকার ভয়ঙ্কর প্রবনাতকেও অস্বীকার করা যাচ্ছেনা। এই সমন্বয়ে ফুটবলের পক্ষে রাজ্য ফুটবল নিয়ামক সংস্হার সিদ্ধান্ত গ্রহণে কালবিলম্ব হচ্ছে। এমনভাবে উভয় প্রশাসনেই দুর্নীতির অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় কি? অপরদিকে সর্বভারতীয় ফুটবল সংস্হায় উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে রাজ্য ফুটবল নিয়ামক সংস্হাগুলোকে পরিচালনায় প্রতিমুহূর্তে দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে।

একসময়ে বিভিন্ন রাজ্যে নানা আকর্ষক ফুটবল টুর্নামেন্ট ছিল। রাজ্য ফুটবল সংস্হার নিয়ন্ত্রণের সেইসব টুর্নামেন্ট হয় বন্ধ হয়ে গেছে,বা টুর্নামেন্টগুলো তার জৌলুস হারিয়েছে। এই প্রসঙ্গে আইএফএ শিল্ড, রোর্ভাস বা ডিসিএম ও বরদৌল টুর্নামেন্ট উল্লেখযোগ্য। টুর্নামেন্টগুলো বন্ধ হয়ে যেতেই দেশের বিভিন্ন ক্লাবগুলোর পক্ষে প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলার সুযোগ হারিয়ে গেছে।প্রধান লিগ হিসেবে আইএসএলে প্রমোশন থাকলেও অবনমন চালু করা যাচ্ছেনা। লিগের ফরম্যাটে অদ্ভুত নিয়ম চালু থাকছে। লিগের প্রতিযোগিতায় টেবিলের শীর্ষ টিমকে লিগচ্যাম্পিয়ান ঘোষনা করা হচ্ছে। কিন্তু লিগটেবিলের উপরের দলগুলো নিয়ে সুপার সিক্স নকআউটের খেলার মধ্যে অপর দলের চ্যাম্পিয়ান হওয়ার মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। এরসাথে পাল্লা দিয়ে খেলোয়াড়দের মধ্যে অপেশাদারিত্ব বেড়েছে। এই মরশুমে মোহনবাগান এসজি ও ইষ্টবেঙ্গল এফসির মধ্যে ভারতীয় ফুটবলার আনোয়ার আলিকে নিয়ে দলবদলের বাজারে যেভাবে এআইএফএফের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটি ও আদালতের রায়ে দন্ধ বেঁধেছে, তাতে ভারতীয় ফুটবলের অপেশাদারিত্ব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। ফুটবলারদের প্রকৃত শিক্ষাপ্রদানের কখনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। গ্রাসরুট লেভেল থেকে ফুটবলার তুলে আনার পরিকাঠামো দেশের প্রধান দলগুলো গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে,যথাযথ কোচিংয়ের মাধ্যমে ভালো মানের ও শিক্ষার ফুটবলার উঠে আসেনি। সারাদেশ থেকে প্রতিভাবান ফুটবলার তুলে আনার ক্ষেত্রে ক্লাবগুলোর বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা ছাড়া সর্বভারতীয় ফেডারেশনের কোনও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেই।

পারস্পরিক পরিকল্পনাহীনতার দরুন নানা অনিয়মে ভারতীয় ফুটবল জড়িয়ে পড়েছে। একাধিক রাজ্য ফুটবল সংস্হার ম্যাচগুলোকে ঘিরে ম্যাচ-ফিক্সিংয়ের মত আত্মঘাতী অভিযোগ উঠেছে। গোয়া, বাংলা,দিল্লির মত রাজ্যগুলোর নাম উঠে এসেছে। এই ম্যাচ-ফিক্সিং নিয়ে কেবল রাজ‍্য লিগ নয়,গতমরশুমের আইলিগের দ্ধিতীয় বিভাগের ফলাফলেও অনেক অস্বাভাবিকতা দেখা গেছে।

এহেন পরিস্হিতিতে সর্বত্র সংস্কারমূলক কাজের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।জাতীয় লিগ থেকে শুরু করে আইএসএলের একাদশ পর্বের বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের কোনো সুষ্ঠ পরিকল্পনা কাজ করেনি।১৯৯৬/৯৭ সালে দেশের ১২দল নিয়ে জাতীয় লিগের শুরুটা আমাদের পেশাদার ফুটবলের পথে এগোনোর প্রথমধাপ ছিল।দুবছরের মধ্যে আমাদের পাকাপাকিভাবে পেশাদার ফুটবলে পৌঁছনোর কথা বলা ছিল।কিন্তু প্রথম ১১বছরেও আমাদের ফেডারেশন সেকাজ করে উঠতে পারেনি।দুবছর অন্তর কেবল লিগের স্পন্সরের বদল ঘটেছে। ১১বছরে ২১টা দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।যাদের অধিকাংশ কেবল অস্তিত্বরক্ষা করতে করতেই হারিয়ে গেছে। তারপর নতুন মোড়কে আইলিগের সূচনা হলো। ভাবা হয়েছিল আর্থিকভাবে স্বচ্ছল অনেক ক্লাব উঠে আসবে। স্রোতের অনুকূলে নিশ্চয়ই কিছু ক্লাব উঠে এসেছিল। ব্যাঙ্গালরু এফসি ও মুম্বাই এফসি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম বলতে হয়।২০১৪ সাল থেকে দেশে বানিজ্যিক লিগ হিসেবে আইএসএল শুরু হতেই আইলিগের অস্তিত্ব নিয়ে চরম টানাটানি শুরু হয়ে যায়। ৫বছরের মধ্যেই অনেক আইলিগ ক্লাব তাদের দিশা হারিয়ে ফেলেছিল। ৫বারের জাতীয় লিগ ও আইলিগ জয়ী টিম হিসেবে ডেম্পো স্পোর্টস ক্লাবের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বটে। শেষপর্যন্ত তারা একসময় আইলিগ থেকেই হারিয়ে যায়। অবশ্য ১০বছর পর ওরা এইমরশুমে আবার আইলিগে ফিরে এসেছে। কিন্তু কোভিড মহামারী পরবর্তী সময়ের মধ্যে ক্রমে ব্যাঙ্গালরু এফসি, মোহনবাগান, ও ইষ্টবেঙ্গল ক্লাবগুলো আইএসএলে যোগদান করেছে। গোয়ার ডেম্পো স্পোর্টস ও চার্চিল ব্রার্দাস ছাড়া জাতীয় লিগ বা আইলিগের সাবেকি দল হিসেবে আইলিগে আর কেউ রইলোনা। আইলিগের প্রতিষ্ঠিত দলগুলো এখন আইএসএলের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। গতকালের সল্টলেক স্টেডিয়ামের ৬০হাজারে উপস্হিতি এখন আইএসএল লিগের বেঁচে থাকার শেষ খড়কুটো বলা যায়।

কিন্তু জাতীয় লিগ থেকে আইএসএলের এই দীর্ঘ প্রায় ৩০বছরের মধ্যে ভারতীয় ফুটবল এখন কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে? ভারতীয় ফুটবল দলের ফিফা র্যাঙ্কিং এখন ১২৬তম স্হানে আছে। সদ্য বিশ্বকাপের দ্ধিতীয় রাউন্ড থেকে তারা বিদায় নিয়েছে। তৃতীয় রাউন্ডে যাওয়া সুর্বনসুযোগ থাকা সত্বেও আফগানিস্তানের মত দুর্বল দলের কাছে পরাজিত হয়ে সেই সুযোগ হারাতে হয়েছে। সিনিয়র দলের মত জুনিয়র অনূর্ধ-২০ দল এশিয়ান কাপের গ্রুপস্টেজ থেকে বিদায় নিয়েছে। এমনকি তারা সাফ গেমসের মত দুর্বল টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গেছিল।সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন ফিফার গাইডলাইন তো দূরের কথা, এখন এএফসির গাইডলাইন সঠিকভাবে মানেনা। আইএসএলে অবনমন চালু করতে পারেনি। আইলিগের দ্ধিতীয় বিভাগ ও তৃতীয় বিভাগের রুপরেখায় প্রতিনিয়ত বদল এনেও সঠিক কাঠামো দিতে পারছে না। সংস্হার ভিতর অন্ত:কলহ লেগেই রয়েছে। সংস্হার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। বিভিন্ন রাজ্য ফুটবল নিয়মক সংস্হার প্রতি সঠিক বোঝাপড়া নেই। সর্বভারতীয় জুনিয়র লিগ প্রচণ্ড গরমের মধ্যে খেলতে বাধ্য করা হচ্ছে। প্রতিভাবান ফুটবলারদের বাছাই করে উপযুক্ত ট্রেনিং দেওয়ার নিজস্ব পরিকাঠামোর সঠিকভাবে ব্যবহারে তাগিদ নেই। এককথায় ভারতীয় ফুটবলের ৩০বছর আগে যে তিমিরে ছিল,এখনও সেখানেই আছে।