আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু: বিশ্বের প্রথম জীবপদার্থবিদ

গবেষণায় দেখা গেল উদ্ভিদের উত্তেজনার জন্য দায়ী উদ্ভিদ কোষের তড়িৎপ্রবাহ। পরবর্তীতে সালোকসংশ্লেষ, উদ্ভিদের স্নায়ুতন্ত্র, কোষে জলীয় দ্রবণের চলাচল, এসব নিয়েও তাঁর ক্লান্তিহীন গবেষণা এগিয়ে চললো গাছেদের প্রতি অকুন্ঠ ভালোবাসায়। মূলতঃ একজন পদার্থবিদ হলেও গাছের প্রতি টান তাঁর আশৈশব। তার নিজের কথায়,- “গাছের জীবন মানুষের জীবনের ছায়া মাত্র।” আবার তিনি লিখেছেন- “গাছের প্রকৃত ইতিহাস সমাধান করতে হইলে গাছের নিকট যাইতে হইবে, বৃক্ষ লিখিত সাড়া দ্বারা তাঁর জীবনের গুপ্ত ইতিহাস উদ্ধার হইতে পারে।” নিরন্তর এই ইতিহাস খুঁজে চলা এবং খুঁজতে খুঁজতে যা পেয়েছেন তাকেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

১৯০২ সালে ‘Response in the Living and Non-Living’ বইটি প্রকাশিত হয়। সেখানে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে জীব ও জড়ের যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক সাড়া দেবার প্রবণতা গ্যালভানোমিটারের কাঁটার বিচ্যুতি ও লিপিগ্রাফের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন। জীবের সাড়া পরিমাপের জন্য প্রাণী টিস্যুর পরিবর্তে উদ্ভীদ টিস্যু ব্যবহার করেন এবং এর স্বপক্ষে যুক্তি ছিল প্রাণী টিস্যু জটিল এবং খুব স্বল্প সময় জীবিত থাকে। ফলে দীর্ঘসময় ব্যাপী পরীক্ষার স্বার্থে উদ্ভিদ টিস্যু অধিক উপযোগী। তিনি একইভাবে দেখতে চেয়েছিলেন কোনো নির্দিষ্ট উদ্দীপকের বিপরীতে উদ্ভিদ ও প্রাণী অনুরূপ সাড়া দেয় কিনা। তাঁর ভাষায়- “My own attempt, however, was directed, not towards the obtaining of a mere qualitative response, but rather to determination of weather throughout the whole range of response phenomena parallalism between animal and vegetable could be detected.” তিনি তার রেসনান্ট রেকর্ডার যন্ত্রের সাহায্যে দেখিয়েছিলেন যে প্রাণীদেহ থেকে বিচ্ছিন্ন স্নায়ু কোষকে কৃত্রিম উপায়ে উত্তেজিত করলে যেমন সাড়া পাওয়া যায় তার সাথে বহুলাংশের সাদৃশ্য পাওয়া যায় একইভাবে উদ্দীপিত উদ্ভিদ টিস্যু থেকে প্রাপ্ত সাড়ার।

উদ্ভিদের সাড়া সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল নিয়ে তিনি আরও দুটি বই প্রকাশ করেন- প্রথমটি ১৯০৬ সালে Plant response: as a means of Physiological Investigations এবং দ্বিতীয়টি Comparative Electro-Physiology: A Physico-Physiological Study. পরিবেশের বিভিন্ন নিয়ামক আলো, তাপমাত্রা, মাধ্যাকর্ষণ এর প্রভাবে উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশের সঞ্চালন নিয়ে গবেষণা লব্ধ ফলাফল বর্ণনা করেন তাঁর ‘Life Movements in Plants’ বইতে। এই বইতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন উদ্ভিদের উপর দৃশ্যমান আলোর অনুরূপ প্রভাব রয়েছে বেতার তরঙ্গের। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের কাছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে গবেষণার একটি প্রিয় বিষয় ছিল উদ্ভিদের রসাকর্ষণ বা ascent of sap।


আকাশছোঁয়া উদ্ভিদে কোন্ প্রক্রিয়ায় এবং কিভাবে রস উত্তোলন ঘটে তা ছিল এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার যা বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। জগদীশচন্দ্র উদ্ভিদের রসাকর্ষণ ব্যাখ্যা করেন যে মতবাদ দ্বারা তা Pulsation Theory of Ascent Sap নামে পরিচিত। এবং এ সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল লিপিবদ্ধ করেন ১৯২৩ সালে প্রকাশিত The Physiology of Ascent of Sap বইতে। এই মত অনুযায়ী কান্ডের কর্টেক্স টিস্যুর সর্বনিম্ন স্তরের কোষগুলোর স্পন্দনের ফলে রস-উত্তোলন ঘটে। কর্টেক্সের স্তরের কোষের স্পন্দন তিনি বৈদ্যুতিক প্রবাহ, সুঁই ও গ্যালভানোমিটার যন্ত্রের দ্বারা দেখিয়ে দিলেন। সুঁইটি কর্টেক্সের অভ্যন্তরে প্রবেশ করালে গ্যালভানোমিটারের কাঁটার বিক্ষেপ প্রমাণ করে স্পন্দনের উপস্থিতি। তাঁর মতে এই স্পন্দনের ফলেই জাইলেম এর মধ্য দিয়ে রস উত্তোলিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি শ্যাল, মাকডুগাল, বেনেডিক্ট’রা দেখান স্পন্দনের সাথে রসাকর্ষণের কোনো সম্পর্ক নাই। (আগের সংখ্যার পর)