পাশের মণিপুর রাজ্য যুব ফুটবলারদের সর্বভারতীয় স্তরে তুলে আনতে যে প্রক্রিয়া নিতে পারে, ঐতিহ্যের বাংলা সে পথে হাঁটতে পারে না। অথচ কলকাতা লিগের পঞ্চম ডিভিশন থেকে সেকেন্ড ডিভিশন পর্যন্ত বয়সভিত্তিক লিগ হয়। এই বয়সভিত্তিক লিগে ১০০-র বেশি ক্লাব অংশগ্রহণ করে। কয়েক হাজার যুব ফুটবলার লিগের প্রতিযোগিতায় খেলে থাকে। এরপরে প্রথম ডিভিশন ও প্রিমিয়ার ডিভিশনের লিগ হয়। এছাড়া এত বড় রাজ্যের প্রচুর জেলায় জেলা লিগ হয়। আন্তঃজেলা বয়সভিত্তিক ও সিনিয়র টুর্নামেন্ট হয়। কিন্তু বাংলার দলগঠনে কলকাতা লিগের বয়স ভিত্তিক ডিভিশন তো বটেই, জেলার লিগগুলোকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়না। কলকাতা লিগের সঙ্গে জেলা লিগেরও কোন সামঞ্জস্য নেই। ফলে বয়সভিত্তিক ডিভিশন থেকে যেরকম সঠিকভাবে প্লেয়ার বাংলা দলে সুযোগ পায়না, তেমনি জেলার ক্লাবগুলো থেকেও কোনো প্রতিভাবান ফুটবলার বাংলা দলে সুযোগ পায়না। প্রতিভাবান ফুটবলার তুলে আনার ক্ষেত্রে কলকাতা লিগ কিংবা জেলার লিগকে ঘিরে কোন পরিকল্পনা কোন স্তরেই নেই।
গতকাল সন্তোষ ট্রফিতে বাংলা ও মনিপুর ম্যাচ ছিল। মণিপুর দলে একঝাঁক অনূর্ধ্ব ২১ ও ২৩ এর ফুটবলারদের খেলতে দেখা গেল। পরে মনিপুর ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা সন্তোষ ট্রফিতে তাদের দলগঠন নিয়ে বললেন,আমাদের প্রিমিয়ার লিগ থেকে ডিস্ট্রিক্ট লিগ পর্যন্ত লিগের ওঠানামার ব্যবস্থা আছে। ফলে এক লিগের সাথে আরেক লিগের যথেষ্ট সমন্বয় বজায় থাকছে। দলগঠনেও এই সমন্বয়েকে কাজে লাগানো হয়। প্রিমিয়ার লিগ, স্টেট লিগ ও আমফা কাপ থেকে প্রথমে আলাদা আলাদা ভাবে প্লেয়ারদের ডাকা হয়। জেলার ক্লাবগুলো থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যায় প্লেয়ার পাঠাতে বলা হয়। প্রাথমিক ট্রায়ালের পর চূড়ান্ত পর্বের সিলেকশন শুরু হয়। তাছাড়া মনিপুরের বাইরের রাজ্যে যেসকল ফুটবলাররা বিভিন্ন ক্লাবে খেলে থাকে, তাদের থেকেও প্লেয়ার বাছাই করে এনে আমাদের রাজ্য দলে নেওয়া হয় এবং দলগঠনে জুনিয়র প্লেয়ারদের উপরে নজর দেওয়া হয়।
মনিপুরের স্টাইকার খুলাপ জাহির খান গত ম্যাচে বাংলার রক্ষণকে বেশ ঝামেলায় ফেলছিল। বয়স মাত্র ২০ ছুঁই ছুঁই জাহির মণিপুরের হয়ে এইবছরই স্বামী বিবেকানন্দ অনূর্ধ-২০ টুর্নামেন্ট খেলেছে। মনিপুর সেমিফাইনালে কর্ণাটকের কাছে হেরে স্বামী বিবেকানন্দ ফুটবল টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয়। বাংলা দলও স্বামী বিবেকানন্দ অনূর্ধ-২০ ফুটবল টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছেছিল। রাহুল নস্কর, শিভম মুন্ডারা বাংলার হয়ে দারুণ ফুটবল খেলেছিল। ওরা কিন্তু মণিপুরের জাহির খানের মতন সৌভাগ্যবান হ’ল না। বাংলার সন্তোষ ট্রফি দলে রাহুলদের জায়গা হয়নি। এই সন্তোষ ট্রফি খেলেই মোহনবাগান সুপার জায়েন্টসের মনভীর সিং, লিস্টন কোলাসোরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সন্তোষ ট্রফি খেলেই ওরা ভারতীয় অনূর্ধ-২৩ দলে সুযোগ পায়। এবারের বাংলা সন্তোষ ট্রফির দলের নিয়মিত ফুটবলারদের মধ্যে কেউ অনূর্ধ্ব-২৩র নয়।
এর জন্যই বাংলা থেকে পিভি বিষ্ণুরা বয়সভিত্তিক ভারতীয় দলে সুযোগ পায়। একসময় বাংলার সন্তোষ ট্রফির ফুটবলারদের নিজেদের দলে নিতে তিন বড়ক্লাবের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতো। বাংলা দল এবার সন্তোষ ট্রফিতে ভালো পারফরম্যান্স করছে। কিন্তু সামনের জানুয়ারির ট্রান্সফার উইন্ডোতে বাংলার সন্তোষ ট্রফির দল থেকে কতজন ফুটবলারকে নিয়ে তিন বড় ক্লাবের মধ্যে টানাহ্যাঁচড়া হবে? ভারতীয় দলের মতন বাংলার তিন বড়ক্লাব বাঙালি ফুটবলের প্রতি উদাসীনতা দেখাতে পারে কেন? সঠিকসময়ে জুনিয়র ফুটবলারদের তুলে আনার ক্ষেত্রে আইএফএর ব্যর্থতাই এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়। এর মধ্যে ক্লাব লেভেল থেকে লড়াই করে ভারতীয় জুনিয়র দলে ডাক পাওয়া ফুটবলাররাও বঞ্চনার শিকার হয়ে পড়ছে। বেঙ্গল ফুটবল একাডেমির একাধিক ফুটবলারের ক্ষেত্রে তো এমনটাই ঘটেছে। জুলফিকার গাজী, রাজ গাজী, ঠাকুরদাস হাজরা, শেখ সাইলরা তো এমনভাবে বঞ্চিত হয়েছে। আইএফএ কিংবা বাংলা থেকে এআইএফএফ-র প্রতিনিধিরা কেউ এ বিষয়ে বাংলার ফুটবলারদের নিয়ে লড়াই করেননা।
ক্লাব লেভেল থেকে সর্বভারতীয় স্তরে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভারতীয় দলে কিছুটা ডাক পাওয়ার সুযোগ থাকছে। কিন্তু রাজ্য দলের হয়ে সর্বভারতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। যার অন্যতম কারণ বাংলা দল গঠনের ক্ষেত্রে জুনিয়র ফুটবলারদের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়না। বয়সভিত্তিক কলকাতা লিগ চালু হলো বটে, কিন্তু বয়সভিত্তিক ফুটবলারদের প্রথম ডিভিশন ও প্রিমিয়ার ডিভিশনে কিভাবে খেলানো যায় তার কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। ফলতঃ বাংলা দলগঠনে জুনিয়র ফুটবলারদের নিয়ে চিন্তাভাবনা হয়না। প্রতি ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটছে। রাজ্য দলগঠনের ক্ষেত্রে কলকাতার একশ্রেণীর ক্লাবের অযাচিত হস্তক্ষেপ কাজ করে। মোদ্দাকথা চেনা গণ্ডির বাইরে দলগঠন করতে পারেনা বাংলা।