যশপ্রীত বুমরার বোলিং দাপটে অস্ট্রেলিয়া কোণঠাসা

পার্থে খেলার বিশেষ মুহূর্তে ভারতের যশপ্রীত বুমরাহ ও অস্ট্রেলিয়া।

একেই বলে চোখে চোখ রেখে লড়াই করা। ভারতীয় দলের অধিনায়ক যশপ্রীত বুমরার দাপটে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে প্যাট কামিন্সের অস্ট্রেলিয়া একেবারে চাপে। অনেকেই বলেছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ভারতীয় দল সেইভাবে নিজেদের প্রকাশ করতে পারবে না। সত্যিই কি তাই? তারপর যখন টসে জিতে ভারতীয় দল ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখনও হয়তো কেউ কেউ বাঁকা সুরে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা হয়তো উইকেট বিশেষজ্ঞ হতে পারেন। কিন্তু উইকেটের চরিত্র সম্বন্ধে তাঁরা আগাম কিছু উপলব্ধি করতে পারেননি। তাই প্রথম দিনেই ১৭টি উইকেট পড়ে গিয়েছে প্রথম টেস্ট ম্যাচে। এটা মনে রাখতে হবে, একদিনের ক্রিকেট নয়, ব্যাটসম্যানরা ঝড়ের গতিতে রান করার একটা প্রবণতা দেখাচ্ছে আবার প্রতিপক্ষ দলের বোলাররাও চেষ্টা করছেন ব্যাটসম্যানদের খুব তাড়াতাড়ি প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু সবার ভাবনাকে পিছনে ফেলে দিয়ে বোলারদেরই কৃতিত্বকে দেখতে পাওয়া গেল। ভারতীয় দল প্রথমে ব্যাট করতে নেমে প্রথম ইনিংসে ১৫০ রানে সবাই আউট হয়ে যান। তার প্রত্যুত্তরে বুক চিতিয়ে খেলার সাহস পাননি প্যাট কামিন্সের সতীর্থ ক্রিকেটাররা। তাঁদের স্কোর বোর্ডে দিনের শেষে দেখা গেল ৭ উইকেটে ৬৭ রান করেছে। খেলা যে জমে গেল তা নতুন করে বলার দরকার হয় না।

নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে হোয়াইট ওয়াশ টেস্ট সিরিজ হারা ভারতীয় দলকে অস্ট্রেলিয়া স্বাগত জানিয়েছে। হঠাৎ নয়। অধিনায়ক রোহিত শর্মা প্রথম টেস্ট খেলতে পারবেন না, তাও জানা ছিল। নিঃসন্দেহে কঠিন পরিস্থিতি। ভারতের ব্যাটিং তাকিয়ে ছিল বিরাট কোহলির দিকে। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ব্যাটসম্যান কোহলির সাফল্য আত্মবিশ্বাসী করেছিল গৌতম গম্ভীরদের। সেই বিরাটই নিরাশ করলেন। তবু দিনের শেষে ভাল কিছুর আশায় ভারতীয় শিবির। যশপ্রীত বুমরা ও মহম্মদ সিরাজদের দাপটে অস্ট্রেলিয়া শিবিরে কম্পন শুরু হয়ে গিয়েছে।

কোহলি নিজে কি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন? সম্ভবত না। রানে না-থাকা কোহলি স্টান্স বদলে নেমেছিলেন ব্যাট করতে। তাতেও রান এল না। ফর্মে ফেরার জন্য ব্যাটসম্যানরা অনেক সময় স্টান্স পরিবর্তন করেন। উইকেটের সামনে একটু অন্য ভাবে দাঁড়ান ব্যাট হাতে। অনেকে সুফল পেয়েছেন। কোহলিও রানে ফেরার জন্য অস্ট্রেলিয়া সফরে নিজের স্টান্স বদলেছেন। কোহলি ব্যাট করার সময় সাধারণত মিডল এবং অফ স্টাম্প পরিষ্কার দেখা যায়। শুক্রবার ব্যাট করার সময় তাঁর শুধু অফ স্টাম্প দেখা যাচ্ছিল। মিডল স্টাম্প চলে গিয়েছে পায়ের আড়ালে। কোহলির ডান পা থাকে পপিং ক্রিজ়ের লাইনের উপরে বা ঠিক বাইরে। কিন্তু এখানে কোহলি দাঁড়ালেন পপিং ক্রিজের বেশ খানিকটা বাইরে। ব্যাটিংয়ে এত কিছু বদলেও ব্যাটে রান এল না। করলেন ৫ রান। তাহলে কি আত্মবিশ্বাসের অভাব কোহলিকে ভাবাচ্ছে এখনও? ব্যাটিংয়ের সময় তো বটেই। ফিল্ডিংয়ের সময়ও। চনমনে থাকার চেষ্টা করলেও লাভ হচ্ছে না। দ্বিতীয় স্লিপে দাঁড়িয়ে বুমরার বলে মার্নাস লাবুশেনের ক্যাচ ধরেও ফেলে দিলেন। কঠিন ছিল না ক্যাচটি। সতীর্থেরা নিশ্চিত সাফল্যের আনন্দে মেতে উঠতেই কোহলি নিজেই শুকনো মুখে হাতের ইশারায় জানিয়ে দেন লাবুশেন আউট নন। পার্থ টেস্টে ভারতীয় দলের অধিনায়ক বুমরা নিজেও বিশ্বাস করতে পারেননি, কোহলি সহজ ক্যাচ ধরেও ফেলে দিয়েছেন।


এ বারের অস্ট্রেলিয়া সফরের শুরুতে ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষ শিবিরে লড়াই পৌঁছে দেওয়ার প্রধান কারিগর হতে পারতেন কোহলি। পারলেন না। রানে ফেরার তাড়নাই কোহলিকে সাফল্যের রাস্তায় ফিরতে দিল না। দ্রুত গতির উইকেটে অসি জোরে বোলারদের সুইং ভাঙতে গিয়ে পরিস্থিতি কঠিন করলেন বাউন্সের মুখে পড়ে। কোহলির পরিবর্তন সমর্থন করা যায় না। ক্রিজ় থেকে এগিয়ে দাঁড়ানোয় কোহলির পক্ষে উঁচুতে ওঠা বল সামলাতে সমস্যা হচ্ছে। বলের উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সময় কম পাচ্ছে। ক্রিজ় থেকে এগিয়ে দাঁড়ালে বল উপরের দিকে ওঠার সময় খেলতে হয়। পার্থের মতো বাউন্সি পিচে এটা সঠিক কৌশল নয়। আউটও হলেন কোহলি। উপরের দিকে ওঠার সময় বল কোহলির ব্যাটে ছুঁয়ে চলে যায় ফিল্ডারের হাতে। ক্রিজ়ের ভিতরে থাকলে বলটি সামলানোর সুযোগ পেতেন।

পার্থে প্রথম টেস্টের প্রথম দিন শুধুই ভারতের ব্যাটিং ব্যর্থতা। ৪৯.৪ ওভারে শেষ বুমরার দলের প্রথম ইনিংস। ঋষভ পন্থ (৩৭) এবং নীতীশ কুমার রেড্ডি (৪১) ছাড়া কেউ দাঁড়াতে পারলেন না। ওপেন করতে নামা লোকেশ রাহুলের (২৬) আউটের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন থাকল। বাকিরা ২২ গজের গতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলেন না। ১৫০ রানে শেষ হল ভারতের ইনিংস। বর্ডার-গাভাসকার ট্রফির প্রথম চার ঘণ্টাতেই কোণঠাসা ভারত। টস জিতে বুমরা কার ভরসায় প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকল। কোহলির মুখের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে বড় ভুল করেছেন। অধিনায়ক হিসাবে তাঁর কঠোর এবং বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। অধিনায়ক হিসাবে আরও সাহসী হওয়া দরকার ছিল। বিশেষ করে যে ম্যাচে নিয়মিত টপ অর্ডারের দু’জন ব্যাটসম্যান নেই।

ভারতের ইনিংসের শেষে বুমরার সিদ্ধান্তকে যতটা খারাপ দেখাচ্ছিল, দিনের শেষে ততটা খারাপ মনে হল না। মিচেল স্টার্ক, জশ হ্যাজলউড ও প্যাট কামিন্সরা অস্ট্রেলিয়াকে সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। দিনের শেষে বুমরা, হর্ষিত রানা ও মহম্মদ সিরাজদের পাল্টা আক্রমণে সেই সুবিধা ধরে রাখতে ব্যর্থ অস্ট্রেলিয়া। কোহলি সহজ ক্যাচ ফেলে না দিলে, আরও সুবিধাজনক জায়গায় থাকতে পারত ভারত। লাবুশেন ৫২ বল খেলে ২ রান করে আউট হলেন প্রায় শেষ বেলায়।

ভারতের জোরে বোলারদের বিরুদ্ধে অস্বস্তিতে থাকলেও মাটি কামড়ে পড়েছিলেন। রান করার ঝোঁক ছিল না তাঁর ইনিংসে। বলের পালিশ তুলে দ্রুত পুরনো করে ফেলাই যেন ছিল তাঁর লক্ষ্য। লাবুশেন সম্ভবত দ্বিতীয় দিন সকালের কথা মাথায় রেখে খেলছিলেন। সেই সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য উইকেট বাঁচিয়ে রাখতে হত অস্ট্রেলিয়াকে। পারলেন না উসমান খোয়াজা, স্টিভ স্মিথ এবং ট্র্যাভিস হেডরা। ফলে দিনের শেষে অস্ট্রেলিয়া প্রথম ইনিংসে ৭ উইকেটে ৬৭। এখনও ভারতের থেকে ৮৩ রানে পিছিয়ে অস্ট্রেলিয়া। আয়োজকদের পক্ষে সর্বোচ্চ রান অ্যালেক্স ক্যারের অপরাজিত ১৯। প্রথম দিনেই বোলারদের সঙ্গে বোলারদের লড়াইটা ক্রিকেট ইতিহাসে নতুন একটা অধ্যায় রচনা করল। তাই দ্বিতীয় দিনে খেলার ভাগ্য অনেকটাই বদলে যেতে পারে।

ভারতের বোলারদের মোকাবিলায় অস্ট্রেলিয়ার শেষ তিন ব্যাটসম্যান কী করে, সেটাই দেখার বিষয়। বোলারদের কাছে যেভাবে ব্যাটসম্যানরা আত্মসমর্পণ করছেন, তাতে এখনই জোর গলায় বলতে পারা যায়, টেস্ট ম্যাচ পাঁচদিনে গড়াবে না। যেমন অস্ট্রেলিয়ার হ্যাজলউড চারটি উইকেট নিয়েছেন, তেমনই ভারতের যশপ্রীত বুমরা চারটি উইকেট নিয়ে পাল্টা জবাব দিয়েছেন। তাই এককথায় বলা যায়, সেয়ানে সেয়ানে বোলারদের লড়াই পার্থের প্রথম টেস্ট ম্যাচ জমে উঠেছে।