উত্তরপ্রদেশ এক নজরে: মোদির ঘৃণা ভাষণই ফিরল বুমেরাং হয়ে

সৈয়দ হাসমত জালাল

এবার এপ্রিল মাসের শেষ দিকে উত্তরপ্রদেশ গিয়েছিলাম দিন পাঁচেকের জন্যে৷ তার মধ্যে দুটো দিন ছিলাম এই রাজ্যের রাজধানী লখনউ শহরে৷ তখন লোকসভা নির্বাচনের হাওয়া শুরু হয়েছে দেশজুড়েই৷ স্বাভাবিকভাবেই আদিত্য যোগীর রাজ্যে গিয়ে এ বিষয়ে জানার কিছুটা কৌতূহল তো ছিলই৷
রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা কথা চালু আছে যে, দিল্লি পৌঁছতে হয় উত্তরপ্রদেশের পথ দিয়ে৷ অর্থাৎ দিল্লিতে ক্ষমতায় বসতে হলে দেশের সর্ববৃহৎ রাজ্য উত্তরপ্রদেশের বড়ো সংখ্যক আসনে জিততে হবে৷ এবার বিজেপির পক্ষ থেকে হাওয়ায় এরকম কথা ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, ‘দেশ মেঁ মোদি ঔর ইউপি মেঁ যোগী’৷ অর্থাৎ দেশের নেতৃত্বে থাকবেন নরেন্দ্র মোদি আর উত্তরপ্রদেশে নেতৃত্বে আদিত্য যোগী৷ বিশেষ করে এবার অযোধ্যায় রামমন্দির থেকে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিজেপি এবং স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি যেভাবে বারবার খবরের শীর্ষে এসেছেন, যেভাবে হিন্দু-আবেগকে নির্বাচনে কাজে লাগাতে চেয়েছেন, উত্তরপ্রদেশের মানুষের মনে তার প্রতিক্রিয়া ঠিক রকম, বুঝতে চেয়েছিলাম৷

দু’দিন ধরে লখনউয়ের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছিলাম৷ তাঁরা হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ যেমন ছিলেন, তেমনই ব্রাহ্মণ ও তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষও ছিলেন৷ তখনই একটা কথা স্পষ্টই উপলব্ধি করেছিলাম যে, এবার নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের লোকসভা নির্বাচনে বিজপির আসন সংখ্যা কমবে৷ কলকাতায় ফিরে ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক বন্ধুদের বলেওছিলাম সে কথা৷


লখনউয়ের আমার প্রথম দিনের গাড়ির চালক ছিলেন একজন প্রৌঢ়৷ তিনি অত্যন্ত আস্থার সঙ্গে বলেছিলেন, এবার বিজেপির ভোট কমবেই, কমবে৷ কারণ হিসেবে বলেছিলেন, কথায় কথায় যোগীর বুলডোজার চালানো, ভুয়ো এনকাউন্টারে মানুষকে মেরে ফেলা সাধারণ মানুষকে আতঙ্কগ্রস্ত করে রেখেছে৷ যদিও মানুষ তা প্রকাশ্যে বলে না৷ দ্বিতীয়ত, অযোধ্যা থেকে লখনউ সর্বত্রই হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে থেকেছে বরাবরই৷ তাঁরা নিজেদের মধ্যে কখনওই লড়াই-ঝগড়া করেনি৷ আপনি লখনউ ঘুরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন৷ কিন্ত্ত যোগী এবং মোদি যেভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে, তা সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছে না৷ কিন্ত্ত একথা বলার সাহস নেই৷

গিয়েছিলাম লখনউয়ের ভুলভুলাইয়া দেখতে৷ সেখানে গাড়ি পার্ক করে রেখে টোটো-তে এলাকাটা ঘুরেছিলাম৷ গোমতী নদী পেরিয়ে একটি বড়ো মুসলিম এলাকা৷ লখনউয়ের চিকনের কাজ খুব বিখ্যাত৷ এই চিকনকারির কাজের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ মানুষই মুসলিম সম্প্রদায়ের৷ একটি সুসজ্জিত দোকানে ঢুকলাম৷ সেখানে বেশির ভাগই মহিলা কর্মচারী যাঁরা ক্রেতাদের শাড়ি, কুর্তা, পাঞ্জাবি ইত্যাদি দেখাচ্ছেন, বিক্রি করছেন৷

আমার স্ত্রী ছিলেন সঙ্গে৷ স্বাভাবিকভাবেই ওখানকার কর্মচারী এক ভদ্রমহিলা একের পর এক শাড়ি দেখাচ্ছিলেন তাঁকে৷ সেই সঙ্গে নানান গল্প৷ আমিও খানিকটা যোগ দিচ্ছিলাম৷ আমার জন্যেও দুটো চিকনের কাজ করা পাঞ্জাবি তিনি ধরিয়ে দিলেন আমার স্ত্রীর হাতে৷ কলকাতা থেকে এসেছি শুনে মাঝে মাঝে দু-একটা বাংলা কথাও বলছিলেন৷ বললেন, কলকাতার পার্কসার্কাস এলাকায় তাঁর আত্মীয়রা আছেন৷ একটা সময় নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুললাম৷ ততক্ষণে খানিকটা সহজ হয়েছেন বছর বিয়াল্লিশ-চুয়াল্লিশের ওই ভদ্রমহিলা৷ বললেন, দোকান থেকে বেরিয়ে চারপাশটা দেখলেই বুঝবেন, কোনও উন্নয়ন হয়েছে কিনা৷ মুখ্যমন্ত্রী যোগী যেভাবে কথা বলেন, তাতে সবসময় আতঙ্কে থাকেন এখানকার মুসলিমরা৷ পুরো এলাকাটা টোটোতে ঘুরে দেখলাম৷ ভদ্রমহিলার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি৷ লখনউয়ের অন্যান্য এলাকার সঙ্গে তফাৎটা সহজেই চোখে পড়ে৷ টুকটাক কথা জানাচ্ছিলেন টোটোচালকও৷

এক প্রবীণ রমেশ শর্মা কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন উত্তরপ্রদেশের, বিশেষত লখনউয়ের রাজনৈতিক অবস্থার কথা৷ তিনি নিরপেক্ষভাবেই তাঁর মতামত দিচ্ছিলেন৷ বিজেপিই জিতবে ইউপি-তে৷ তবে শেষে বললেন, দেখবেন মোদি যদি সরে যায় কোনও কারণে, তাহলে ইউপি-তে বিজেপির অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে৷
বছর তিরিশের যুবক অনিল, পরের দিন আমার ভাড়া গাড়ির চালক৷ খুব স্পষ্ট তাঁর কথা৷ মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করেছেন৷ গ্যাসের দাম, তেলের দাম যা বেড়েছে, ঘরের খরচ সামলানোই মুশকিল৷ এ নিয়ে মোদি-যোগী কারওরই কোনও কথা নেই৷ একটু টোকা দিতেই অনিল বলেন, আমাকে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরা কে শিখিয়েছে জানেন? জামিরুদ্দিন৷ আমি ওর বিরুদ্ধে কখনও যাব?

আসলে মোদি-যোগীর ঘৃণা ভাষণ সাধারণ মানুষ গ্রহণ করছিল না, সেটা বিজেপি বোঝেনি৷ কোনও কর্মসংস্থানের কথা নয়, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি রোধের কথা নয়, শিক্ষার কথা নয়, শুধু হিন্দু-মুসলমান করে তো মানুষ বেঁচে থাকতে পরে না৷

আর তাই স্মৃতি ইরানির মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, আগের বারের সাংসদ, হেভিওয়েট প্রার্থী প্রায় এক লক্ষ ৬৭ হাজার ভোটে আমেথিতে হেরে গেলেন কংগ্রেসের কিশোরীলাল শর্মার কাছে৷ খেরি কেন্দ্রে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্র ‘টেনি’ হারলেন সমাজবাদী পার্টির উৎকর্ষ বর্মা ‘মাধুর’-এর কাছে৷ আর যে অযোধ্যা নিয়ে মোদি-যোগীর এত ঢাকঢোল পেটানো, সেই ফৈজাবাদ কেন্দ্রের বিদায়ী সাংসদ প্রার্থী লাল্লু সিং হেরে গেলেন সমাজবাদী পার্টির অবধেশ প্রসাদের কাছে৷ কৈরানাতে ইকরা হাসান, কৌশাম্বীতে পুষ্পেন্ড সরোজা বা মছলিশহরে প্রিয়া সরোজের মতো সমাজবাদী পার্টির নতুন প্রার্থীরা জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন৷ সুলতানপুর কেন্দ্রে বিজেপির বিদায়ী সাংসদ হেভিওয়েট প্রার্থী মানেকা গান্ধি হারলেন সমাজবাদী পার্টির রামবহাল নিশাদের কাছে৷ এছাড়া ধৌরাহা কেন্দ্রে বিজেপির জাতীয় সহ-সভাপতি এবং আগের বারের সাংসদ রেখা বর্মার পরাজয় অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ঘটনা৷ তিনি হেরেছেন সমাজবাদী পার্টির আনন্দ ভাদুয়ারিয়ার কাছে৷ সর্বোপরি রাহুল গান্ধি রায়বেরিলি থেকে জিতেছেন চার লক্ষ ভোটে৷

আসলে ক্ষমতার দম্ভে সাধারণ মানুষের কথা শোনার প্রয়োজনই মনে করেননি বিজেপি নেতারা৷ তাঁরা ভেবেছিলেন মোদি-যোগী যখন আছেন, তখন কিসের চিন্তা৷ লজ্জার কথা, স্বয়ং মোদিই প্রথম তিন রাউন্ডের গণনায় ৬ হাজারেরও বেশি ভোটে পিছিয়েছিলেন৷ মোদি জিতবেন, এ তো বলার অপেক্ষা রাখে না৷ কিন্ত্ত এরকম অবস্থাও তো তাঁকে দেখতে হলো৷

ভারতের অধিকাংশ মানুষই ধর্মবিশ্বাসী, তাঁরা নিজেদের মতো ধর্মাচরণ করে থাকেন ঠিকই৷ কিন্ত্ত ধর্ম নিয়ে সংঘর্ষ, বিদ্বেষ শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ চান না৷ আর সে কারণেই উত্তরপ্রদেশে এবার নির্বাচনে ধাক্কা খেল বিজেপি৷