সন্তোষ ট্রফির সাফল্যকে ধরে রাখতে হবে বাংলাকে : অমলরাজ

ফাইল চিত্র

হায়দ্রাবাদ শহরে বাংলার সন্তোষ ট্রফি জয়–আপনার অনুভূতি
অমলরাজ : হায়দ্রাবাদ ও বাংলা দুটোই আমার প্রানের শহর। আমি এদের কখনো ভুলতে পারবো না। হায়দ্রাবাদ আমার জন্মস্থান, ফুটবলের হাতেখড়ি কিন্তু কলকাতা শহরে আমি ফুটবলার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছি। কলকাতার তিন বড়দলেই আমি খেলেছি, অধিনায়কত্ব করেছি, বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফি জিতেছি, কলকাতা থেকেই ভারতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়েছি, ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব করেছি। কলকাতা শহরেই চাকরি করেছি। বাংলার সন্তোষ ট্রফি জয়ে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি।

সন্তোষ ট্রফির অনেক ম্যাচেই আপনাকে দেখা গেছে। বাংলা দলের খেলা দেখলেন। এই বাংলা দলের কারা ভারতীয় দলে খেলার যোগ্য বলে মনে হয়?
অমলরাজ : বাংলা দলের খেলা দেখেছি, ম্যাচ জেতার পর ড্রেসিংরুমে ওদের সাথে দেখা করেছি। বাংলা দল ভালো খেলেছে বলেই তো সন্তোষ ট্রফি জিতেছে। বাংলা দলের খেলায় অনেক ভেরিয়েশন দেখা গেছে। ম্যাচ বাই ম্যাচ ওদের প্ল্যানিং অন্যান্য দল থেকে অনেক বেটার ছিল। বাংলা দলে অনেক প্রতিভাবান ফুটবলারও আছে। কিন্তু সন্তোষ ট্রফি খেলে সরাসরি ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক ধাপ আছে। সেই ধাপগুলোতে উত্তীর্ন হলেই ভারতীয় দলে সুযোগ মিলবে। ভারতীয় দলের ফুটবলাররা আগে সন্তোষ ট্রফিতে খেলতো। সেসময় ভারতীয় দলের ফুটবলারদের সঙ্গে লড়াই করে অনেক জুনিয়র ফুটবলার নিজেদের প্রতিভা দেখানোর সুযোগ পেতো। আইএসএল ও আইলিগ চালু হয়ে যাওয়ার পরে ভারতীয় দলের ফুটবলাররা এখন সন্তোষ ট্রফিতে অংশগ্রহণ করেনা। ফলে সন্তোষ ট্রফি থেকে সরাসরি ভারতীয় দলের সুযোগ পাওয়া কঠিন আছে।

ফুটবলারদের তাহলে কোন ধাপগুলো টপকাতে হবে?
অমলরাজ : সন্তোষ ট্রফি ঐতিহ্যের রাজ্য চ্যাম্পিয়নশিপের টুর্নামেন্ট হলেও–এটা অ্যামেচার টুর্নামেন্ট। সন্তোষ ট্রফির ফুটবলারদের ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার আগে আইএসএল ও আই লিগে খেলা ভারতীয় ফুটবলারদের সঙ্গে কম্পিটিশন করতে হবে। যেমন, বাংলা দলের অধিনায়ক চাক্কু মান্ডি শুনেছি ইস্টবেঙ্গলের রিজার্ভ টিমের ফুটবলার। এখন চাক্কু মান্ডিকে আগে ইস্টবেঙ্গলের আইএসএলের টিমে নিজের জায়গা করে নিতে হবে। রবি হাঁসদাকেও মহামেডান টিমে নিজের জায়গা করে নিতে হবে। এগুলোই হচ্ছে ভারতীয় দলে জায়গা পাওয়ার বিভিন্ন ধাপ, যেখানে ভারতীয় দলের যোগ্য ফুটবলার হিসেবে নিজেকে চেনাতে হবে।


বাংলা দলের কোচ অভিযোগ করেছেন যে, সন্তোষ ট্রফির ফাইনাল রাউন্ডে অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের পক্ষ থেকে কোন অবজারভার বা স্কাউটরা ছিলেন না। যারা ট্যালেন্টেড ফুটবলারদের বাছাই করবে।
অমলরাজ : আমি জানিনা কে কি বলেছেন। তবে, আমি ও সাব্বির আলি তো অবজারভার ছিলামই, এছাড়াও নর্থ ইস্ট, ব্যাঙ্গালোর থেকেও স্কাউটরা ছিল। সব ট্যালেন্টেড প্লেয়ারদের ডাটা তৈরি করা হচ্ছে। সন্তোষ ট্রফিতে যারা ভালো খেলেছে তাদের নোট আছে। ওই সব ট্যালেন্টেড প্লেয়াররা আগে কেমন খেলেছে তার ডাটা সংগ্রহ করা হচ্ছে। সন্তোষ ট্রফির পরে এই প্লেয়াররা কোথায় কিরকম পারফরম্যান্স করছে তার ডাটাও রাখা হবে। এর ভিত্তিতেই প্লেয়ারদেরকে ভারতীয় দলের বিভিন্ন পর্যায়ে ডাকা হয়। আমি তো এখনই বলে দিচ্ছি, আপনাদের সন্তোষ ট্রফি বাংলা দলের ২০০৩-০৪ জন্ম তারিখের যে প্লেয়াররা আছে, তাদের নাম নিশ্চয়ই বয়সভিত্তিক ভারতীয় দলের জন্য বিবেচিত হবে। ওই যে বললাম, ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার বিভিন্ন প্রসেস আছে। সেই প্রসেসে নিজেদের যোগ্যতাকে প্রমাণ করতে হবে। তাই বলছি, সন্তোষ ট্রফিতে যারা বাংলা দলের হয়ে ভালো পারফরম্যান্স করেছে, তারা পরবর্তী সময় যে যে টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করবে– তাদেরকে সন্তোষ ট্রফির এই পারফরম্যান্সকে ধরে রাখতে হবে।

বাংলা দলের কোচ বলেছেন, ১৮ দিনের বাংলা দলকে ৮টা ম্যাচ খেলতে হয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর বছরের শেষ দিনের সন্ধ্যাতেও বাংলা দলকে খেলতে হয়েছে। অবৈজ্ঞানিক এই সূচিতে তো ক্ষোভ হবেই.…
অমলরাজ : ফেডারেশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি কোন মন্তব্য করতে পারিনা। তবে আমার যা মনে হয়েছে, যে স্টাডি আছে তাতে, স্পোর্টস ক্যালেন্ডার অনুযায়ী টুর্নামেন্ট হচ্ছে। আমার মনে হয়, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে খেলা শেষ করতে হয়েছে। কারণ, জানুয়ারি মাস থেকে ট্রান্সফার উইন্ডো শুরু হবে– ট্যালেন্টেড প্লেয়াররা যাতে জানুয়ারির ট্রান্সফার উইন্ডোকে কাজে লাগাতে পারে, সেদিকটা দেখা হয়েছে। সন্তোষ ট্রফির আগে আইলিগ থ্রি’র খেলা হয়েছে। এরপর আইলিগ-২য়ের খেলা হবে। আইলিগ থ্রি’র অনেক ফুটবলার সন্তোষ ট্রফিতে অংশগ্রহণ করেছে। অনেক ফুটবলার এরপর আইলিগ-২য়ে খেলবে। বিভিন্ন রাজ্যের লিগের সাথে এই সমস্ত সর্বভারতীয় টুর্নামেন্টগুলোকে এডজাস্ট করিয়েই খেলা হচ্ছে। ফলে সমস্যা তো আছেই। ১৮ দিনে ৫টা ম্যাচ হলে ভালো হতো, সেখানে ৮টা ম্যাচ হয়েছে, মানে তিনটে ম্যাচ বেশি হয়েছে। অ্যামেচার ফুটবলে এসব হয়। আমরা এই বিষয়টা নিয়ে অল ইন্ডিয়াকে নিশ্চয়ই প্রস্তাব দেবো।

আপনার কথা মেনে নিয়েও বলছি,ঐতিহ্যপূর্ণ এই সন্তোষ ট্রফিকে নিয়ে আরো ভালোভাবে প্ল্যানিং করা উচিত নয়? হঠাৎ চমক দিয়ে একবছর বিদেশে টুর্নামেন্টের আয়োজন হলো–অনেক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো, কিন্তু আবার সেই একই জায়গায় ফিরে আসা.…
অমলরাজ : ওই যে বললাম ফেডারেশনের বিষয়টা ফেডারেশন থেকে বলবে। তবে, প্লানিং তো আছেই। ফিফা ও এএফসির গাইডলাইন মেনে বয়সভিত্তিক প্রচুর টুর্নামেন্ট এখন হচ্ছে। জুনিয়ার ফুটবলার তুলে আনার বিভিন্ন প্ল্যানিংয়েই এখন এত খেলা হয়। সিনিয়র ফুটবলারদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সময়ে আইএসএল ও আই লিগ হচ্ছে। সিনিয়র থেকে জুনিয়র-সব পর্যায়ের টুর্নামেন্টের একই র‍্যাঙ্কিং রেখে সূচী করা সম্ভব? কখনো হয় না। আগে কত টুর্নামেন্ট হতো। দিল্লিতে ডুরান্ড ও ডিসিএম,বোম্বেতে রোভার্স কাপ, নর্থইস্টের বড়দৌলই, সিকিম গভর্নরস্, ব্যাঙ্গালোরে স্ট্যাফোর্ড কাপ, বাংলাতে আইএফএ শিল্ড ও দার্জিলিং গোল্ডকাপ–কত টুর্নামেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। আইএসএল ও আইলিগের পাশাপাশি এই টুর্নামেন্টগুলো করতে গেলে টুর্নামেন্টের মান অনেক নেমে যাচ্ছে। সন্তোষ ট্রফির ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। অবশ্য এতে জুনিয়র ফুটবলাররা খেলার সুযোগ পাচ্ছে। আইএসএল ও আই লিগের ফুটবলারদের নিয়ে সন্তোষ ট্রফ্রির দলগঠন করলে, তোমাদের এই বাংলা দলের ক’জন ফুটবলার সেই দলে সুযোগ পেতো? ফলে এখন সন্তোষ ট্রফিতে রাজ্যের জুনিয়র ফুটবলাররা তাদের পারফরম্যান্স করার সুযোগ পাচ্ছে। এই সমস্ত প্রতিভাবান ফুটবলাররা আইএসএল ও আইলিগে ভারতীয় দলের ফুটবলারদের সাথে কম্পিটিশন করবে, সেখান থেকে তারা পরবর্তী স্টেজে উঠে আসবে। এই জন্য বলছি নতুন সিস্টেমটাকে বুঝতে হবে।পুরনো মানসিকতায় পড়ে থাকলে চলবে না। অনেক ক্লাব উঠে গেলেও বিএফসি, কেরলা ব্লাস্টার্স, মুম্বাই সিটি এফসি,চেন্নাইয়ান এফসির মত টিম উঠে এসেছে। ডেম্পোর মত টিম আবার আইলিগে ফিরেছে। ভবিষ্যতের ভালোর জন্য আমাদের ভাবতে হবে। জুনিয়রদের প্রতি নজর দিতে হবে।

১৯৬৯-৭০ সালে চ্যাম্পিয়ন বাংলা দলের হয়ে মহম্মদ হাবিব ১১টা গোল করেছিলেন, এবার সন্তোষ ট্রফিতে বাংলার স্ট্রাইকার রবি হাঁসদা সেই রেকর্ড ভেঙ্গে দিলেন। হায়দ্রাবাদ ও বাংলার মেলবন্ধন কিভাবে দেখছেন…
অমলরাজ : ওটা গ্রেট ফাইনাল ছিল। হাবিবদা ফাইনালে পাঁচটা গোল করেছিলেন। বাংলা ৬-১ গোলে সার্ভিসেস কে হারিয়েছিল। তবে ফাইনালের আগে হাবিবদার সাথে প্রণব গাঙ্গুলী, বিমান লাহিড়ী– ওনারা অনেক গোল করেছিলেন। কিন্তু ফাইনালে হাবিবদা সবাইকে ছাপিয়ে যান। আমিও তো বাংলার হয়ে পাঁচবার সন্তোষ ট্রফিতে খেলেছি। ওফ, সেই সমস্ত দিনগুলো দারুন ছিল। বাংলাতে ভাস্কর গাঙ্গুলী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুব্রত ভটচার্য, প্রসূন ব্যানার্জি, প্রশান্ত ব্যানার্জি, বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য– কত গ্রেট ফুটবলার আছেন। বাংলার ছেলেদের এই সমস্ত ফুটবলারদের ফলো করা উচিত।

সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা দল ছাড়াও আর কোন কোন দলের খেলা আপনার ভালো লাগলো?
অমলরাজ : বাংলা ও কেরল দল টুর্ণামেন্টের সেরা দুটো দল ছিল। মনিপুর খুব ইয়াং সাইড। কিন্তু আমাকে জম্মু-কাশ্মীরের খেলা খুব অবাক করেছে। মডার্ন ফুটবলের নিয়ম অনুযায়ী পাসিং ফুটবল খেলতে দেখা গেল। ওদের খেলোয়াড়দের শারীরিক গঠনও বেশ ভালো ছিল।

বাংলার ফুটবলারদের জন্য আপনার কি পরামর্শ থাকবে।
অমলরাজ : আমি অরুনাচল প্রদেশে গতবারের সন্তোষ ট্রফির ফাইনাল ম্যাচ দেখেছি। বাংলা দলের ছেলেরা খুব ট্যালেন্টেড ছেলে আছে। বাংলায় একটা ফুটবল কালচার আছে। ছেলেদের বলবো ১০০% প্রফেশনাল হতে হবে। ছেলেদের ডিসিপ্লিন মেনে চলতে হবে এবং সন্তোষ ট্রফিতে যে পারফরম্যান্স করেছে সেটাকে ধরে রাখতে হবে।