মাত্র ৩৬ সেকেন্ডের ব্যবধানে রেফারি হরিশ কুন্ডু দু-দুটো লালকার্ড দেখিয়ে দিলেন। নিমিষেই ইষ্টবেঙ্গল এফসি ৯ জনের দলে পরিণত হলো। তখন সবেমাত্র ২৯ মিনিটের খেলা হয়েছে। মুহূর্তের ঘটনাপ্রবাহে মাঠের পরিবেশ বদলে গেল। গ্যালারিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার বিশেক দু’দলের সমর্থকরেরাও যেন হকচকিয়ে গেছে। বড়দলের ম্যাচ, এইসময় মাঠের ভিতরের পরিবেশ গ্যালারিতে উত্তেজনা ছড়িয়ে দিতে পারত। কিন্তু দু’দল রেফারির সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে খেলা শুরু করে দিলেন।
নির্ধারিত সময়ের দীর্ঘ ৬১ মিনিট ও অতিরিক্ত সময়ের ১০ মিনিটের সংযুক্ত সময়ের খেলা শেষে ইস্টবেঙ্গল এফসির রক্ষন অটুট রইল। আইএসএলে প্রথম বারের ইস্টবেঙ্গল এফসি ও মহামেডান স্পোর্টিংয়ের খেলা গোলশূন্যভাবে শেষ হলো।
এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপের গ্রুপ পর্যায়ে ইস্টবেঙ্গল এফসি অপরাজিত ছিল। কিন্তু এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপের আগে ইস্টবেঙ্গল এফসি তাদের টানা ৬টা ম্যাচেই পরাজিত হয়েছিল। কোচ পরিবর্তনের পর গুরুত্বপূর্ণ এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপে তারা ভালো ফল করে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে। কিছুদিন আগের এই সাফল্যের ভিত্তিতে আইএসএলের মিনি ডার্বিতে তারাই এগিয়েছিল। কিন্তু ম্যাচের ৩০ মিনিটেই খেলার অস্বাভাবিক পটপরিবর্তন হয়ে যায়। তারপরেও ইস্টবেঙ্গল এফসির ফুটবলারদের এই লড়াই আগামীদিনের সাফল্যে অনেক প্রত্যাশার জন্ম দিল।
২০ বছর আগে আশিয়ান কাপে জয়ের পর সে অর্থে ইস্টবেঙ্গল এফসির জাতীয় স্তরে সাফল্য নেই। আশিয়ান কাপের পরের বছরই ইস্টবেঙ্গল টিম ভেঙ্গে যায়। ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে আশিয়ান কাপ জয়ের পর সমর্থকদের মধ্যে জাতীয় স্তরে সাফল্যের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ ১৯ বছরের প্রতীক্ষার পরেও ইস্টবেঙ্গল এফসি আইলিগে চ্যাম্পিয়ান হতে পারেনি। চ্যাম্পিয়ান হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছলেও চুড়ান্ত সাফল্য আসেনি। এই সময়কালে অবশ্য কলকাতা লিগে ইস্টবেঙ্গল সাফল্য পেয়েছে। আশিয়ান জয়ের পর ১০ বার ইস্টবেঙ্গল এফসি কলকাতা লিগে চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত একটানা ৮ বার কলকাতা লিগে চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। কিন্তু জাতীয় লিগে তাদের সাফল্য ধরা দেয়নি।
দেশের জাতীয় লিগ চালু হওয়ার পর কলকাতা লিগের সাফল্যের দিয়ে সমর্থকদের মন জয় করা যায়না।প্রতিবছর ভালো দলগড়ার পাশাপাশি ভালো কোচ এনেও কেন আইলিগে চুড়ান্ত সাফল্য আসেনি– তা নিয়ে সদস্য সমর্থকদের মধ্যে বিস্তর জল্পনা হয়েছে।
আইএসএলের লিগ চালু হওয়ার পর ৬বছর ইস্টবেঙ্গল এফসি সেই লিগে যোগদান করেনি। পরবর্তী সময়ে আইএসএল লিগে অংশগ্রহণ করলেও, গত ৪ বছর ইস্টবেঙ্গল এফসি লিগ টেবিলের নীচের দিকেই থেকেছে।
এই মরশুমের দলবদলে ইস্টবেঙ্গল এফসি চমক দিয়ে দল গড়েছে। গত মরশুমের লিগ শিল্ড চ্যাম্পিয়ান চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান সুপার জায়েন্টসের ঘর ভেঙে দেশি ও বিদেশি ফুটবলার নিজেদের দলে নিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সমর্থকদের মধ্যে দলের সাফল্য নিয়ে অনেক প্রত্যাশা জেগেছে। এতভালো দল নিয়েও ইস্টবেঙ্গল এফসি ডুরান্ড কাপে সাফল্য পায়নি। আইএসএলের শুরুটাও ভালো না হওয়াতে সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এএফসি চ্যাম্পিয়ান লিগ-টু’র যোগ্যতাপর্ব থেকে ছিটকে যাওয়ার পর থেকে এই ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
এএফসি চ্যাম্পিয়ান লিগ-টু’র যোগ্যতাপর্ব থেকে ছিটকে যাওয়াতে ইষ্টবেঙ্গলের পক্ষে নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে আসে। এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপে খেলার সুযোগ ঘটে। পরবর্তী সময়ে এই কাপের প্রাথমিক সাফল্য সমর্থকদের নতুন করে টিমের প্রতি বিশ্বাস নিয়ে এসেছে। সেই বিশ্বাস নিয়েই সমর্থকরা আইএসএলের ডার্বিতে মহমেডান স্পোর্টিংয়ের মুখোমুখি হয় এবং টিমের জয় নিয়ে একপ্রকার তারা নিশ্চিতই ছিল। কিন্তু খেলার ৩০ মিনিটেই খেলার রং বদলে যায়। অবশ্য, খেলার প্রতিকূল পরিস্হিতি মধ্যেও দল অপরাজিত থেকেছে।
৯ জন ফুটবলার মিলে ১১ জন ফুটবলারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে অপরাজিত থাকা এবং এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপের ভালো ফলাফলে টিমের পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতা এসেছে। আপাতত: আইএসএলে ইষ্টবেঙ্গলের এফসির ২০ দিন কোনো খেলা নেই। আগামী ২৯ নভেম্বর ঘরের মাঠে ইস্টবেঙ্গল এফসি নর্থইস্ট টিমের মুখোমুখি হবে। এই বিরতিতে ভারতীয় দলের মালয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রেন্ডলি খেলা আছে। ইস্টবেঙ্গল এফসি থেকে আনোয়ার আলি ও জিকসন সিং ভারতীয় দলে ডাক পেয়েছে। এদের ছাড়াই ইস্টবেঙ্গল এফসি সুপার সিক্সের লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেবে। আইএসএলের প্রথম ৬ ম্যাচে হারার ফলে লিগ শিল্ড চ্যাম্পিয়ানের দৌড়ে পিছিয়ে পড়লেও সুপার সিক্সে আইএসএল কাপের লড়াইয়ে ফিরে আসার সুযোগ আছে। বিগত ৫টা ম্যাচে অপরাজিত ইস্টবেঙ্গল এফসি নিজেদের আত্মবিশ্বাস যথেষ্ট বাড়িয়ে নিতে পারলো। সমর্থরাও এই দলের প্রতি বিশ্বাস রাখছেন। আগামীদিনে ইস্টবেঙ্গল এফসির কাছে একেরপর এক গুরুত্বপূর্ণ খেলা আছে। কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ানের দৌঁড়গোড়ায়, আইএসএল লিগে ফিরে আসার লড়াই করতে হবে। এছাড়া সুপার কাপ, এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপের নকআউটের মত গুরুত্বপূর্ণ খেলায় ইষ্টবেঙ্গল এফসি অংশগ্রহণ করবে। আগামী ৪ মাসের মধ্যে সর্বভারতীয় স্তর ও আন্তর্জাতিক স্তরে এইরকম একাধিক টুর্নামেন্টে জয়ী হওয়ার হাতছানি ইস্টবেঙ্গল এফসির সামনে আছে। আইএসএলের মিনি ডার্বিতে মহামেডানের বিরুদ্ধে ৯ জনের ইষ্টবেঙ্গল এফসির সাহসী লড়াই– এইসব টুর্নামেন্টে সাফল্যে নিয়ে অনেক প্রত্যাশার জন্ম দিল।