• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

মহিলাদের সক্রিয়তা চোখে পড়ার মতো

বাংলার শেষ দফার ভোট মধুছন্দা চক্রবর্তী: একুশের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখে অনেকেই বলেছিলেন, মমতা ব্যানার্জির বিপুল সংখ্যায় জয়ের অনেকটাই মহিলা ভোটারদের জন্য৷ মমতার ভোট ব্যাঙ্কের বাড়বাড়ন্ত মহিলা ভোটারদের জন্য৷ চব্বিশের লোকসভা ভোট একটা সম্পূর্ণ অন্য চিত্র তুলে ধরল সকলের সামনে৷ সন্দেশখালি, কুলতলি, জয়নগর, উত্তর কলকাতা সর্বত্র দেখা যাচ্ছে মহিলা ভোটারদের অতি সক্রিয়তা৷ কেউ মাথার ইঁটের আঘাত

বাংলার শেষ দফার ভোট

মধুছন্দা চক্রবর্তী: একুশের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখে অনেকেই বলেছিলেন, মমতা ব্যানার্জির বিপুল সংখ্যায় জয়ের অনেকটাই মহিলা ভোটারদের জন্য৷ মমতার ভোট ব্যাঙ্কের বাড়বাড়ন্ত মহিলা ভোটারদের জন্য৷ চব্বিশের লোকসভা ভোট একটা সম্পূর্ণ অন্য চিত্র তুলে ধরল সকলের সামনে৷ সন্দেশখালি, কুলতলি, জয়নগর, উত্তর কলকাতা সর্বত্র দেখা যাচ্ছে মহিলা ভোটারদের অতি সক্রিয়তা৷ কেউ মাথার ইঁটের আঘাত পেয়েও ভোট দিতে ছুটেছেন, কেউ পুলিশ এমনকী কেন্দ্রীয় বাহিনীর চোখ চোখ রেখে প্রশ্ন করেছেন ভোট পরবর্তী হিংসার প্রতিকার নিয়ে, কেউ আবার সরাসরি প্রার্থীকে দেখে সরাসরি ক্ষোভ উগরে দিলেন, কেউ আবার ভোট না দিতে পারায় তীব্র আক্রোশে ফেটে পড়লেন৷ দিনভর সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় মহিলা ভোটারদের এই অতিসক্রিয়তার চেহারাটা ধরা পড়ল৷ বাংলার মা ‘লক্ষ্মী’রা যে মোটেও লক্ষ্মী মেয়েটির মতো শান্তশিষ্ট নয়, বরং তাঁদের মধ্যে যে মা ‘চণ্ডী’র রূপই প্রকট হয়ে উঠছে, তাই সাক্ষী থাকল ভোট সপ্তমীর পশ্চিমবঙ্গ৷
শনিবার সকালে সন্দেশখালির দক্ষিণ খুলনা এলাকা প্রায় রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়৷ ভোটারদের বাধা, হামলা, ভাঙচুরের ঘটলা ঘটল৷ পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায় গ্রামবাসীদের৷ পুলিশের বিরুদ্ধেও ইঁট ছোঁড়ার অভিযোগ ওঠে৷ ইঁটের ঘায়ে মাথা ফেটে যায় একজন মহিলার৷ গুরুতর জখম হয়েছেন আরও কয়েকজন৷ ইঁটের আঘাত পেয়েও ওই মহিলা জানিয়ে দেন, তিনি ভোট দিতে .যাবেনই৷ এলাকার আর একজন মহিলা সরাসরি অভিযোগ করেন, শাহজাহান শেখের বাহিনী গোটা এলাকায় তাণ্ডব চালাচ্ছে৷ পুলিশকে জানিয়েও কোনও সুরাহা হচ্ছে না, উল্টে পুলিশ আমাদের ওপর হামলা করছে৷ এই সন্দেশখালির প্রার্থী রেখা পাত্রের সঙ্গে ছিলেন বিরাট মহিলা বাহিনী৷ যাঁরে এদিন পুলিশকেই বলতে শোনা যায়, ‘পাবলিকের মার, দুনিয়ার বার’৷

শেষ পর্যায়ের নির্বাচনে আরও একটি দৃশ্য চোখে পড়ল৷ যেখানে ভোট অশান্তিতে আহত ছেলের হাতটা শক্ত করে ধরেই মা বলছেন, ছেলে অবশ্যই ভোট দিতে যাবেন৷ রক্তাক্ত ছেলের জন্য হাহুতাশ না করে সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করার জন্যই তৎপর হয়ে উঠলেন এক বর্ষীয়ান মহিলা৷ বাংলার মহিলা ভোটারদের এহেন সক্রিয়তার দৃশ্য এর আগে দেখা যায়নি৷

শনিবারের ভোটে মথুরাপুরের একটি গ্রামে বেশিরভাগ মানুষ ভোট দিতে যেতে পারেননি৷ পুলিশ যখন তাঁদের এসে অভয় দান করে ভোট দিতে যাওয়ার জন্য বলেন, তখন ওই মহিলাদের পুলিশের চোখে চোখ রেখে বলতে শোনা যায়, ‘ভোটের পর কী হবে’? তাঁদের স্পষ্ট প্রশ্নের সামনে পুলিশকে স্বীকার করতেই হয়, ভোট মিটে গেলেও এলাকায় শান্তি রাখার দায়ভার তাঁরাই নিচ্ছেন৷

কেবল জেলাই নয়, শনিবার শহর এবং শহরতলির মহিলা ভোটারদেরও এদিন সক্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো৷ যেমন কামারহাটিতে ২৯ নম্বর বুথে ঢুকে খোদ প্রিসাইডিং অফিসারকেই ধমক দিতে শোনা যায় তৃণমূল কাউন্সিলর শ্রীতমা ভট্টাচার্যকে৷ এদিন ভোট দিতে এসে বুথ থেকে বেরিয়ে শ্রীতমা জানান, এই বুখে ইভিএম-এর ওপর আলো পডছে না৷ ফলে বয়স্ক মানুষদের প্রতীক বা নাম দেখতে অসুবিধে হচ্ছে৷ শ্রীতমা এদিন প্রিসাইডিং অফিসারকে কড়া নির্দেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেন, এখন কাউকে ভোট দিতে দেবেন না৷ আগে অফিসাররা এসে আলো ঠিক করবেন, তারপর ভোট শুরু হবে৷ শ্রীতমার এই প্রতিবাদের পরে কামারহাটি বিধানসভার ২৯ নম্বর বুথে বেশ কিছুক্ষণ বন্ধ ছিল ওই বুথে ভোটগ্রহণ৷

এদিন বেলেঘাটা এলাকাতেও মহিলা ভোটাররা তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগদান করা তাপস রায়কে সরাসরি আক্রমণ কতে শোনা যায়৷ গো ব্যাক স্লোগান দিতেও শোনা যায়৷ বলেন উনি তৃণমূলের কাছ থেকে সব সুবিধে নিয়ে বিধায়ক হয়ে তারপর দলবদল করেছেন৷

অন্যদিকে এদিন ভোট দিতে এসেও ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলেন না টলিউডের অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখার্জি এবং তাঁর ‌োবন অজপা৷ তাঁদের অভিযোগ, তাঁদের প্রয়াত মা-বাবার ভোটার লিস্টে নাম থাকলেও তাঁদের নাম নেই৷

দলমত নির্বিশেষে এদিন প্রকাশ্যে মহিলা ভোটারদের সক্রিয় হয়ে ওঠার ছবিটা চোখে পড়ার মতো৷ এই রাজ্যে মহিলা প্রার্থীদের শতাংশের হার অন্য রাজ্যের তুলনায় বেশিই৷ কিন্ত্ত কেবল প্রার্থী হিসেবেই নয়, ভোটার হিসেবেও মহিলারা যে উত্তরোত্তর সক্রিয় হতে উঠছে তা মালুম হল পশ্চিমবঙ্গের শেষ দফার নির্বাচনে৷

উল্লেখ্য, ১৯৫২ সালের নির্বাচনের সময়ে দেশের প্রথম নির্বাচন কমিশনার ছিলেন এক বাঙালি সুকুমার সেন৷ তখন ভোটার তালিকা তৈরির সময়ে দেখা যায়, মহিলাদের কোনও স্বতন্ত্র পরিচয় ছিল না৷ যে টিম তালিকা তৈরি করে, সেখানে মহিলাদের পরিচয় ছিল অমুকের মা কিংবা স্ত্রী কিংবা বোন হিসেবে৷ সুকুমার সেনই প্রথম মহিলার নিজস্ব নাম আর পরিচয় দিয়ে ভোটার তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেন৷ সেই সময়ের পর কেটে গিয়েছে ৭০ বছরেরও বেশি সময়৷ এখন মহিলা ভোটাররা শুধু ভোটাধিকারই প্রয়োগ করেন না, স্বচ্ছ নির্বাচনের পক্ষে গলা ফাটান, প্রয়োজনে লাঠি নিয়ে তেড়ে যান, পুলিশ কিংবা নির্বাচন কমিশনকেও চ্যালেঞ্জ ছঁুড়ে দেন৷

মহিলা ভোটারদের এই অতি সক্রিয়তার ছবিটাই আভাস দেয়, এই ভোটদাত্রীদের মধ্যেই ঘুমিয়ে রয়েছে ভবিষ্যতের নেত্রী৷