চ্যাম্পিয়ন ডায়মন্ড হারবার এফসি

অসাধারণ পারফরম্যান্স দিয়ে আইলিগের তৃতীয় বিভাগে ডায়মন্ড হারবার এফসি চ্যাম্পিয়ান হলো। ফাইনালে তারা মিজোরামের চানমারি এফসিকে হারিয়ে দেয়। খেলার ২৯ মিনিটে মাঝমাঠের ফুটবলার রাঘব গুপ্তা একমাত্র জয়সূচক গোলটি করেন। বক্সের উপর থেকে নরহরি শ্রেষ্ঠা রাঘববের উদ্দেশে বল নামিয়ে দিলে দূরপাল্লার মাটিঘেঁষা শটে রাঘব গোলটি করেন। গ্রুপস্টেজ থেকেই ডায়মন্ড হারবার এফসি অসাধারণ পারফরম্যান্স করেন।

না, কোনও জাদুমন্ত্রে ডায়মন্ড হারবার এফসি এই সাফল্য পায়নি। লক্ষ্যে অবিচল থেকে কঠোর শৃঙ্খলা ও কঠোর পরিশ্রমের ফসল তারা তুলে নিল। ফাইনালের জয়ের আগেই তারা এই মরশুমেই আইলিগ-টু এ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে নিয়েছে। আইলিগ-২ থেকে এবার আইলিগে প্রমোশনের লড়াই তারা করবে। সেই লড়াইয়ের প্রতীক্ষায় বাঙালি ফুটবলপ্রেমীরা থাকবে।

ডায়মন্ড হারবার এফসির সাফল্য থেকে সকলের শিক্ষা নেওয়া উচিত– কিভাবে লক্ষ্যে অবিচল থাকতে হয়।
এবারের কলকাতা প্রিমিয়ার লিগে তারা গ্রুপ-এতে ছিল। ওই গ্রুপেই তাদের পারিবারিক পরিচিতির টিম হিসেবে কালিঘাট মিলন সংঘ ক্লাবও ছিল। লিগের শেষ পর্যায়ে এসে কালিঘাট এমএস যখন অবনমনের আওতায় পড়ার সম্ভবনায় ঘুরপাক খাচ্ছে, তখন ডায়মন্ড হারবারের সাথে তাদের খেলা পড়েছিল। ডায়মন্ড হারবারের থেকে ৩ পয়েন্ট পেলে কালিঘাট এমএস অবনমন থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু পারিবারিক সম্পর্কের উর্ধ্বে উঠে ডায়মন্ড হারবার এফসি কোনও ভালোবাসার ম্যাচ সেদিন খেলেনি। খেলায় তারা কালিঘাট এমএসকে হারিয়ে দেয়। ডায়মন্ড হারবার এফসি ৩ পয়েন্টটা দিতেই পারতো। কারন, সেই ম্যাচের আগে ৩ ম্যাচ বাকি থাকতেই তারা সুপার সিক্সে পৌঁছে গেছিল। শেষপর্যন্ত কালিঘাট এমএসকে অবনমনের ম্যাচ খেলতে হয়। কারন, লক্ষ্যে অবিচল থাকতে হবে। ডায়মন্ড হারবার এফসি কলকাতা লিগে চ্যাম্পিয়ান হতে চায়। চ্যাম্পিয়ানশিপের প্রতিটা পয়েন্ট যে তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শেষপর্যন্ত তারা লিগ চ্যাম্পিয়ান হতে পারবে কিনা তাও সময়ে উত্তর মিলবে।


আইলিগ-৩য় থেকে আইলিগ-২ এ প্রমোশন পেয়ে ডায়মন্ড হারবার কিন্তু অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে দিল।
কলকাতা লিগে কালিঘাট এমএস ও ডায়মন্ড হারবার এফসির এই মানসিকতা কেবল একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল এটা ভাবা ভুল হয়ে যাবে। ডায়মন্ড হারবার এফসির কর্তারা তাদের ফুটবলারদেও সেই সময় বিশেষ বার্তা দিয়ে দিয়েছিল। আমরা পেশাদারিত্ব নিয়ে আফসোস করে থাকি– কিন্তু হাতের সামনের দৃষ্টান্তগুলো নিয়ে চর্চা করি না। বাংলার ফুটবল এখন দারুণ ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। টাকা দিয়ে ফুটবলারেরা খেলা শেখে। আবার তাদের টাকার বিনিময়েই বিক্রি হতে হয়। এখন এই কেনাবেচায় বুদ্ধির জাহির চলছে। পাল্লা দিয়ে আবার ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ থাকছে।

অনেকেই ভ্রু কু়ঁচকে বলবে– টাকা থাকলে এমন সাফল্য পাওয়াই যায়। ভবানীপুর ক্লাবের তো টাকা কম নেই, ওরা গতবছর ডায়মন্ড হারবারের সাথে আইলিগ অভিযান শুরু করেও তবে পিছিয়ে পড়লো কেন? ক্লাব প্রশাসনেও পেশাদারিত্ব চাই। ভবানীপুর ক্লাব গতবছর প্রস্তুতির সঠিকসময়ে ফোকাস নষ্ট করে, তাদের কোচকে বাংলার সন্তোষ ট্রফির দলের জন্য ছেড়ে দিল। সেই কোচের জন্য বাংলাদল ও ভবানীপুর ক্লাব দু’জনেই ডুবল। এবছর আইলিগ-টুয়ে ৪টে দল প্রমোশন পাচ্ছে। ভবানীপুর ক্লাবের কর্তাদের এখন আফসোস হচ্ছেনা?

অনেকেই আবার বাহুবলের কথা বলবেন। আইলিগ-৩য় ডায়মন্ড হারবার এফসি গ্রুপ পর্যায়ে ৪টে ম্যাচ ও ফাইনাল রাউন্ডের ৩টে ম্যাচ খেললো। নৈহাটি স্টেডিয়ামে ঢাকঢোল নিয়ে কতজন বাহুবলী মাঠে ছিল? ডায়মন্ড হারবার তো প্রতি ম্যাচেই গ্যালারি ভরিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখলাম? তাদের ক্লাবের বেশকিছু সদস্য নিশ্চয়ই মাঠে থেকেছে। কিন্তু ৩৮-৩৯ ডিগ্রি তাপমাত্রায় প্রাক্তন রেফারি কাশিনাথ সেন গলা ফাটিয়ে টিমকে উৎসাহ করে যাচ্ছে। সঙ্গে, খাতায় অঙ্কের হিসেব নিকেষ এবং হাতেগোনা তাদের কয়েকজন সমর্থক। পরিকল্পিতভাবে টিম পরিচালনা এক অসাধারণ কৌশল হিসেবে কাজ করে। কাজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হয়। কোচের প্রতি বিশ্বাস, প্লেয়ারদের প্রতি বিশ্বাস এবং স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া এই সাফল্য আসেনা।

একবছর আগে ডায়মন্ড হারবারের ফুটবলার জবি জাষ্টিন ভবানীপুরের হয়ে কলকাতা লিগে খেলেছিল। সেই জবি জাষ্টিন ও বর্তমান ডায়মন্ড হারবারের জবির পার্থক্য বোঝা যাচ্ছে? এবারের কলকাতা লিগের প্রিমিয়ারের শুরুর ৮-৯টা ম্যাচ নরহরি শ্রেষ্ঠা ডায়মন্ড হারবার এফসির প্রথম একাদশের ছিল না। এখন, আইলিগ-৩’র ডায়মন্ড হারবার টিমের প্রথম একাদশে নরহরি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে এবং প্রতি ম্যাচেই গোল করে চলেছে। ৮ ম্যাচে ইতিমধ্যে মধ্যে তার গোলসংখ্যা ৮! মাঝমাঠের আইমর এ্যডাম গতমরশুমে আইলিগ-টুতে মহারাষ্ট্রের দ্য অরেঞ্জ এফসিতে খেলেছিল। কতজন তাকে চিনতো? মহারাষ্ট্রের গিরিক খোলসার কিছু পরিচিতি থাকলেও দিল্লির মোহিত মিত্তালের কি বাজারদর ছিল? ভিন্নরাজ্যের প্লেয়ার ছেড়ে বাংলার ছেলেদের দিকে তাকান– শুস্নাত মাল্লিক, সুব্রত সাঁতরা, অয়ন মন্ডল, রবিলাল মান্ডি, শুপ্রদীপ হাজরা, রাহুল পাসোয়ান,সুপ্রিয় পন্ডিতরা তো কলকাতা লিগ থেকেই টিমের নিয়মিত সদস্য। ডায়মন্ড হারবার কোচ কিবু ভিকুনা এই মরশুমে ৩৮ জন ফুটবলারকে খেলিয়ে দিলেন। কিন্তু টিমটার মূলঅংশ হিসেবে ১৮-১৯ জন ফুটবলারকে দারুণভাবে তৈরি করে নিলেন।

কিন্তু সুযোগ পেলেই সবাই সেরাটা দিচ্ছে। যেমন, গোলকিপার সুব্রত সাঁতরা– লিগের একটাও ম্যাচে প্রথম একাদশে থাকেনি। কিন্তু আইলিগের-৩য় গ্রুপস্টেজে অসাধারণ খেলে দিল। প্রথম ম্যাচ ডায়মন্ড ৩-০ গোলে জিতেছে। কিন্তু সুব্রত ঐ ম্যাচে অপ্রতিরোধ্য ছিল। মাঝমাঠে শুপ্রদীপ মারাত্মক ভুল ব্যাকপাস করে টিমকে গোল খাইয়ে দিল। টিম স্পোর্টস উড়িষ্যার কাছে হেরে গেল। কিন্তু শুপ্রদীপ পরবর্তী সময়ে মাঝমাঠে নিয়মিত অসাধারণ খেললো। টিমের রক্ষণ, মাঝমাঠ ও আক্রমণভাব দারুণ সামঞ্জস্য ও ধারাবাহিকতা দেখাল। যেমন, কলকাতা লিগে ডায়মন্ড হারবার ১৫ ম্যাচে ৩৯টা গোল করেছে। তার মধ্যে ৩২টা গোল জবি(১০), নরহরি(৭), রাহুল(৬), গিরিক(৫), আইমার(৪) গোল করেছে। আক্রমণভাগের ৫জন খেলোয়াড়রাই পাল্লা দিয়ে গোল করেছে। আবার এদের আইলিগের আপাততঃ পারফরম্যান্স কেমন? ডায়মন্ড হারবার এফসি আইলিগের ৯ ম্যাচে ২৩টা গোল করেছে। এই ২৩টা গোলের মধ্যে জবি ও নরিরাই ১৯টা গোল করেছে। নরহরি(৮), আইমার(৫) এবং জবি, গিরিক ও সুপ্রিয় প্রত্যেকে ২টো করে গোল করেছে। কেবল রাহুল গোল পায়নি।
অপরদিকে, কলকাতা প্রিমিয়ার লিগে তারা ১৫টা ম্যাচের মধ্যে ৭টা ম্যাচে কোনও গোল খায়নি। ১৫টা ম্যাচে তাদের বিপক্ষে ৮টি গোল হয়েছে। একইভাবে আইলিগের তৃতীয় বিভাগে ৯ ম্যাচের মধ্যে ৬টা ম্যাচেই তাদের বিপক্ষে প্রতিপক্ষ দল কোনও গোল করতে পারেনি। ৯ম্যাচে তারা মাত্র ৫টা গোল খেয়েছে। কলকাতা প্রিমিয়ার লিগে ১৫টা ম্যাচের মধ্যে তারা ৩টে ম্যাচ ড্র করলেও একটাও ম্যাচ হারেনি। আইলিগের তৃতীয় বিভাগে ৯টা ম্যাচের মধ্যে মাত্র ১টা ম্যাচ তারা হেরেছে। অর্থাৎ কলকাতা লিগ ও আইলিগ মিলে ডায়মন্ড হারবার এফসি ৩৪টা ম্যাচ খেলে মাত্র ১টা ম্যাচ হেরেছে এবং এই ৩৪টা ম্যাচ খেলে তারা ৬২টা গোল করেছে। সবমিলিয়ে ডায়মন্ড হারবার এফসি সাড়ে তিনমাসে দারুণ ধারাবাহিকতা দেখিয়েছে। এর ফাঁকেই প্রয়োজনীয় খেলোয়াড়দের টিমে সংযোজন করেছে। যেমন, আর্মি দল থেকে লিটন শীল,সুনীল বি, পিন্টু মাহাতো উল্লেখযোগ্য নাম বলা যায়।

প্রতিদিনকার কঠোর পরিশ্রম ও ফুটবল চর্চাতেই টিমের এমন সাফল্য। বিগত সাড়ে তিন মাসেমাসে বিভিন্ন টুর্নামেন্টের ৩৪টা ম্যাচ খেলে তারা মাত্র ১টা ম্যাচ হারাতে, টিমের ফোকাস কোন পর্যায়ে ছিল- সহজেই অনুমেয়। এখানে হঠাৎ ৪-৫টা ম্যাচের অপ্রত্যাশিত ফলাফল নেই।

কোচ কিবু ভিকুনা এর আগে মোহনবাগানকে আইলিগ চ্যাম্পিয়ান করেছেন। গত তিনবছর ডায়মন্ড হারবার এফসিকে কলকাতা প্রথম বিভাগ থেকে প্রিমিয়ার ডিভিশনে তুলেছেন। এবার আইলিগের তৃতীয় বিভাগে তিনি ডায়মন্ড হারবার এফসিকে চ্যাম্পিয়ান করলেন।

এরপর তারা কলকাতা লিগের চ্যাম্পিয়ানশিপের লক্ষ্যে বাকি ম্যাচগুলো খেলবে। তারপর ২মাসের বিরতির পর আবার আইলিগ-টু ম্যাচ খেলতে নামবে। বাংলার ফুটবলপ্রেমীরা আশা করে ওরা ধারাবাহিকতা বজায় রেখে আইলিগ-টুতে ভালো ফল করে প্রমোশন পাবে।