ফুটবল অনেক দিয়েছে তাঁকে, এবার ফুটবলকেও কিছু ফিরিয়ে দিতে চান সত্যজিৎ

মনে পড়ে কি আমায়?

স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায়

টুর্নামেন্টটা এয়ারলাইন্স কাপ৷ হয়েছিল সম্ভবত হলদিয়ায়৷ এভাররেডি বনাম মহামেডান স্পোর্টিং৷ দল জিতছে দু গোলে৷ দল মানে এভাররেডি৷ এখনকার ইউনাইটেড স্পোর্টস৷ সত্তর মিনিটের মাথায় কোচ আমল দত্ত তুলে নিলেন তাঁর নির্ভরযোগ্য ফুটবলারটিকে৷ এবং ম্যাচের শেষে সোজা বলেদিলেন– এরকম খেললে আবার গ্রামেই ফিরে গিয়ে বসে থাকতে হবে৷ সত্তর মিনিটে তুলে নেওয়ায় একেই মানিসিকভাবে হতাশ ফুটবলারটি একদমই ভেঙে পড়লেন৷ তাহলে কি আমি এতই খারাপ খেলছি? অমল দত্ত — পত্নী সেদিন স্নেহস্পর্শ দিয়ে বলেছিলেন, যাকে ভালোবাসে মানুষটা তাকেই অমন করে বলে৷ তুই ভেঙে পড়িস না৷ তাও মনের মেঘ সরেনি ছেলেটির৷ সেমিফাইনাল ছিল টালিগঞ্জ অগ্রগামীর সঙ্গে৷ প্রথম টিমে ছেলেটিকে রাখলেন না অমল দত্ত৷ হাফটাইম পর্যন্ত খেলা গোলশূন্য৷ তাকে নামালেন কোচ আর বললেন, যাও নিজেকে প্রমাণ করো৷ দু দুটো গোল করেছিল ছেলেটি৷ টিম সম্ভবত চার গোল দিয়েছিল৷ ছেলেটি ভেবেছিল কোচ প্রশংসায় ভরিয়ে দেবেন কিন্ত্ত সেই সব কিছুই হয়নি৷ তখন নিজের প্লেয়ারদেরকে গোল প্রতি একশ টাকা করে দিতেন বাগুইআটির বিদগ্ধ কোচ৷ ম্যান অফ দা ম্যাচ হলেও একশ৷ ছেলেটির প্রাপ্য তিনশ টাকা তাকে ধরিয়ে দিয়ে শুধু বলেছিলেন, ঠিক আছে৷ ছেলেটি হতাশ হয়েছিল৷ এত ভাল খেলার পরেও শুধু ঠিক আছে! পরের দিন কাগজে কিন্ত্ত ছেলেটির প্রশংসায় ভরিয়ে দেন পিকে ব্যানার্জীর চির — প্রতিদ্বন্দ্বী৷


১৯৯৪– ৯৫ এ মিলন সমিতি দিয়ে গড়ের মাঠে যাত্রা শুরু আর ২০১৫ তে জর্জ টেলিগ্রাফ খেলে যাত্রা শেষ৷ লম্বা সফর৷ এবং এই লম্বা সফরে বারবার খবরের কাগজের শিরোনামে উঠে এসেছেন জয়নগর– মজিলপুর এক্সপ্রেস সত্যজিৎ বসু৷ মোহনবাগানে এক বছর, মহামেডানে দু দফায় মিলিয়ে বছর পাঁচেক৷ এ ছাড়াও এভাররেডি, জর্জ টেলিগ্রাফ, ভবানীপুর, এরিয়ান৷ যেখানেই খেলেছেন গোল করেছেন৷ রাইট উইং বা রাইট হাফ যেখানেই খেলেছেন গোলের অভ্যাস ছাড়েননি৷ তাঁর গোলে মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল হেরেছে৷ ম্যাচ ড্র হয়েছে অনেক সময়৷ বাবা, দাদাদের খেলতে দেখে উৎসাহিত হয়ে খেলা শুরু৷ জে এম ট্রেনিং স্কুলের মাঠে৷ মজিলপুর অ্যাথলেটিক থেকে জেলা ফুটবল৷ বাবার অদম্য উৎসাহ ছিল৷ একবার টনসিল অপারেশন করে এসে দু একদিন পরেই নেমে পড়েছিলেন ম্যাচ খেলতে৷ বাবার কানে কেউ তুলে দিয়েছিল কথাটা৷ বাবা বলছিলেন, কী আর হবে? বড়জোর আরেকবার হসপিটালে ভর্তি হতে হবে৷ তা বলে কি ফুটবল খেলবে না?

ধ্রুবদা, অর্ণব মুখার্জী, মিলন সমিতিতে এসে পরিদা, দীপুদা, বিপ্লব দা৷ সত্যজিৎ বসুর কলকাতা মাঠে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে অনেকের অবদান৷ শিলিগুড়ি সাই হয়ে মিলন সমিতি৷ আত্মীয়র থেকে টাকা ধার নিয়ে শিলিগুড়ি যাওয়ার দিনগুলো ভোলেননি সত্যজিৎ৷ মিলন সমিতি থেকে এফ সি আই৷ সেখান থেকে এভাররেডি৷ সেখানেই অমল দত্তের অফুরান ভালবাসা পেয়েছেন৷ বিধাননগরে প্র্যাক্টিসের শেষে গাড়িতে সত্যজিৎকে উল্টোডাঙায় নামিয়ে দিয়ে যেতেন অমল দত্ত৷ খুব ভালবাসতেন সত্যজিৎকে তিনি৷

আরেকজন সুভাষ ভৌমিক৷ তাঁর অফুরান স্নেহও পেয়েছেন৷ সাব্বির আলি, অলোক মুখার্জী, বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য, রঘু নন্দী– যাঁর কোচিংয়েই খেলেছেন, কোচেদের ভরসার পাত্র হয়ে উঠতে পেরেছেন বারবার৷ আই লিগে মহামেডানের অবনমন বাঁচানোর গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তাঁরও গোল ছিল, এরিক আর প্যাট্রিকের পাশাপাশি৷ তার আগেই মোহনবাগানে সই করেছেন পরের মরশুমের জন্য৷ সে খবর জেনে গিয়েছিলেন কোচ সুভাষ ভৌমিক৷ কাগজে বেরিয়ে গিয়েছিল সে খবর৷ নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ ছিল সে ম্যাচে৷ এবং করেছিলেন৷ মহামেডান স্পোর্টিংয়ে যখন অনবদ্য খেলছেন তখন জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল৷ কিন্ত্ত কোনো অজ্ঞাত কারণে ডাক পাননি৷ মহামেডান অফিসিয়ালরা তাঁর হয়ে খুব লড়াই করেছিলেন এটা ভোলেননি সত্যজিৎ৷

মোহনবাগানে মাত্রই এক বছর৷ পোর্ট ম্যাচে অক্ষয় দাসের ট্যাকলে চোট পাওয়ায় তিন — চার মাস বাইরে ছিলেন৷ সেখানেও গোল করেছেন অবশ্য৷ মোহনবাগানে যাওয়াটাও নাটকীয় ছিল৷ মহামেডানের প্র্যাক্টিস সেরে ধর্মতলা দিয়ে হাঁটছেন একদিন৷ দেবাশিস দত্তর ফোন এসেছিল৷ কালো স্করপিও তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল দেবাশিস দত্তর অফিসে৷ সেই বছর ইস্টবেঙ্গলও যোগাযোগ করে৷ কিন্ত্ত তার আগেই মোহনবাগানে সই করা হয়ে গেছে তাঁর৷ দেবজিৎ ঘোষের কোচিংয়ে ভবানীপুরের হয়েও খেলেছেন ডগলাস, দীপেন্দু বিশ্বাস, মার্কোসদের সঙ্গে৷ রেলে চাকরির অফার পেয়েও যাননি, সে খবর কাগজের পাতায় উঠেছিল৷ পরে অবশ্য সি ই এস সি — তে চাকরি পান৷ ডি লাইসেন্স করে আপাতত ফুটবলকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন সত্যজিৎ৷ কারণ ফুটবল তাঁকে অনেককিছু ফিরিয়ে দিয়েছে৷ বারুইপুর নিউ ইন্ডিয়া অ্যাকাডেমি, অ্যারোস ইন্ডিয়া, সি ই এস সি — বিভিন্ন জায়গাতেই কোচিংয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন৷

বারুইপুরের অ্যাকাডেমি থেকে নতুন ছেলে কলকাতা ফুটবলকে ফুটবলার সাপ্লাই করার স্বপ্ন দেখেন৷
ডগলাসের মাথার ওপর দিয়ে অনবদ্য গোল করেছিলেন একটা৷ অনেকটা উঁচুতে উঠে৷ কিন্ত্ত ফুটবলার জীবনে আরোই উঁচুতে উঠতেই পারতেন সত্যজিৎ৷ সে প্রতিভা ছিল জয়নগরের ছেলের৷ কর্নার কিক স্পেশালিস্ট ছিলেন৷ রঘু নন্দী অসুস্থ হয়ে পড়ায় কোচ হয়ে এসেছেন রঞ্জন ভট্টাচার্য৷ সালটা সম্ভবত ২০১৫৷ জর্জ টেলিগ্রাফ৷ খেলতে অনুরোধ করেছিলেন সত্যজিৎকে৷ খেলেননি আর৷ ময়দানের বিভিন্ন অনভিপ্রেত ঘটনা তিক্ততা বাড়াচ্ছিল মনে৷ তাই সরে এসেছিলেন৷

একদম নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা৷ ফুটবল দু হাত ভরে দিয়েছে তাঁকে৷ এবার সত্যজিতের পালা ফুটবলকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার৷