• facebook
  • twitter
Sunday, 24 November, 2024

উত্তরবঙ্গ কি এবার মমতার মুখে হাসি ফোটাতে পারবে?

পুলক মিত্র উত্তরবঙ্গ কি এবারও তৃণমূলকে খালি হাতে ফেরাবে? নাকি সব হিসেব উল্টে যাবে? ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে দার্জিলিং, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, বালুরঘাট, রায়গঞ্জ, মালদহ দক্ষিণ এবং মালদহ উত্তর – উত্তরবঙ্গের এই ৮টি আসনের মধ্যে ৭টিতেই জিতেছিলেন বিজেপি প্রার্থীরা৷ একমাত্র মালদহ দক্ষিণ আসনে জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস৷ রাজ্যে ৭ দফার নির্বাচনের প্রথম পর্বে (১৯ এপ্রিল) জলপাইগুডি়, কোচবিহার

পুলক মিত্র

উত্তরবঙ্গ কি এবারও তৃণমূলকে খালি হাতে ফেরাবে? নাকি সব হিসেব উল্টে যাবে? ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে দার্জিলিং, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, বালুরঘাট, রায়গঞ্জ, মালদহ দক্ষিণ এবং মালদহ উত্তর – উত্তরবঙ্গের এই ৮টি আসনের মধ্যে ৭টিতেই জিতেছিলেন বিজেপি প্রার্থীরা৷ একমাত্র মালদহ দক্ষিণ আসনে জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস৷

রাজ্যে ৭ দফার নির্বাচনের প্রথম পর্বে (১৯ এপ্রিল) জলপাইগুডি়, কোচবিহার ও আলিপুরদুয়ারে ভোট হয়েছে৷ দ্বিতীয় দফায় (২৬ এপ্রিল) ভোট নেওয়া হয়েছে দার্জিলিং, রায়গঞ্জ, বালুরঘাটে৷ আগামী ৭ মে তৃতীয় দফায় মালদহ উত্তর ও মালদহ দক্ষিণে ভোট হবে৷

দার্জিলিং
প্রথমেই আসি দার্জিলিংয়ের কথায়৷ এখনও পর্যন্ত লোকসভার এই আসনটিতে একবারও জিততে পারেনি তৃণমূল৷ পাহাড়ি দলের সমর্থন নিয়ে এই কেন্দ্রে পর পর তিন বার জিতেছেন পদ্মের প্রার্থীরা৷ এ বারেও সুবাস ঘিসিংয়ের গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের সমর্থনেই লড়ছে বিজেপি৷ সঙ্গে রয়েছে বিমল গুরুংয়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাও৷

স্বাধীনতার পর কংগ্রেস এখানে বেশ কয়েকবার জিতলেও, পরে তা সিপিএমের দখলে যায়৷ ১৯৭১, ১৯৮০ ও ১৯৮৪ এবং ১৯৯৬, ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে পরপর তিন বার এখানে জয়ী হয় সিপিএম৷ এরপর ২০০৪ সালে কংগ্রেস জিতলেও, ২০০৯-এ দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে জয়ী হন বিজেপি-র যশোবন্ত সিং৷ কিন্ত্ত পরের বারেই প্রার্থী বদলায় বিজেপি৷ ২০১৪ সালে সাংসদ হয়ে কেন্দ্রে মন্ত্রীও হন সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়া৷ আবার ২০১৯-এ আলুওয়ালিয়াকে বর্ধমান-দুর্গাপুরে প্রার্থী করে দার্জিলিঙে দাঁড় করানো হয় মণিপুরের বাসিন্দা রাজু বিস্তাকে৷ এবার রাজুর বিরুদ্ধে লড়ছেন তৃণমূলের গোপাল লামা৷ দার্জিলিংয়ে এবার বিজেপির বড় ‘কাঁটা’ হলেন দলেরই কার্শিয়াংয়ের বিধায়ক বিষ্ণুপ্রসাদ শর্মা৷ কোনও ‘ভূমিপুত্র’কে পাহাডে় প্রার্থী করার দাবি তুলেছিলেন তিনি৷ কিন্ত্ত দল সে দাবি না-মানায় নির্দল হয়ে দলেরই প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁডি়য়ে পডে়ছেন বিষ্ণুপ্রসাদ৷ তাই এবার দার্জিলিংয়ে খেলা ঘুরে যেতে পারে৷

২০১৪ সালে বিজেপি দার্জিলিংয়ে জিতেছিল ১,৯৭,২৩৯ ভোটে৷ ২০১৯ সালে তা বাডি়য়ে ৪,১৩,৪৪৩ ভোটে জেতেন রাজু৷ বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার ৪২.৭৩ থেকে বেড়ে হয় ৫৯.১৯ শতাংশ৷ ২০১৯ সালে তৃণমূল দার্জিলিঙে পেয়েছিল ২৬.৫৬ শতাংশ ভোট৷ গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট কমে হয় ৪৩.৬৮ শতাংশ৷ অন্যদিকে, তৃণমূলের ভোট বেডে় পৌঁছে যায় ৩১.৩৭ শতাংশে৷ দার্জিলিং যে তাঁর বিশেষ নজরে রয়েছে, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী৷ বারবার তিনি ছুটে গিয়েছেন পাহাড়ে৷ তবে এ বার বিজেপি জিতলে দার্জিলিংয়ে নতুন রেকর্ড তৈরি হবে৷ এই প্রথম সেখানে টানা চার বার জয়ী হবে কোনও দল৷ আর পর পর দু’বার সাংসদ হওয়ার কৃতিত্ব পাবেন রাজু৷

কোচবিহার
দার্জিলিংয়ের মতোই বিশেষ নজরে রয়েছে উত্তরবঙ্গের আরেক কেন্দ্র কোচবিহার৷ ১৯৭৭ সাল থেকে টানা আটটি লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে জিতেছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী অমরেন্দ্রনাথ রায় প্রধান৷ সব মিলিয়ে এই আসনে ১২ বার জয়ী হয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এখানে জয়ী হন তৃণমূল কংগ্রেসের রেনুকা সিং৷ ২০১৯ সালে এই আসনে জিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হন নিশীথ প্রামাণিক৷ তবে এবার তাঁর জয় খুব একটা সহজ হবে না৷

যদিও এখানকার সাতটি বিধানসভা আসনের মধ্যে পাঁচটিতেই জয়ী হয়েছেন বিজেপি প্রার্থীরা৷ ২টি রয়েছে তৃণমূলের দখলে৷ এই হিসেব এবার উল্টে যেতে পারে৷ কারণ, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে নিশীথের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছেন দলেরই একটা বড় অংশ, যা তৃণমূলকে বাড়তি ফায়দা দেবে৷

বালুরঘাট
উত্তরবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটে লড়ছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার৷ তাঁর বিরুদ্ধে লড়ছেন হরিরামপুরের বিধায়ক তথা রাজ্য মন্ত্রিসভার সদস্য বিপ্লব মিত্র৷ রয়েছেন আরএসপি-র জয়দেব সিদ্ধান্ত-ও৷ ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই আসনটিতে টানা জিতে এসেছে আরএসপি৷

২০১৪ সালে বালুরঘাট লোকসভায় প্রথমবার জয়ী হয় তৃণমূল৷ লক্ষাধিক ভোটে জয়ী হন তৃণমূল প্রার্থী নাট্যব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষ৷ দ্বিতীয় স্থানে থাকা আরএসপি তিন লক্ষের বেশি ভোট পায়৷
কিন্ত্ত গোটা ছবি বদলে যায় ২০১৯ সালে৷ আরএসপি চলে যায় তৃতীয় স্থানে৷ বিজেপি চলে আসে এক নম্বরে৷ তৃণমূলের অর্পিতাকে হারিয়ে দেন রাজনীতিতে ‘নবাগত’ সুকান্ত মজুমদার৷ ২.৮ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে সুকান্ত হারিয়ে দেন অর্পিতাকে৷ এবার আরএসপি ভোট কাটলে, সুকান্তের জয় অত্যন্ত কঠিন হবে৷ বর্তমানে এই লোকসভা কেন্দ্রের অধীন ৭টি বিধানসভার মধ্যে ৪টি রয়েছে তৃণমূলের দখলে৷ বাকি তিনটিতে বিজেপি৷ আরএসপি-এর দীর্ঘদিনের শক্ত ঘাঁটিতে এবার তৃণমূল এবং বিজেপির হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে৷

রায়গঞ্জ
উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে এবার তিন ‘দলবদলু’ প্রার্থীর মধ্যে লড়াই হচ্ছে৷ ২০১৯ সালে এই আসন থেকে জিতে বিজেপির দেবশ্রী চৌধুরী কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়েছিলেন৷ কিন্ত্ত এবার দেবশ্রী লড়ছেন কলকাতা দক্ষিণে৷ রায়গঞ্জে এ বার বিজেপি প্রার্থী করেছে তৃণমূল থেকে আসা কার্তিক পালকে৷ একটা সময়ে তিনি কালিয়াগঞ্জ পুরসভায় তৃণমূলের চেয়ারম্যান ছিলেন৷ পক্ষান্তরে, তৃণমূল প্রার্থী করেছে ২০২১ সালে বিজেপির টিকিটে রায়গঞ্জ বিধানসভা আসনে জয়ী কৃষ্ণ কল্যাণীকে৷

এবার রায়গঞ্জে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রার্থী হয়েছেন কংগ্রেসের আলি ইমরান রম্জ৷ রাজ্য রাজনীতিতে যিনি বেশি পরিচিত ‘ভিক্টর’ নামে৷ ভিক্টর প্রার্থী হওয়ায় সংখ্যালঘু ভোটের একটা অংশ ভাগাভাগি হতে পারে৷ তাতে বিজেপির কতটা লাভ হতে পারে, সেদিকেই নজর রাজনৈতিক মহলের৷

২০১৯ সালে রায়গঞ্জে বাম-কংগ্রেস জোট ছিল না৷২০০৯ সালে এই আসনে জিতে সংসদে গিয়েছিলেন দীপা দাশমুন্সি৷ প্রয়াত কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির স্ত্রী দীপা জিতেছিলেন লক্ষাধিক ভোটে৷ তার আগে পর পর দু’বার রায়গঞ্জ থেকে সাংসদ হয়েছিলেন প্রিয়রঞ্জন৷ ২০০৯ সালে দ্বিতীয় স্থানে ছিল সিপিএম৷ হাজার চল্লিশ ভোট পেয়ে বিজেপি ছিল তিন নম্বরে৷ ২০১৪ সালে সিপিএম প্রার্থী করে মহম্মদ সেলিম সামান্য ভোটে দীপাকে হারিয়ে দেন৷ ২০১৯ সালে দেবশ্রী জেতেন ৬০,৫৭৪ ভোটের ব্যবধানে৷
গত লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে বিধানসভার ৭টি আসনের মধ্যে ৪টিতে এলাকায় এগিয়ে ছিল বিজেপি৷ কিন্ত্ত বিধানসভার ভোটে জয় মেলে দু’টি আসনে – কালিয়াগঞ্জ এবং রায়গঞ্জে৷ কিন্ত্ত ওই দুই বিধায়কই (সৌমেন রায় এবং কৃষ্ণ কল্যাণী) এখন যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে৷

আলিপুরদুয়ার
আলিপুরদুয়ারে চা বাগান শ্রমিকরাই বড় ভোটব্যাঙ্ক৷ ১৯৭৭ থেকে টানা ১০ বার এই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিল বামফ্রন্টের শরিক আরএসপি৷ ২০১৪ সালে আরএসপি-কে হারিয়ে তৃণমূলের দশরথ তিরকে জয়ী হলেও, ২০১৯-এ তাঁকে হারতে হয় বিজেপির জন বার্লার কাছে৷ ২০২১-এর বিধানসভার ভোটে এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাতটি কেন্দ্রই দখল করেছিল বিজেপি৷ তবে খাতায়কলমে বিজেপি বিধায়ক হলেও, এখানকার সুমন কাঞ্জিলাল বর্তমানে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন৷ তাই এই আসনেও বিজেপি পুরোপুরি নিরাপদ নয়৷
মালদহ উত্তর

মালদহ উত্তরে এবারও প্রার্থী হয়েছেন গতবারের বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু৷ এবছর এই কেন্দ্রের তৃণমূলের টিকিটে লড়ছেন প্রাক্তন আইপিএস অফিসার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এখানে আইএসএফ-এর প্রার্থী হয়েছেন মহম্মদ সোহেল৷ বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী হলেন মোস্তাক আলম৷ গত বিধানসভার নির্বাচনে এখানে ৪টি আসনে জয়ী হয় তৃণমূল৷ বাকি তিনটি যায় বিজেপির দখলে৷

২০০৯-এ আসন পুনর্বিন্যাসে মালদহ লোকসভা কেন্দ্র ভেঙে তৈরি হওয়া এই আসনে দু’বার জয়ী হন প্রয়াত গনি খান চৌধুরীর বোনঝি কংগ্রেস প্রার্থী মৌসম নুর৷ ২০১৯-এ দল বদলে তিনি তৃণমূলের প্রার্থী হন৷ কিন্ত্ত প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক তথা বিজেপি প্রার্থী খগেন মুর্মুর কাছে হেরে যান মৌসম৷ প্রায় ৮০ হাজার ভোটে জয়ী হন খগেন৷ তাই এই আসনে এবার তীব্র লড়াইয়ের সম্ভাবনা৷
মালদহ দক্ষিণ

২০০৯-এ আসন পুনর্বিন্যাসে তৈরি হওয়া মালদহ দক্ষিণ কেন্দ্রে গত তিনটি (২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৯) লোকসভা ভোটে জিতেছেন প্রয়াত গনি খান চৌধুরীর ভাই কংগ্রেস প্রার্থী আবু হাসেম খান চৌধুরী (ডালু)৷ কিন্ত্ত ২০২১-এর বিধানসভার ভোটে মালদহ দক্ষিণ লোকসভার অন্তর্গত শমসেরগঞ্জ (যেটি মুর্শিদাবাদ জেলায় পডে়) ছাড়া অন্য কোনও বিধানসভায় ২০ শতাংশও ভোট পাননি কংগ্রেস-বাম জোটের প্রার্থীরা৷ ইংরেজবাজারে বিজেপি এবং বাকি ছ’টিতে তৃণমূল জয়ী হয়৷

২০১৯ সালে আবু হাসেম খান চৌধুরী ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন৷ ৪ লক্ষ ৪৪ হাজার ২৭০ ভোট পেয়েছিলেন আবু হাসেম খান চৌধুরী৷ বিজেপি-র শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরী পেয়েছিলেন ৪ লক্ষ ৩৬ হাজার ভোট৷ এবারও প্রার্থী হয়েছেন শ্রীরূপা৷ অন্যদিকে, কংগ্রেস প্রার্থী করেছে ঈশা খান চৌধুরীকে৷ এখানে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন শাহনওয়াজ আলি রেইহান৷

সব মিলিয়ে বলা যায়, উত্তরবঙ্গে লোকসভার ৮টি আসনের মধ্যে বেশিরভাগ কেন্দ্রেই তৃণমূলের জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে৷ তৃণমূল অন্তত ৪ থেকে ৫টি আসনে জিততে পারে৷ এবার হয়তো তৃণমূল নেত্রীর মুখে হাসি ফোটাতে পারে উত্তরবঙ্গ৷