বাংলায় বিজেপি-র এই ভরাডুবির দায় শুভেন্দু নেবেন কি?

পুলক মিত্র

রাজ্যে বিজেপি-র এখন সত্যিই দুর্দিন। লোকসভা নির্বাচনে বড় ধাক্কার পর বিধানসভার উপনির্বাচনেও শোচনীয় বিপর্যয়। মানিকতলা, রায়গঞ্জ, বাগদা এবং রানাঘাট দক্ষিণ – এই ৪টি বিধানসভা কেন্দ্রেই বিজেপি-কে হারিয়ে দিয়েছে রাজ্যের বর্তমান শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। শুধু হারিয়েছে বললে ভুল হবে। বলা যায়, বিজেপিকে পর্যুদস্ত করেছে তৃণমূল। এর মধ্যে মানিকতলা বাদ দিলে, বাকি ৩টি আসনে ২০২১-র বিধানসভার নির্বাচনে জয় পেয়েছিল বিজেপি।

মানিকতলা সাধন পাণ্ডের এলাকা। দীর্ঘদিন তিনি এখানকার বিধায়ক ছিলেন। এবার ওই কেন্দ্রে প্রয়াত বিধায়কের স্ত্রী সুপ্তি পাণ্ডে জিতেছেন ৬২,৩১২ ভোটের ব্যবধানে। অথচ লোকসভা নির্বাচনে মানিকতলা কেন্দ্রে মাত্র সাড়ে তিন হাজারের কিছু বেশি ভোটে বিজেপির চেয়ে এগিয়ে ছিল তৃণমূল৷


রানাঘাট দক্ষিণে তৃণমূল প্রার্থী মুকুটমণি অধিকারী ৩৯,০৪৮ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন বিজেপির মনোজ কুমার বিশ্বাসকে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হয়ে জেতা মুকুটমণিই উপনির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী ছিলেন। বিগত লোকসভা নির্বাচনে রানাঘাটে তৃণমূলের টিকিটে দাঁড়িয়ে হেরেছিলেন তিনি। উপনির্বাচনেও মুকুটমণিকেই টিকিট দিয়েছিল তৃণমূল। এবার তিনি পদ্মের বদলে ঘাসফুলের বিধায়ক হলেন।

বাগদা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ৩৩ হাজারেরও বেশি ভোটে জয়ী হয়েছেন তৃণমূলের মধুপর্ণা ঠাকুর৷ তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মধুপর্ণা ঠাকুর পেয়েছেন ১,০৭, ৫৭৭টি ভোট। আর বিজেপি প্রার্থী বিনয় বিশ্বাস পেয়েছেন ৭৪, ১০৯টি ভোট। ৩৩,৪৬৮ ভোটের ব্যবধানে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মধুপর্ণা। তিনিই রাজ্য বিধানসভার কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে শপথ নিতে চলেছেন।

রানাঘাট দক্ষিণ এবং বাগদা, দুই কেন্দ্রে তৃণমূলের জয় নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ৷ কারণ, দুটি কেন্দ্রই মতুয়া প্রভাবিত।

১৯৯৮ সালে তৃণমূল তৈরি হওয়ার পর থেকে কখনও রায়গঞ্জে জিততে পারেনি তৃণমূল৷ এবার  বিজেপির দখলে থাকা রায়গঞ্জ কেন্দ্র থেকেও প্রায় ৫০ হাজার ভোটে জয়ী হয়েছেন তৃণমূলের কৃষ্ণ কল্যাণী৷ মুকুটমণির মতোই লোকসভা নির্বাচনেও রায়গঞ্জ থেকেই তৃণমূলের টিকিটে প্রার্থী হলেও, জিততে পারেননি কৃষ্ণ কল্যাণী৷ কিন্তু বিধানসভায় জিতলেন।

কেন রাজ্যে তৃণমূলের এই সাফল্য? আর একের পর এক নির্বাচনে কেন বিজেপির বারবার ভরাডুবি হচ্ছে? রাজনৈতিক মহলে এ নিয়ে নানা বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা।

লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার আগে এই ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’-এ লিখেছিলাম, রাজ্যে খুব ফল করলেও, বিজেপির আসন সংখ্যা ১২ ছাড়াবে না। ভোট প্রচারে বিজেপি নেতারা যতই আস্ফালন, হম্বিতম্বি করুন না, আসলে মানুষের কাছে তাঁরা এখনও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। শুধুমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গালাগাল দিয়ে ভোটে জেতা যায় না। ভোটটা টিভি চ্যানেল বা খবরের দেয় না। ভোট দেন রাজ্যের সাধারণ মানুষ।

২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এই রাজ্যে ১৮টি আসনে জিতেছিল। ২০২১-এর বিধানসভার ভোটে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহের দল বাংলায় পেয়েছিল ৭৭টি আসন। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, জনপ্রতিনিধি হিসেবে এলাকার মানুষের স্বার্থে তাঁরা কী কী কাজ করেছেন? কী জবাব দেবেন বিজেপির সাংসদ, বিধায়করা? শুধুমাত্র বিধানসভায় দাঁড়িয়ে বিরোধী দল হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী বা শাসক দলকে তাঁরা আক্রমণ করতেই পারেন। কিন্তু একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজ নিজ নির্বাচনী কেন্দ্রে তাঁরা কী ভূমিকা পালন করেছেন?

২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্য থেকে যে ১৮ জন সাংসদ জিতেছিলেন, গত ৫ বছরে বাংলার জন্য কয়টি প্রকল্প কেন্দ্রের কাছ থেকে তাঁরা আদায় করে আনতে পেরেছেন? এক কথায় উত্তর হল, শূন্য। শুধু তাই নয়, দুর্নীতির অজুহাত দিয়ে বাংলার প্রাপ্য টাকা যাতে আটকে যায়, তার জন্য দিল্লিতে দরবার করেছেন।

বিজেপি নেতারা বুক ফুলিয়ে বলেন, তাঁরা নাকি বিশ্বের বৃহত্তম সুশৃঙ্খল দল। কিন্তু যদি প্রশ্ন করি, বাংলায় দলের এই হতশ্রী অবস্থা কেন? দলটা যদি সত্যিই সুশৃঙ্খল হয়ে থাকে, তবে শীর্ষ নেতারা কেন একে অন্যের বিরুদ্ধে কুৎসিতভাবে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করছেন?

দিলীপ ঘোষ এক সময় এই রাজ্যে দলের সভাপতি ছিলেন। বাংলায় বিজেপির যা কিছু সাফল্য, তা কিন্তু এই দিলীপবাবুর আমলেই। অথচ বিজেপিতে যাওয়ার পর থেকে এই দিলীপবাবুকেই আক্রমণের নিশানা হিসেবে বেছে নিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনও হুঁশিয়ারি, বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরে থাক, বরং শুভেন্দুকে প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন অমিত শাহের মতো নেতারা। অন্যদিকে, দিলীপবাবুদের মতো পুরনো একনিষ্ঠ নেতাকর্মীদের ব্রাত্য করে রেখেছেন।

বিধানসভায় শুভেন্দুকে বিরোধী নেতা করার পর থেকে বিজেপির যে ব্যর্থতা শুরু হয়েছিল, তা আজও চলছে। লোকসভা বা বিধানসভার উপ নির্বাচনে বিজেপির এই যে ভরাডুবি, তার দায় কি শুভেন্দু নেবেন? না, তিনি নেবেন না। দায় ঝেড়ে ফেলতে তিনি তো বলেই দিয়েছেন, তিনি নাকি দলের সাংগঠনিক ব্যাপারে নাক গলান না। যদি নাক না গলিয়ে থাকেন, তবে তাঁর নিজের পছন্দের  লোকজন টিকিট পেলেন কী করে?

গত লোকসভা নির্বাচনে মেদিনীপুর আসনে জিতেছিলেন দিলীপ ঘোষ। কেন তাঁকে জেতা আসন থেকে সরিয়ে দুর্গাপুরে প্রার্থী করা হয়েছিল? স্পষ্টবাদী দিলীপ ঘোষ তো প্রকাশ্যেই বলেছেন, তাঁকে ষড়যন্ত্র করে হারানো হয়েছে? দিলীপবাবু কারোর নাম না বললেও, বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তিনি কার দিকে ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন।

সুকান্ত মজুমদার লোকসভায় জয়ী হওয়ার পর নতুন রাজ্য সভাপতি কে হবেন, তা নিয়ে দলের মধ্যে নানা জল্পনা চলছে। প্রায় দেড় মাস হয়ে গেল, রাজ্য সভাপতি বাছতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে। দিলীপ ঘোষকে আবার ওই পদে ফেরানোর কথাবার্তা চললেও, কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন শুভেন্দু।

আসলে বঙ্গ বিজেপিতে এখন মুষলপর্ব চলছে। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার চেয়ে বিজেপি নেতারা বেশি ব্যস্ত দলীয় কোন্দল নিয়ে। রাজ্য বিজেপিতে অনেক গোষ্ঠী। দিলীপ ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারীর সম্পর্ক সাপে নেউলের মতো। সুকান্ত মজুমদার, রাহুল সিনহা, শমীক ভট্টাচার্য – এঁদেরও আলাদা আলাদা গোষ্ঠী। সবাই নিজেদের বড় নেতা ভাবেন, অথচ এঁদের কারোরই কোনও সাংগঠনিক ভিত্তি নেই। এঁরা কেউ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে নেতা হয়ে ওঠেননি। বলা যায়, দিল্লি থেকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে যাঁদের কোনও যোগাযোগ নেই, তাঁরা নেতা হলে, যা হওয়ার তাই-ই এখন হচ্ছে বিজেপিতে।

তবে একটা কথা বলা দরকার, রাজ্য বিজেপিকে যিনি খাদের কিনারে নিয়ে এসেছেন, সেই শুভেন্দু অধিকারী কি এই ফলাফলের দায়িত্ব নেবেন? তিনি তো বারবার নিজেকে বিজেপির মুখ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। নিজেকে মমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে চলেছেন শুভেন্দুবাবু। কিন্তু কাঁথির ভূমিপুত্র কি জানেন না, তিনি আর মমতা এক নন। বহু আন্দোলন, লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে মমতা আজ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁকে কেউ ধরে এনে বসিয়ে দেননি। তাই দলের সাফল্যে শুভেন্দু যেভাবে আগ বাড়িয়ে কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা করেন, ব্যর্থতার দায়ও তাঁকে নিতে হবে বৈকি।