মৃণাল কুমার বিশ্বাস
আমাদের দেশ দ্রুত আর্থিক উন্নতির দিকে যাচ্ছে বলে আজকাল অনেক কথা শোনা যায়৷ তার স্বপক্ষে সাম্প্রতিক সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লেখচিত্র প্রকাশ করেছে ভারত সরকারেই অর্থমন্ত্রক৷
মন্ত্রকের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা হলেন এন অনন্ত নাগেশ্বরণ৷ তিনি লিখেছেন, পরের ছয় কিংবা সাত বছরে দেশের অর্থনীতির ভার ৭০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে পেঁৗছে যাবে৷ তাঁর কথা হল, ২০২৪-২৪ অর্থবর্ষে ভারতের প্রবৃদ্ধি যদি দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মূল্যের সমপরিমাণ তবে নিশ্চয়ই সেটা এক উল্লেখযোগ্য উন্নতি বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে৷ আশা রাখা হচ্ছে, জাতীয় পরিসংখ্যান সংগঠন (Natioanl Statistic Organization) দেখাচ্ছে ২০২২-২৩ সালের ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হিসেব এবং এ বছরে ৭.৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে প্রায় নিশ্চিত৷ ২০২১-২২ প্রবৃদ্ধি ছিল ৮.৭ শতাংশ৷
আনন্ত নাগেশ্বরণ তাঁর লেখার ভূমিকায় বলেছেন দেশের যুব সম্প্রদায় তাদের জীবৎকালেই উন্নততর অবস্থায় নিজেদেরকে নিয়ে যেতে পারবেন৷ তাঁর প্রত্যাশা ভারত ক্রমেই একটা নড়বড়ে বা ভঙ্গুর অর্থনীতি থেকে সুস্থিত অর্থনীতিতে পরিণত হবে এবং শেষপর্যন্ত শক্তি ভিত্তিতে পরিণত হবে৷
বিশ্ব পরিস্থিতি তুলনা করে তিনি দেখিয়েছেন, যখন ভারত ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে তখন খুব কষ্টেসৃষ্টে বিশ্ব অর্থনীতি ২ শতাংশ মাত্র প্রবৃদ্ধি দেখাতে পেরেছে৷ ঠিক সেইভাবে ভারতের প্রবৃদ্ধি যখন ৮.৯ শতাংশ তখন বিশ্বজুড়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৪ শতাংশ৷
শুধু ভারত সরকার নয়, অন্য এক সংস্থা ক্রিশিলের মাপন (রেটিং) অনুযায়ী ২০৩১ সালে এই দেশের অর্থনীতি দ্বিগুণ হয়ে ৭০ হাজার কোটি ডলারে পেঁৗছে যাবে৷ অর্থাৎ বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে দেখা দেবে ভারত৷ তার অর্থ হল দেশের লোক উচ্চ মধ্যবিত্ত আয়ের দরজায় উঠে আসবে৷
ক্রিশিলের হিসেব অনুযায়ী, বর্তমান অর্থবর্ষে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার ৭.৮ শতাংশ বা তার থেকেও বেশি হতে পারে৷ এর ফলে ২০২৫ সাল থেকে প্রবৃদ্ধির হাল ৬.৮ শতাংশে সুস্থিত হবে৷ পরের সাত বছর (২০২৫-২০৩১) ভারতের অর্থনীতি ৫০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হবে৷ সেটা হলেই আমাদের দেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পেঁৗছে যাবে৷ লক্ষ্যণীয় যে, ২০২৩-এর অক্টোবর-ডিসেম্বর, এই তিন মাসে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮.৪ শতাংশ৷
সম্প্রতি দাভোসে মার্কিন বিদেশসচিব অ্যান্টনি ব্লিনকিন বলেছেন, ভারত মোদির নেতৃত্বে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে৷ তার ফলে বহু ভারতবাসী বেশ উপকৃত হয়েছে৷ ব্লিনকিন অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথাই বলেছেন৷
এতসব উৎসাহজনক কথাবার্তার মধ্যে ভুলে যাওয়া হচ্ছে বা ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, ভারতের এই তথাকথিত উন্নতি আসলে ‘ডেড ক্যাট বাউন্স’-এর লক্ষণ৷ এর মানে অর্থনীতি কোনও কারণে খুব তলানিতে যাবার পর গাঝাড়া দিয়ে ওঠার পর উন্নতির পথে চললে তাকে তাই বলা হয়৷ তবে সেটা সুস্থায়ী হয় কিনা সেই সন্দেহ থেকেই যায়৷ ভারতের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে তা হল অতিমারির পর অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয় এবং সেটা অদূর ভবিষ্যতে বজায় থাকবে বলে ধরা হচ্ছে৷
তা সত্ত্বেও কোভিড কালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৩.৫ শতাংশ৷ মোদি রাজত্বের পরে অগ্রগতি হলেও বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম এবং চিনের থেকেও সেটা নেমে যায়৷ তখন দেখা গেল মোদি রাজত্বে অগ্রগতি আশানুরূপ না হয়ে ৭ শতাংশের মতোও থাকছে না৷ শিল্পে উন্নতি, বিদেশি লগ্নি, অভ্যন্তরীণ লগ্নি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে দেশের প্রবৃদ্ধি পেতে থাকে৷ কিন্ত্ত সেটা অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়নের সূচক বলে দেখানো যাচ্ছে না৷
কারণ লোকের কর্মস্থানের সুযোগ সঙ্কুচিত হতে থাকে এবং ক্রয়ক্ষমতা কমে যেতে থাকে৷ আজকের ভারতে ৪৫ কোটি সক্ষম দেশবাসী কর্মহীন, অবশিষ্ট ২৮ কোটি ভারতীয়র মধ্যে ৪৬ শতাংশ কৃষিক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে৷ সেক্ষেত্রে চিন এবং ভিয়েতনামে যথাক্রমে ২৪ শতাংশ এবং ২৭ শতাংশ কৃষিকাজে নিযুক্ত রয়েছে৷
কাজের বাজারে দ্রুত পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে বা আরও ঘটতে পারে৷ মূল কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আক্রমণ৷ এর ফলে বেশিরভাগ মানুষ ক্রমশ দরিদ্র হচ্ছে, কর্মহীন হয়ে বেকার শ্রেণিতে পরিণত হচ্ছে৷
অন্যদিকে দেশের ১০ শতাংশ মানুষ কোটিপতি হয়ে অধিক আয়ের মাত্রায় চলে আসছে৷ এই ১০ শতাংশ অতি ধনীরা দেশের মোট আটের ৫৭ শতাংশ নিজেদের কব্জায় নিয়ে এসেছে৷ এরাই দেশের ৭৭.৪ শতাংশ সম্পদের অধিকারী হয়ে উঠেছে৷ দেশের তলানিতে থাকা ৫০ শতাংশ মানুষ সর্বমোট সম্পদের ৩ শতাংশ মাত্র উপভোগ করতে পারে এবং তাদের আয় ১৩ শতাংশের ওপরে যায় না৷ বলা বাহুল্য, সমাজবাদের ধ্যানধারণা থেকে শাসকেরা যোজন দূরে থেকেছেন এবং থাকছেন৷