রনজিৎ দাস
কলকাতা লিগের প্রথম থেকে রেফারিং নিয়ে যে অসন্তোষ শুরু হয়েছে,তা লিগের মাঝপথে এসে বিরক্তিকর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আজ ইষ্টবেঙ্গল এফসি ও পিয়ারলেস ক্লাবের ম্যাচেও রেফারিং নিয়ে অসন্তোষ দেখা গেলো। ম্যাচ শেষে পিয়ারলেসের কোচ হেমন্ত ডোরা রেফারির বিরুদ্ধে তার ক্ষোভ উগরে দেন। তাঁর কথায়, “ইষ্টবেঙ্গল এবার যথেষ্ট শক্তিশালী দল। এবং ওরা এবছর ভালো ফুটবল খেলেই লিগ টেবিলের শীর্শস্হানে আছে। এমন টিমের বিরুদ্ধেও কেন নিরপেক্ষভাবে ম্যাচ পরিচালনা করবেন না? আমাদের মতো তথাকথিত ছোটদল বড়টিমের বিরুদ্ধে ভালো ম্যাচ খেলার জন্য অপেক্ষায় থাকে। সেখানে কেন তাঁরা ভুল রেফারিংয়ের খেসারত দেবে?এতে কাদের লাভ হচ্ছে?”। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, প্রিমিয়ার লিগের শুরুতে ডায়মন্ড হারবার এফসির বিরুদ্ধে এরিয়ান ক্লাব ও সুরুচি সংঘ এমন খারাপ রেফারিংয়ের অভিযোগ এনেছিল।
প্রায় প্রতিদিনই একাধিক ম্যাচ শেষে বিভিন্ন টিমের কর্তারা তাঁদের অসন্তোষ জানিয়ে চলেছেন। কলকাতা প্রিমিয়ার লিগের খেলায় এই অসন্তোষ প্রকাশ্যে আসছে। কিন্তু খোলা মাঠের খেলায় এই অসন্তোষ কি আকার ধারণ করছে, তা সহজেই অনুমেয়। বছর বছর চলে আসা এই অসন্তোষের প্রতিকারের কোনও উদ্যেগ নেই। আইএফএ বা রেফারি সংস্হার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখা যায়।
আইএফএ খুব অল্প সময়ের মধ্যে লিগের খেলা শেষ করতে চায়। কিন্তু ৫ম বিভাগ থেকে প্রিমিয়ার ডিভিশন অবধি এত বিভাগের বিপুল সংখ্যার ম্যাচ পরিচালন করার মতো রেফারি কি রেফারি সংস্হায় নথিভুক্ত আছে? কিংবা একজন রেফারির একটা ম্যাচের পর আরেকটা ম্যাচের মধ্যে ম্যাচ পর্যালোচনার সুযোগ নেই বললেই চলে।রেফারি সংস্হার বর্ষীয়ান রেফারি জয়ন্ত ব্যানার্জি ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন,”শুধু রেফারিদের দোষ দিলে হবেনা। মাত্র ১১৩জন রেফারি নিয়ে এত ম্যাচ করানো যায়না। যথেষ্ট সংখ্যায় রেফারি নেই বলেই যোগ্যতা না থাকলেও রেফারিদের উপরের বিভাগের ম্যাচে পোষ্টিং দিতে হয়। এবার এই অল্প সংখ্যার রেফারিদের মধ্যে ম্যাচ ধরে ধরে বিশ্লেষণে রেফারিদের শাস্তি দিলে একেকদিন ম্যাচের জন্য প্রয়োজনীয় রেফারি পাওয়া যাবেনা। আর,শাস্তিমূলক ব্যবস্হা না থাকলে উপযুক্ত রেফারি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ফলে প্রতিবছরের শেষে ভালোমানের রেফারি বাছাই করা যাচ্ছে না।”
অথচ বাঙালি রেফারি হিসেবে প্রাঞ্জল ব্যানার্জি এএফসির মত আন্তর্জাতিক মানের ম্যাচ খেলিয়ে যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করেছেন। রেফারিরা তাঁদের জীবনের স্বপ্নকে যে কতদূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, প্রাঞ্জল ব্যানার্জি বাংলার রেফারিদের কাছে আর্দশ নিদর্শন বলা যায়। ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন এখন পেশাদার রেফারি নিয়োগের ব্যবস্হা করেছেন। আইএসএল ও আইলিগের ম্যাচ খেলিয়ে এখন ভালো অর্থ উপার্জন করা যায়।ফলত: রেফারিদের আর্থিক নিশ্চয়তা দিচ্ছে। এই প্রসঙ্গে প্রাক্তন রেফারি সুব্রত সরকার বলছিলেন,”হাঁ,আইএসএল ও আইলিগের ম্যাচ খেলানোর জন্য এখন অনেক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। আগের থেকে রেফারিদের স্ট্যাটাস বেড়েছে। কিন্তু প্রত্যাশিতভাবে রেফারিং-এর মান বাড়েনি। এখানে কেবল রেফারিদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। রেফারিরা কি ধারাবাহিকভাবে আধুনিক ট্রেনিং পান? আগের থেকে ভারতীয় ফুটবলে খেলার গতি বেড়েছে। তার সঙ্গে তাল রাখতে তো উপযুক্ত ফিটনেস লেভেল চাই। তাছাড়া, আইএসএল ও আইলিগের ম্যাচ পরিচালনায় যোগ্যতার মাপকাঠি সঠিকভাবে মানতে হবে। অভিজ্ঞ রেফারিদের আরও ভালো ভালো ম্যাচ দিতে হবে।”
গ্যালারিতে বসে রেফারিদের নিয়ে কথা বলতে বলতেই প্রাক্তন রেফারি সুব্রতবাবু প্রিমিয়ার ডিভিশনের ম্যাচ দেখছিলেন।ম্যাচে রেফারি একটা সিদ্ধান্তে খটকা লাগতেই হাতের মোবাইলে ম্যাচটার ঐ মুহূর্তের রেকডিং ফুটেজটা দেখেনিলেন।মুখে অর্থবহ হাসি থাকলেও রেফারির সিদ্ধান্ত নিয়ে মুখ খোলেননি।
প্রিমিয়ার ডিভিশনের ম্যাচে রেফারিং নিয়ে ক্লাবকর্তাদের অসন্তোষের প্রসঙ্গে প্রাক্তন রেফারি জয়ন্ত ব্যানার্জি আরও বললেন,”প্রিমিয়ার লিগ তো আইএফএর সবোর্চ্চ লিগ।এই লিগের প্রতিটি ম্যাচে আরও কঠোর পরিকল্পনা নেওয়া উচিত।এখন ৪বছর রেফারিং করে ন্যাশনাল রেফারির তকমা পাওয়া যাচ্ছে।ফলে অভিজ্ঞতা এখানে মুখ্যভূমিকায় থাকছেনা।এখন এই রেফারিদের পরিচালনার ম্যাচ কমিশনার ও ম্যাচ অ্যাসেসরের আলাদা আলাদা ভূমিকা আছে।রেফারিদের ম্যাচ পরিচালনার প্রতিটি মুহূর্ত পর্যবেক্ষণের জন্য ম্যাচ অ্যাসেসরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।কিন্তু এখন তো ম্যাচ কমিশনার ও ম্যাচ অ্যাসেসরের কাজ মিলিয়ে দিয়ে একজনের উপর সব দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।ম্যাচ অর্গানাইজেশনর খুঁটিনাটি দেখভালের পর রেফারির ম্যাচ পরিচালনার উপর ফোকাস রাখা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।একজনের পক্ষে দুটোদিক দেখা সম্ভব নয়।এছাড়া এখন বহু জেলাজুড়ে খেলা হয়।রেফারিরা বিভিন্ন জায়গায় খেলিয়ে থাকে।ফলে সেন্ট্রাল জায়গায় সবার মিলিত হওয়ার সুযোগ নেই।ফলে কে কার ভুল ধরাবে?ঐ যে বললাম, এত কমসময়়ে এত ঘনঘন ম্যাচ খেলা হলে ভুলভ্রান্তি সংশোধনের পরিসর থাকেনা।”
কোনও গোল বা কার্ড দেখানো নিয়ে সবচাইতে বির্তক দেখা দেয়।কোন সিদ্ধান্ত সঠিক এবং কোন সিদ্ধান্ত সঠিক নয়–এর দ্ধিতীয়বার পর্যালোচনার সুযোগ যেখানে নেই সেখানে এত বির্তক থাকা স্বাভাবিক ঘটনা বলা যায়।এরসাথে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের কালোছায়া জড়িয়ে পড়ায় বির্তক আরও বেড়েছে।নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রাক্তন রেফির বললেন,”এখন কোভিডের পর প্রতি ম্যাচে উভয়দল ৫জন করে ফুটবলার পরিবর্তের সুযোগ পায়।এই পরিবর্তন দ্ধিতীয়হাফে কোচেরা নিয়ে থাকেন।ফলে ম্যাচের দ্ধিতীয়হাফে সংযোজিত সময় বেশি দেওয়া হয়।কিন্তু আইনের ফাঁকে এইসময় নিয়ে কোনো ছলচাতুরির ঘটনা ঘটতে থাকলে তার দায় কে নেবে?উদ্দেশ্যপূর্নভাবে কোনো কোনো রেফারি যুক্ত থাকতেই পারেন।কিন্তু তাদের বিষয়ে নির্দিষ্ট অভিযোগ জমা দেওয়ার ব্যবস্হা নিশ্চয়ই আছে।কিন্তু কত অভিযোগ জমা পড়লো এবং কি তার বিচার হবে তা রেফারি সংস্হা এককভাবে নিতে পারেনা।
আইএফএ ও রেফারি সংস্হার এই সমন্বয়ের অভাবে কলকাতা লিগের বিভিন্ন ম্যাচ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ চলছে।কিভাবে লিগের খেলা শেষ করা যায়–তা নিয়েই সবাই ব্যস্ত আছে।সুযোগ বুঝে ঘোলাজলে একশ্রেণী তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করে চলেছেন।নিজেদের স্বার্থে নিজেদের মত সিস্টেম গড়ে তুলে ফেলেছেন।রেফারিরা এই সিস্টেমের শিকার হয়ে পরেছেন।ফলে এত ম্যাচ নিয়ে বির্তকের সৃষ্টি হয়েছে।এই বির্তকের সঠিক বিচার না হওয়াতে বাংলার ফুটবল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।কলকাতা লিগের আকর্ষণ হারিয়ে যাচ্ছে।কলকাতা লিগে এখন বড়দলের খেলাতেও হাতেগোনা সমর্থক গ্যালারিতে উপস্হিত থাকছে।ঐতিহ্যের কলকাতা লিগ কি এভাবেই বির্তকের মাঝে ক্রমশঃ গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে?