ফুলের রঙ

তপনকুমার দাস

মন ভালো নেই রাজকুমারীর৷ বিকেলের বাগানে দৌড় ঝাঁপ, হুটোপুটি নেই৷ গোলাপ ঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে বন্ধুদের ধাপ্পা বলা নেই৷ গোল্লাছুট কিংবা চু-কিত-কিত খেলতে খেলতে পায়ের নূপুর হারিয়ে ফেলা নেই৷ দৌড়ে গিয়ে টগরফুলের উপর বসা প্রজাপতির কাছে জিজ্ঞাসা করা নেই— পাখনায় এত রং পেলে কোথা থেকে?

ব্যস! প্রজাপতির কথা মনে পড়তেই মনটা আরও খারাপ যায়৷ মনে মনে ফুসে ওঠে রাজকুমারী— আয় না, এবার বাগানে আয়৷ ডানা থেকে সব রং যদি মুছে না নিতে পারি, তবে আমার নাম সৃজা নয়৷


মনের মধ্যে যখন দুষ্টু কারও কান মলে দেওয়ার ভাবনা চলছে, ঠিক তখনই মন্দিরা বাজানোর মতো দুই হাতে তালি বাজিয়ে দেয় রাজকুমারীর মুখোমুখি বসা অনুপা৷ সৃজার বন্ধু৷ একসঙ্গে গুরুমশাইয়ের কাছে পাঠ নেয়৷ ওস্তাদজির কাছে কাফি ইমন শেখে আর তিলোত্তমার কাছে শেখে নাচ— ভরতনাট্যম৷ বন্দুক আর তরোয়াল চালানোও শিখতে হবে রাজকুমারীকে৷ তবে এখন নয়৷ আরেকটা বড় হলে৷

না, আমি শিখবো না৷ শিকবো না৷ শিকবো না— বাগানে বসেই পা দাপিয়ে চিৎকার করে সৃজা৷
কি রে? কি হলো? পা দাপাচ্ছিস কেন? — বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় অনুপা৷
ইস্৷ ভীষণ লজ্জা পেয়ে যায় সৃজা৷ অন্দরমহলে বাবা মায়ের সামনে পা দাপানোর কতা মনে পড়ে যায়৷ বাবা বলেন, অস্ত্র চালনা না শিখলে এত বড় দেশের দায়িত্ব নেবে কীভাবে? উত্তর দেয় সৃজা— আমি রাজা-রানি কিছুই হবো না৷ ওমা, সে কী কথা! রাজার মেয়ে রাজ্যশাসন করবে না তো কে করবে?

কি রে কি ভাবছিস? ওই দ্যাখ…
রামধনু! ফুল্লরার কথায় অবাক হয় সৃজা৷ দুই চোখে সারা বিশ্বের বিস্ময় ঢেলে চেয়ে থাকে পুব আকাশের পানে৷
আমি তো কখন থেকে বলছি, দ্যাখ, দ্যাখ, দ্যাখ৷ রামধনু কি আকাশে বসে থাকবে তোর জন্য? সৃজাকে শুনিয়ে মনের কথা ফুল্লরাকে জানিয়ে দেয় অনুপা৷
রামধনুর বুকে চোখ রেখে মনটা চনমনে হয় রাজকুমারীর৷ আর মোটে দু’দিন বাকি৷ রাজমাতা, সৃজার ঠাকুমা বলেছেন রাস পূর্ণিমার দিন দোল৷ রং খেলা৷ তাই শুনে বাবামশাই বলেছেন, এ বছর আর রং খেলা হবে না৷ সারা বছর দেশজুড়ে ফুল তেমন ফোটেনি৷
‘বাহির পথে / ঘরের তো কেউ নই’ — ও তুমি বুঝবে না৷ বড় কঠিন গান৷ চল বরং ভিতরে যাই৷ তোমাদের সঙ্গে দু’দণ্ড গল্প করি৷

আরে, রাজা দাদা৷ আসুন আসুন— তানিকে টপকে রাজা বাউলের সামনে এসে দাদুভাই৷
রাজা দাদা খুব অবাক হয় তানি৷ এমন চেনা সাধুর কথা দাদু তো বলেননি কোনওদিন৷
তোমার নাতনির সঙ্গে গল্প করছিলাম৷ খুব ভালো৷ খুব মিষ্টি মেয়ে— তানি আর দাদুভাইয়ের পিছনে পিছনে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলেন রাজা দাদু৷
কে? রাজা দাদা? কতদিন পরে এলেন৷ আমাদের কথা কি একদম ভুলে গেছেন? আসুন আসুন— রান্নাঘরের কাজ ফেলে সামনে এসে দাঁড়ান দিদুন৷

ভুলে গেলে কি আর এমনি চলে আসতে পারতুম? কেমন আছো নমিতা?
ও বাবা! দিদুনের নামও জানেন দেখছি— সত্যি সত্যি অবাক হয় তানি৷
সবার নাম জানি৷ তোমার দাদু অতনু মিত্র—
উনি আমাদের রাজা দাদা, আর সারা বাংলা, মানে এপার ওপার দুই বাংলাজুড়ে সবাই ওঁকে চেনে রাজাবাউল নামে— তুমি রাজাদাদু বলে ডাকতে পারো৷
ঠিক আছে৷ ঠিক আছে৷ তোমার দোতারাটা একটু দেবে? আমি বাজাবো— রাজা বাউলের বন্ধু হয়ে যায় তানি৷

চা খাবেন তো দাদা? আজ কিন্ত্ত অনেক গান শুনবো— রান্নাঘরের দিকে চলে যান দিদুন৷
একুশ তারিখ সবাই মিলে তাহেরপুরে চলে এসো, সোফার উপর পা তুলে বসেন রাজা বাউল৷ দোতারাটা শুইয়ে রাখেন পাশে৷ তারপর চোখ রাখেন তানির চোখে৷ অমন দুষ্টু মেয়ে সেই চোখের দৃষ্টিতে ঘাবড়ে যায়৷ যেমন গভীর, তেমনই মায়াময় শান্ত৷ বলেন, বলো তো ’একুশে ফেব্রুয়ারি’ কেন বিখ্যাত?
সরস্বতী পুজোর দিন, উত্তর দিতে একটুও দেরি করে না তানি৷
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ — দরাজ গলায় গেয়ে ওঠেন রাজাবাউল৷

সব বছর তো আর একুশে ফেব্রুয়ারি সরস্বতী পুজো হয় না কিন্ত্ত সব বছর এই দিনটা ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবে পালিত হয়—
রঙের এর গোলাপ? কবে ফুটবে রক্তকরবী? হলুদ টগর?
টকটকে লালজবা? গাঢ় লাল অপরাজিতা? বন্ধু রাজকুমারীর কথায় খেই ধরিয়ে দেয় অনুপা?
আর শিমূল পলাশ কৃষ্ণচূড়া? জানতে চায় মমতা৷
রাত পোহালে দোল৷ রং না হলে রাজকুমারী খেলবে কেমন করে— গোল গোল চোখের ঝিলিক ছড়িয়ে দেয় ফুল্লরা৷ ফুটবে গো ফুটবে৷ তোমাদের হোলি খেলার আবির রঙের অভাবূ হবে না— হেসে ফেলে জগাই৷
তুমি কী করে জানলে একদিনের মধ্যে সব ফুল ফুটে যাবে? জগাইয়ের উত্তর আর হাসি পছন্দ হয় না রাজকুমারীর৷ প্রশ্ন করে— তুমি কি মন্ত্র জানো?
না, মন্ত্র জানি না, তবে গাছেদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে৷
কথা হয়েছে মানে? জগাইদাদার কথা বিশ্বাস হয় না কারও৷ একসঙ্গে প্রশ্ন করে, সৃজা আর বন্ধুরা৷
হঁ্যা গো হঁ্যা, কথা হয়েছে৷ সবাই কাল রাত হতে না হতেই ফুটে উঠবে৷ তারপর—
তারপর? ধৈর্য ধরে না কারও৷

ভোর হতে না হতেই সব রং আমাকে দিয়ে দেবে৷ লাল হলুদ নীল সবুজ গোলাপী সব রং— চোখ পিটি পিটি করে জানিয়ে দে জগাই৷ দাদুভাইয়ের কথা মনে পড়ে সৃজার— মালিরা গাছের সঙ্গে কথা বলে৷ চাষিরা কথা বলে ফসলের সঙ্গে৷ জেলে কথা বলে পুকুর নদী মাছের সঙ্গে৷ আসলে যার যাই পেশা হোক না কেন, মন খুলে রাখলে সবাই আত্মীয় হয়ে যায়৷ দাদুর সেই কথাই এখন জগাই দাদা বলছে৷

ঠিক আছে, ঠিক আছে৷ মনে থাকে যেন, চল, একটু দোলনায় চড়ি— বন্ধুদের ডাক দেয় সৃজা৷
কোনও চিন্তা করো না৷ ভোরবেলায় কোকিলকে বলবো ওই পলাশ গাছটার চূড়ায় বসে গান গাইতে৷ কোকিলের গান শুনলেই বুঝতে পারবে আবির রং তৈরি— নিশ্চিন্ত করে জগাই দাদা৷

ঠিক তখনই সুবাস ছড়িয়ে গোলাপী একটা গোলাপ সবগুলো পাপড়ি মেলে ফুটে ওঠে রাজকুমারীর চোখের সামনে৷ হাসতে থকে মিঠি মিঠি খুসিতে ঝরণার মতো টলমল করে ওঠে সৃজা ও তার বন্ধুরা৷
একটা প্রজাপতি কোথায় যে ছিল, উড়ে এসে রঙিন ডানা মেলে বসে পড়ে গোলাপ ফুলের বুকে৷