চতুর্থ দফা ভোটের শেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কণ্ঠে অন্য সুর৷ মানুষ যে প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে ইসলাম বিরোধী মন্তব্য আর পছন্দ করছে না, তা বুঝেই পাল্টি খেয়েছেন মোদি৷ সংখ্যালঘু ভোটারদের মন জিততে এবার তৎপর হলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি৷ গত চার পর্বে তাঁর ভাষণের একেবারে উল্টো পথে হেঁটে হঠাৎই তিনি বললেন, হিন্দু-মুসলিম নিয়ে তিনি বিভেদ করেন না৷ যদি এসব তিনি করেন, তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী বা সাংসদ-বিধায়কের মতো পদে থাকবেন না৷ বললেন, ‘আমি যেদিন হিন্দু-মুসলমান করবো, সেদিন আমি সার্বজনিক জীবনে থাকার যোগ্য থাকবো না৷ আমি হিন্দু-মুসলমান করবো না৷ এটা আমার সংকল্প৷’ নিজের কেন্দ্র বারাণসীতে নির্বাচনী প্রচারে কথাগুলি বলেছেন নরেন্দ্র মোদি৷
লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রচারে বিকাশ ও আমিত্বের ছোঁয়া ছিল প্রধানমন্ত্রী মোদির গলায়৷ কিন্ত্ত যত সময় এগিয়েছে, বিকাশ ছেড়ে তিনি মন দিয়েছেন ধর্মীয় সুড়সুড়ি ও সাম্প্রদায়িক প্রচারে৷ কংগ্রেসকে আক্রমণ করতে গিয়ে বারেবারেই বলেছেন, সংখ্যালঘু তোষণের পথে হাঁটছে শতাব্দী প্রাচীন দল৷ এমনকি কংগ্রেস সরকারে এলে মুসলিমরা বাড়তি সুবিধা পাবে বলে অভিযোগ ছিল প্রধানমন্ত্রীর৷ কখনও মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেওয়া আবার কখনও সম্পত্তি মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়েছেন৷ কখনও আবার বলেছেন, রামমন্দিরে তালা ঝুলিয়ে দেবে কংগ্রেস৷ আবার বলছেন, ওদের ইস্তেহার দেখে মনে হচ্ছে মুসলিম লিগের৷ বিরোধীদের সমালোচনা করতে গিয়ে বারে বারে টার্গেট করেছেন ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের৷ তবে দেশবাসী যে আর মেরুকরণের অস্ত্রে বিদ্ধ হচ্ছেন না, তা টের পেয়েছেন পদ্ম শিবিরের শীর্ষ নেতৃত্ব৷ তাই ঠেলায় পড়ে বোধোদয় হয়েছে মোদির৷ এখন বলছেন, ‘কে আপনাদের বলেছে মুসলমানরা বেশি সন্তান জন্ম দেন৷ কেন ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রতি এই অবিচার? দরিদ্র পরিবারেই এমন সদস্যা আছে৷ তাঁরা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারেন না৷ আমি কোনও হিন্দু-মুসলিম বলিনি৷ শুধু বলেছিলাম বাচ্চাদের ভালো করে মানুষ করো৷ দরিদ্রদের কথা মাথায় রেখে বলেছিলাম৷ কোনও দিন হিন্দু-মুসলমান বিভাজন করিনি৷ করবো না৷ এটা আমার অঙ্গীকার৷’
এমন ঘোষণার পর নেটিজেনরা মনে করিয়েছেন একটি প্রবাদ বাক্যের কথা৷ সেটি হল: ‘সও চুহে খা কে বিল্লি চলি হজ কো৷’
যে কোনও যুগে বা যে কোনও দেশে স্বৈরাচারী শাসকরা মানুষের মঙ্গল করতে পারেন না৷ এটা ইতিহাসে বারবার প্রতিষ্ঠিত৷ সোনার দেশ গড়তে মানুষকে বড় দায়িত্ব নরেন্দ্র মোদির হাতে তুলে দিয়েছিল, তিনি তা পালন করতে পারেননি৷ উল্টে দশ বছরে দেশের অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে৷ অর্থনীতি, শিক্ষা, চাকরি, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা, গণতন্ত্র, সংবিধান সব লাটে তুলে দিয়ে তিনি হিন্দুত্বের জপমালা জপছেন৷ একনায়কতন্ত্র মানসিকতা নিয়ে বিরোধী রাজনীতিকে ধ্বংস করার খেলা খেলছেন৷ আর সর্বত্র অসত্য প্রচার করে মানুষের মন জয় করার চেষ্টা চালাচ্ছেন৷
সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি বা সিএমআইই’র সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে দেখা গিয়েছে এদেশের ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে কাজ করার বয়স রয়েছে ১১০ কোটি মানুষের৷ এদের বলা হয় ওয়ার্কিং এজ গ্রুপ৷ এই সংখ্যার মধ্যে ৬৮ কোটি মানুষ বেকার৷ বাকিদের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষের যা আয়, তাতে দু’বেলা পেট ভরে না৷ ওই হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, গত আট বছরে অর্থাৎ মোদি জমানায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাঁদের চাকরি হারিয়েছেন৷ অর্থাৎ যিনি বছরে দু’কোটি চাকরি দেওয়ার ধাপ্পা দিয়েছিলেন, তিনি বাস্তবে গড়ে বছরে এক কোটি মানুষের চাকরি খেয়ে নিয়েছেন৷ এর ফল হল মারাত্মক৷ মোদির মন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই সংসদে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, দেশে ৯ হাজারেরও বেশি যুবক চাকরি না পেয়ে অবসাদে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন৷ মোদির ব্যর্থতা একটা প্রজন্মকে ক্রমেই মৃতু্যর দিকে ঠেলে দিচ্ছে৷
ভোটপর্ব প্রায় শেষ হয়ে আসছে৷ হাওয়া যে বদলাচ্ছে, তা মোদির দলবলও বুঝতে পারছে৷ তাই তাঁকেও বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছে৷ বিভিন্ন মঞ্চে উল্টোপাল্টা বলা শুরু হয়ে গিয়েছে৷ কখনও বলছেন মেরুকরণের কথা বলেননি, আবার কখনও বলছেন তিনি সম্প্রীতির কথাই তুলে ধরছেন৷ শোনাচ্ছেন ছেলেবেলার গল্প, যা এতদিন শোনা যায়নি৷ ২০০২ সালে অযোধ্যা ফেরত সবরমতী এক্সপ্রেসে আগুনে মৃতু্যর ঘটনার জেরে গুজরাতে মুসলিমদের গণহত্যা চালানো হয়েছিল সরকারি মদতে বা পরিকল্পিত নিষ্ক্রিয়তায়৷ তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি৷ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁকে ‘রাজধর্ম’ পালনের পরামর্শ দিয়েছিলেন৷ সেই মোদির দাবি, গোধরার ঘটনার পর তাঁর ভাবমূর্তি খারাপ করা হয়েছে৷ ভাবখানা এমন, যেন তিনি কিছুই করেননি৷ সবই বিরোধীদের বানানো৷
পরিস্থিতির চাপে পড়ে মোদির এখন পাল্টি খাওয়া তাঁর বোধোদয় হয়েছে বললে ‘লঘু’ করে দেখা হয়৷ বোধোদয়ের মুখোশটাও সময় এলেই খুলে পড়বে৷ রাজনৈতিক মহলের এমনটাই ধারণা৷