মহেন্দ্র সিং ধোনি। অদ্ভুত একটা ক্রিকেটীয় চরিত্র। পনেরোটা বছরে বাইশ গজের মাঠে এক নাটকীয় গল্পকার। সাহসী ভূমিকায় নিজেকে প্রমাণ করা নয় দেশের সাফল্যেই শেষ কথা। কোনও কিছু পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নয়। তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্তে বিপক্ষ দলের কাছে ভয়ংকর হয়ে ওঠা। হোক না দুর্ধর্ষ দল। তাঁর বিপক্ষে লড়াই করবার আসল অস্ত্রটা কী হবে তা ধোনি ছাড়া আগাম কোনও সতীর্থ ক্রিকেটারা উপলব্ধি করতে পারতেন না।
এটাই বোধ হয় তাঁর জীবনের অন্য ঝলক। তাইতো বোনি অভিষেক ম্যাচ থেকে শেষদিন পর্যন্ত একই ধারায় কথা বলেছে। কোনদিনই রক্ষণাত্মক ভূমিকা নয়, আক্রমণাত্মক ব্যাটিং চালিয়ে বিপক্ষ দলের বোলারদের নাজেহাল করে ছেড়ে দিতেন। সেই দাপুটে অধিনায়ক ভারতীয় ক্রিকেট দলকে শিখরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে কাউকেই তোয়াক্কা করতেন না।
সপাটে খেলবার জন্যে তাঁর রণংদেহী মনোভাব মাঠকে উত্তাল করে রাখতো। তাই কোন গুঞ্জন নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা থেকে ব্যাটটা যেদিন সরিয়ে নিলেন, সেদিন কেউই অনুভব করতে পারেননি নাটকের শেষ দৃশ্যটা সবাইকে এমন ভাবে অবাক করে দেবে। সত্যি তাই।
স্বাধীনতা দিবস। ভারতের ৭৪ তম স্বাধীনতা দিবসে সন্ধ্যে ৭.২৯ মিনিটে সবার কাছে একটা বার্তা পৌঁছে গেল মহেন্দ্র সিং ধোনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। কেউ কোনও কিছু আঁচ করতে পারলেন না। হঠাই সব গুঞ্জনকে উড়িয়ে দিয়ে আবার ক্রিকেটের মহানায়ক হয়ে গেলেন ধোনি। ক্রিকেট ইতিহাসে একের পর এক ঘটনাবহুল দৃশ্যপট ধোনিকে আরও উজ্জ্বল করেছে।
ক্রিকেটের অধ্যায়টা শুরু করেছিলেন রান আউট দিয়ে। আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কেরিয়ারে শেষ ম্যাচটা রান আউট হয়ে প্যাভেলিয়নে ফেরত যান। অভিষেক ম্যাচ ২০০৪ সালে ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের বিপক্ষে। চট্টগ্রামের মাঠে খেলা। ওই ম্যাচে শূন্য রানে রান আউট। পার্টনার মহম্মদ কাইফের কলে রান নিতে ছোটেন ধোনি। কিন্তু উইকেটে পৌছানোর আগেই তাপস বৈশ্যর ছোঁড়া বল উইকেট রক্ষক খালেদ মাসুদের হাতে জমা পড়ে। অপেক্ষা না করেই স্ট্যাম্প ভেঙে দেন। ধোনি আউট।
আর ধোনির শেষ ম্যাচ ২০১৯ সালে বিশ্বকাপে। ম্যাঞ্চেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেমিফাইনাল ম্যাচ। বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়েও পঞ্চাশ রান করে সেদিন রান আউট হয়ে ধোনিকে প্যাভেলিয়নে যেতে হয়েছিল। একটা রোমাঞ্চকর পটভূমিকা। এক বর্ণময় চরিত্র মহেন্দ্র সিং ধোনি।
২০১৪ সালে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। তারপরে ২০১৯ সালে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে নীল জার্সি গায়ে শেষ বারের মতন মাঠে নামেন। তখন থেকেই নানারকম জল্পনা শোনা গিয়েছিল। তিনি কী আরও কিছুদিন উইকেটরক্ষক হিসেবে ভারতীয় দলের সঙ্গে মাঠে নামবেন? সব কিছু উড়িয়ে দিয়ে স্বাধীনতা দিবসে ব্যাট আর গ্লাভস তুলে রেখে সব গুঞ্জনে সিলমোহর দিলেন।
তবে তিনি এবারের আইপিএল ক্রিকেটে চেন্নাইয়ের হয়ে মাঠে নামবেন। আন্তর্জতিক থেকে আঞ্চলিক স্থানীয় ক্রিকেটে ধোনির সাফল্য একটা মাইলস্টোন। বিহার, পূর্বাঞ্চলীয় ও ঝাড়খন্ডের হয়ে মোট ১৩১ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। রান করেছেন ৭০৩৮। পূর্ব ভারত থেকে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে এমন রেকর্ড কার আছে তা কেউ বলতে পারবেন।
সারা বিশ্বে একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে ধোনি জিতেছেন আইসিসির সব ট্রফি। জিতেছেন ২০০৭ সালে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ২০১১ সালে একদিনের আন্তর্জাতিক বিশ্বকাপ। ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। এই কৃতিত্ব ধোনিকে অন্যভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়। ধোনির অধিনায়কত্বে ২০০৯ সালে ভারত প্রথমবারের জন্যে বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর পেয়েছিল। যা ৬০০ দিন পর্যন্ত অটুট ছিল। জিতেছেন দেশের মাটিতে ২১ টি টেস্ট যা ভারতীয় অধিনায়ক হিসেবে কারও নামের পাশে নেই।
ধোনি দুশোটি একদিনের ম্যাচ, ৬০ টি টেস্ট ও ৭২ টি টি টোয়েন্টি ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ ৩৩১ টি ম্যাচে তিনি ছিলেন দলনেতা, তাঁর নেতৃত্বে ছয়টি বহুদলীয় একদিনের ম্যাচে চারটিতে চ্যাম্পিয়ন। ৩৫০ টি একদিনের ম্যাচে ১০,৭৭৩ রান করেছেন। ৮৪ বার নট আউট থাকেন। উইকেটরক্ষক হিসেবে আন্তর্জাতিক ম্যাচে সর্বোচ্চ স্ট্যাম্পিংয়ের রেকর্ড।
আইপিএল ক্রিকেটেও সর্বাধিক ম্যাচে এখনও অধিনায়কত্বের রেকর্ডটি মহেন্দ্র সিং ধোনির পকেটে। তবে তাঁর ব্যাট থেকে যে হেলিকপ্টার শট যখন উড়ে আসতো তখন গ্যালারির দর্শকদের ‘মাহি, মাহি’ বলে গগনভেদি চিৎকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে থমকে গেল। ধোনির ঝলসে ওঠা চরিত্র সারা জীবন কথা বলবে।