বরুণ দাস
লোকসভা কিংবা বিধানসভার নির্বাচন নিয়ে আমজনতার মধ্যে আগে যে আগ্রহ-উদ্দীপনা ছিল, আজ যেন তার অনেকটাই ম্লান৷ সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা কমে গিয়ে হতাশা বেড়েছে৷ তারা এখন যন্ত্রের মতো ভোটের লাইনে গিয়ে দাঁড়ান এবং নিজের ভোটটাও দেন৷ কিন্ত্ত সরকার বদলালে দেশ ও দশের যে পরিবর্তন হবে এমন আশা আজ আর কেউ করেন না৷ কেন করেন না? তাঁরা বিশ্বাস করেন, ভোট তো আসলে মতাদর্শ নির্বিশেষে রাজনৈতিক দলগুলোর লাভালাভের বিষয়৷ এর সঙ্গে সাধারণ মানুষের স্বার্থের সম্পর্ক নেই৷
২০১১-তে বামফ্রন্ট সরকারকে হঠিয়ে পরিবর্তনের সরকারকে গদিতে বসিয়েছিলেন সাধারণ মানুষ৷ তারপর প্রায় ১৩ বছর অতিক্রান্ত হতে চলল৷ কতটা পরিবর্তন হয়েছে রাজ্যের? রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি করা হয় যে, উন্নয়নের বন্যা বয়ে গিয়েছে তামাম বাংলার বুকে৷ সরকার-বিরোধী নিন্দুকেরাই শুধু উন্নয়ন দেখতে পায় না৷ একশো দিনের কাজ, আবাস যোজনায় ঘর, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে চিকিৎসা, স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ বাড়াতে মিড-ডে মিলের ব্যবস্থা, ছাত্রছাত্রীদের যাতায়াতের জন্য সাইকেল, পোশাক-আশাক, স্মার্টফোন, উচ্চশিক্ষার জন্য বিনাসুদে কিংবা যৎসামান্য সুদে ঋণ (সরকার যেখানে গ্যারান্টার)-সহ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, বাবা-মায়ের মৃতু্যর পর সৎকার-ভাতা, বিধবাভাতা, বার্ধক্যভাতা— কী নেই?
এখানেই কিন্ত্ত শেষ নয়৷ আরও আছে৷ যেমন গরিব ঘরের মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার খর হিসেবে কন্যাশ্রী প্রকল্পসহ আরও নানাবিধ শ্রীপ্রকল্প তো আছেই৷ সুতরাং যাঁরা সরকারের সমালোচনা করছেন, তাঁরা আসলে এই সরকারকে মানুষের কাছে অকারণে হেয় প্রতিপন্ন করতে চায়৷ এটা জনদরদী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক অপপ্রচার৷ বাংলার মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা মাত্র৷ তাছাড়া রেশনসহ সব পুর-পরিষেবাকে মানুষের দুয়ারে এনে দেওয়াও এই সরকারের অন্যতম কৃতিত্ব৷ এর আগে কেউ এসব ভেবেছিলেন?
আপাতদৃষ্টিতে সরকার প্রচারিত কথাগুলো হয়ত পুরোপুরি মিথ্যে নয়৷ তাই ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়াও হয়ত যায় না৷ সত্যি আগে ডান-বাম কোনও সরকারই এভাবে ভেবে দেখেনি৷ হাতের কাছে সরকারি পরিষেবা পেঁৗছে দেওয়ার কথা মাথায় আসেনি সর্বহারার ‘চোখের মণি’ বামফ্রন্ট সরকারের৷ গরিব রোগীদের কথা ভেবে সরকারি হাসপাতালে ‘ফেয়ার প্রাইস’ মেডিসিন শপের কথাও ভাবেনি জনদরদী বামফ্রন্ট সরকার৷ এমনকী প্রসূতি মায়েদের হাসপাতালে পেঁৗছে দেওয়ার জন্য বিনামূল্যে অ্যাম্বুলেন্স তথা সেবাযান চালু করার কথাও৷
রাজ্যবাসীর ‘প্রাপ্তি’র তালিকায় আরও আছে৷ গোটা রাজ্যে প্রায় চল্লিশের ওপর সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল৷ এমনকী বেড়েছে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির সংখ্যাও৷ রাস্তাঘাট পাকা হয়েছে৷ অধিকাংশ পুরসভার সম্প্রসারণ হয়েছে, মাথার ওপর ঝকঝকে নতুন সাইনবোর্ড বসেছে, নীল-সাদা রং হয়েছে৷ এগুলো কি উন্নয়নের কাজ নয়? লক্ষাধিক সিভিক ভলান্টিয়ার নিয়োগ করা হয়েছে৷ নিন্দুকেরা কি এসব দেখতে পায় না? নাকি দেখতে চায় না? শুধু সমালোচনা করে এই সরকারকে হঠানো যাবে না৷ কাজের মধ্যে দিয়েই জয়ী হবে এই সরকার৷
নিন্দুকেরা অবশ্য বলেন, সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল আছে বটে কিন্ত্ত কোথাও চিকিৎসা পরিষেবার পরিকাঠামো নেই৷ নেই বিভিন্ন জরুরি বিভাগের চিকিৎসক-নার্স-টেকনিশিয়ান কিংবা পরীক্ষানিরীক্ষার যন্ত্রপাতি ও ওষুধ৷ একইভাবে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির সংখ্যা বাড়লেও যোগ্য এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাথায়ও নেই কেউ৷ অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই প্রধান শিক্ষক-অধ্যক্ষ-উপাচার্য পদ শূন্য৷ ভারপ্রাপ্তদের দিয়ে কোনওরকমে চালু রাখা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি৷ অভাব শিক্ষাকর্মীরও৷ অর্থের অভাবে প্রয়োজনীয় নিয়োগ নেই৷
অন্যদিকে কেন্দ্রের ‘বিতর্কিত’ ‘সাম্প্রদায়িক’ বিজেপি নিয়ন্ত্রিত এনডিএ সরকারের পকেটেও ‘কাজ’-এর (নাকি অ-কাজের) বেশ মোটা তালিকা আছে৷ দুর্নীতির সঙ্গে তাদের ‘জিরো টলারেন্স’-এর কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়৷ যদিও তা শুধুমাত্র ‘বিরোধীদের ক্ষেত্রে’ প্রযোজ্য বলে সবার অভিযোগ৷ বিজেপির কোনও নেতামন্ত্রীকে এযাবৎ দুর্নীতির দায়ে আটক করা হয়নি৷ বরং বিরোধী দলের যাঁরা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত, তাঁরা রাতারাতি বিজেপিতে যোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন বলে গুরুতর অভিযোগ৷
এই মুহূর্তে বিজেপি ১৭টি রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে৷ কোথাও এককভাবে, কোথাও আবার জোট বেঁধে৷ কোথাও আবার নির্বাচনে হেরেও ঘোডা কেনাবেচা করে৷ তাই কোন রাজ্যে তাঁরা কীভাবে ক্ষমতায় এসেছেন তা দেশবাসী সবাই কমবেশি জানেন৷ সুতরাং নতুন করে সেসব আলোচনায় যাওয়া হচ্ছে না৷ শুধু বিজেপির ‘কাজ-’এর কথায় আসা, যে ‘কাজ’-এর জন্য তারা তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে আসবেন বলে দাবি করছেন৷ তারা ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে দিল্লিতে নতুন সংসদ ভবন নির্মাণ করেছেন৷ যেখানে অধিক সংখ্যক সাংসদেরা বসতে পারবেন৷
তাঁরা জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা তুলে দিয়েছেন৷ এছাড়া ৩৫এ ধারারও অবলুপ্তি ঘটিয়েছেন৷ কাশ্মীর ভারতের ‘অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’ কথাটির যথার্থ বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন৷ এটা নাকি একদিকে যেমন ‘সন্ত্রাসমুক্ত কাশ্মীর’ গড়ে তোলার অন্যতম শর্ত, অন্যদিকে সমগ্র ভারতবাসীর জন্যই কাশ্মীরকে ‘উন্মুক্ত’ করে দেওয়াও লক্ষ্য৷ তাছাড়া জম্মু-কাশ্মীর আর লাদাখকে আলাদা করে দিয়েছেন৷ ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘স্বপ্ন’কে বাস্তবায়িত করেছেন৷ যা জাতীয় কংগ্রেস কিংবা অন্য কোনও রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার ছিয়াত্তর বছরেও পারেনি৷ পারতও না৷
এছাড়া কাজের খতিয়ান হিসেবে তিন তালাক বিল পাশ করেছে যা সংখ্যালঘু মহিলাদের মুক্তি দিয়েছে৷ তাঁরা বৈবাহিক জীবনের যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছেন৷ এবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থে কেন্দ্রীয় স্তরে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নের জন্য প্রয়াস নিচ্ছেন৷ যে বিধি বিজেপি-শাসিত উত্তরাখণ্ডে ইতিমধ্যেই লাগু হয়ে গেছে৷ তাঁরা রামমন্দির নির্মাণ করেছেন৷ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের মনের বাসনাকে বাস্তবরূপ দিয়েছেন বলে দাবি তাদের৷ নির্বাচনী ইস্তাহারে যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তার সবগুলোই করে দেখানোর ‘সাহস’ দেখিয়েছেন৷
তাঁরা সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের বালাকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছেন৷ ‘শত্রুদেশ’কে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছেন৷ প্রয়োজনে আবারও দেবেন৷ দেশকে ‘সুরক্ষা’ দিতে তারা পিছপা নয়৷ দেশের নিরাপত্তা তাদের কাছে অগ্রাধিকার পায় বলে জোরালো দাবি তাদের৷ দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে তারা আপসে রাজি নয়৷ এতসব কাজের পর আসন্ন লোকসভার অষ্টাদশ নির্বাচনে তারা নিজেরা ৩৭০সহ এনডিএ জোটের মিলিত আসন সংখ্যা ৪০০-তে নিয়ে যেতে ভীষণভাবেই বদ্ধপরিকর৷ গোটা দেশজুড়ে এমনই একটা জোরালো প্রচার চলছে তাদের তরফে৷
বিরোধীরা তাঁদের বিরুদ্ধে ‘দেশকে বেচে দেওয়া’র গুরুতর অভিযোগ এনেছেন৷ তাতে কোনও আমলই দিচ্ছে না কেন্দ্রের বিজেপি সরকার৷ তাদের বিশ্বাস, ব্যবসায়ীরাই হল জাতির মেরুদণ্ড৷ দেশের উন্নয়নে তাদের ভূমিকাকে ছোট করে দেখার দিন শেষ৷ কংগ্রেস আম্বানিদের গুরুত্ব দিয়েছে, তার না হয় আদানিদের গুরুত্ব দিচ্ছে৷ এতে আপত্তির কী আছে? কেউ না কেউ তো শিল্পোন্নতির কাজ (সরকারি বরাত) করবেই৷ এ নিয়ে বিরোধীদের নাবালোকচিত হইচইয়ের কী কারণ আছে? তাদের প্রশ্ন, শুধু বিরোধিতার জন্যই কি বিরোধিতা?
হিন্দু-মুসলমান বিভেদ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ধর্মীয় মেরুকরণ, লাভজনক সরকারি সংস্থার বেসরকারিকরণ, দেশের স্বাধীন কিংবা স্বশাসিত সংস্থাকে দলীয় নিয়ন্ত্রণে আনার আপ্রাণ চেষ্টা, বিচারবিভাগকে বাগে আনার গোপন কর্মকাণ্ড— এসব বিরোধীদের অপপ্রচার মাত্র৷ বিজেপি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী৷ ক্ষমতায় আসার পর তাদের অবিসংবাদী নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী মোদিজি সিঁড়িতে মাথা ঠেকিয়ে সংসদ ও গণতন্ত্রকে উপযুক্ত সম্মান জানিয়েছেন৷ যা আগে কেউ দেয়নি৷ তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধীদের কোনও অপপ্রচারই হালে পানি পাবে না বলে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস৷
প্রাজ্ঞ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক কিংবা বিরোধীপক্ষের রাজনীতিকেরা যে যাই বলুন না কেন, জাতীয় ও রাজ্যস্তরের মিডিয়ার লাগাতার প্রচার আর গোছানো প্যাকেজিংয়ের জোরে রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস এবং কেন্দ্রের বিজেপি নিয়ন্ত্রিত এনডিএ পুনরায় নিজেদের অবস্থান অটুট রাখতে সমর্থ হবেন বলেই অনেক অরাজনৈতিক মানুষের বিশ্বাস৷ লোকসভার আসন হয় কিছু কমবেশি হতে পারে মাত্র, কিন্ত্ত বাংলা কিংবা দিল্লির শাসন ক্ষমতা থেকে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির বিচু্যত হওয়ার তেমন কোনও সম্ভাবনাই দেখতে পাচ্ছেন না এ রাজ্যের সাধারণ মানুষ৷
এ রাজ্যের অরাজনৈতিক মানুষের কেন এই ধারণা? আসলে দল-রাজনীতি যেমন তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের পথকে সুগম করবে, তেমনি কাশ্মীর আর রামমন্দির বিজেপিকে৷ এমনকী তিন তালাক আর অভিন্ন দেওয়ানি বিধিও৷ যে কারণেই হোক অপ্রিয় সত্যি হল, এদেশের অধিকাংশ সংখ্যাগুরু মানুষের (শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, ধনী কিংবা গরিব, উঁচু কিংবা নিচু সম্প্রদায়) মনের মধ্যে যে সুপ্ত বিদ্বেষভাব লুকিয়ে আছে, তাকে সুনিপুণভাবে উস্কে দিয়েছে বিজেপি এবং তাদের প্রধান দোসর সংঘ পরিবার৷ এটা একদিনের কাজ নয়৷ দীর্ঘদিনের চেষ্টার ফল৷
একে ‘নরম হিন্দুত্ব’ দিয়ে রুখে দেওয়া যাবে না৷ বিজেপির এই প্রচেষ্টাকে পরোক্ষে ইন্ধন জুগিয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি৷ যে পাল্টা রাজনীতি দিয়ে একে রুখে দেওয়া যেত, সে রাজনীতির ধারে কাছেও কেউ ঘেঁষতে আগ্রহী নন৷ আসলে ভোটসর্বস্ব রাজনীতির শিকার ডান-বাম-অতিবাম সবাই৷ একে আপনি অস্বীকার করবেন কীভাবে? সস্তা ও নোংরা রাজনীতির সুে.গ নিয়েছে শুধু বিজেপি নয়, বিজেপি-বিরোধীরাও৷ রাজনৈতিক মানদণ্ড তথা ন্যায়-নীতি-আদর্শ ভুলে কেবল দলীয় রাজনীতিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে এই বিপত্তি ঘটিয়েছেন তাঁরা৷
এই সারসত্যকে অস্বীকার করা চলবে কেন? দিনের পর দিন শুধু বিজেপি-জুজু দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে ভুলপথে চালিত করার রাজনৈতিক অপচেষ্টা এবার বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে৷ কমিউনিস্ট আদর্শকে দূরে সরিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার বাম-রাজনীতি এজন্য অনেকটাই দায়ী৷ তারা এ পাপ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করলেও রেহাই পাবেন না৷ ডানপন্থীরা দায় এড়াতে পারলেও বামপন্থীরা পারেন না৷ কারণ সমাজ বদলের স্লোগান তাদেরই৷ যেনতেনপ্রকারেণ ক্ষমতায় টিকে থাকার অপ-রাজনীতির মধ্যে কমিউনিস্ট আদর্শকে মেলানো যায় না৷