প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মুখে যা বলেন, তা করেন না এবং যা করেন মুখে তা বলেন না৷ তাঁর আাসল আস্থা রকমারি চমকে৷ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বুঝতে পারেন না কে কতক্ষণ কোন দলে রয়েছেন৷ নির্বাচিত বিরোধী রাজ্য সরকারগুলিও তাদের আয়ু কতক্ষণ থাকবে, তা বুঝে উঠতে পারেন না৷ মিডিয়া, প্রতিবাদী, বিরোধী এবং সংখ্যালঘু শ্রেণিকে স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্রতার সংজ্ঞা রোজ নতুন করে শেখানো হচ্ছে৷ তথ্যের যুগে, বিশ্বায়নের সময় খবর কি শুধু ভারতের সীমানা? আটকে রাখা সম্ভব? দুনিয়াময় হয়ে যায় নিমেষেই৷ তাই পশ্চিমি দুনিয়া ভারতকে ইতিমধ্যেই ‘টপ ১০ অটোক্রেটাইজিং কান্ট্রি’র মধ্যে রেখেছে৷ ভারতের গণতন্ত্রকে ‘ইলেক্টোরাল অটোক্রেসি’ বলতেও তারা দ্বিধা করে না৷
অষ্টদশ লোকসভা গঠনের দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই মোদিতন্ত্রের মুখোশ খুলে যাচ্ছে৷ দেশজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মোদি সরকারের এজেন্সিগুলি৷ সিবিআই, ইডি, আইটি, এনআইএ, এসএফআই ও এনসিবি ইত্যাদি এজেন্সিগুলি নিজেদের দক্ষতা প্রমাণে যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে৷ একাধিক বিরোধী দলের নেতা, জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীকেও পর্যন্ত জেলে ভরে দিয়েছে, শুধু খুঁজে পাচ্ছে না গেরুয়া শিবিরের নেতা-মন্ত্রীদের দোষ-ত্রুটি-দুর্নীতি৷ ৩১ জানুয়ারি ২০২৪ ইডি’র হাতে গ্রেফতার হয়েছেন ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন৷ একই এজেন্সি আবার ২১ মার্চ গ্রেফতার করল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে৷ কেজরিওয়াল আম আদমি পার্টির ন্যাশনাল কনভেনার এবং বিরোধী দলগুলির মহাজোট ‘ইন্ডিয়া’র গুরুত্বপূর্ণ নেতা৷ দেশে সাধারণ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে গ্রেফতারে কুণ্ঠিত হয়নি মোদি সরকার৷ এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সহ একাধিক রাজ্যে জারি রয়েছে এজেন্সিরাজের আভিযান তৎপরতা এবং তা অবশ্যই বিরোধী দলগুলিকে লক্ষ্য করেই৷ সব মিলিয়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে দেশজুড়ে৷ কেউ কেউ এর মধ্যে ইন্দিরা গান্ধির ইমারজেন্সির ছায়া দেখতে পেয়েছেন৷ বিদেশের মাটিতেও এই ঝড় আছড়ে পড়েছে৷ বিদেশের একাধিক নামি মিডিয়া ফলাও করে পরিবেশন করেছে এই বিষয়ে একাধিক খবরাখবর৷ এমনকি জার্মানির মতো ভারতের বন্ধু দেশও কেজরিওয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে মোদি সরকারের বিড়ম্বনা বাড়িয়ে তুলেছে৷ যদিও ‘ভারতের নিতান্ত অভ্যন্তরীণ বিষয়’ বলে বিদেশমন্ত্রক বিষয়টিকে লঘু করতে চাইলেও দুনিয়াময় পৌঁছে গিয়েছে মোদি সরকারের এজেন্সিগুলির তৎপরতার খবর৷ গালভরা বৃহত্তম গণতন্ত্রের কঙ্কালসার চেহারা এবং স্বঘোষিত বিশ্বনেতার দ্বিচারিতা প্রকাশ্যেই এসে পড়েছে৷
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই মোদি নিজেকে দেশের ‘চৌকিদার’ বলেছিলেন৷ মোদির প্রতিশ্রুতি ছিল, এই গণতন্ত্রকে রক্ষা করার দায়িত্ব তাঁর, গণতান্ত্রিক দুনিয়াকে ভারতই নেতৃত্ব দেবে৷ ‘গণতন্ত্রের মন্দির’ বলে নতুন সংসদ ভবনের সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করেন প্রধানমন্ত্রী মোদি৷ তাঁর জমানাতেই ঐতিহাসিক সংসদ ভবনটি বাতিল করে তিনগুণে বড় সংসদ ভবনটি গড়ে উঠেছে ২০ হাজার কোটি টাকার ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’ প্রকল্পের অধীনে৷ মাত্র ২১ মাসে ৬৫ হাজার বর্গফুটের এই ভবনটি তৈরি হয়েছে ৯৪০ কোটি টাকায়৷ ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশের সংসদ ভবন উদ্বোধন হয়েছিল সম্পূর্ণ হিন্দু ধর্মীয় রীতিতে৷ আরএসএস নির্দেশিত হিন্দুত্বের প্রদর্শনী হিসেবে অনুষ্ঠানটিকে তুলে ধরা হয়েছিল৷ রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকেও ব্রাত্য করে রাখা হয়েছিল এই অনুষ্ঠানে৷ প্রতিবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠানটি বয়কটও করেছিলেন বিরোধীরা৷
সেই সংসদ ভবনের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে সব মূর্তি৷ বসছে ফোয়ারা৷ কোটি কোটি টাকা খরচ করে তৈরি নতুন রাস্তা আবার ভেঙে ফেলা হচ্ছে৷ লোকসভা ভোটপর্বে নিঃশব্দে এমনই কাজ চলছে সংসদ চত্বরে৷ বিরোধী দলগুলি ব্যস্ত এখন নির্বাচনের কাজে৷ এই সময়কেই কাজে লাগিয়ে সংসদ চত্বর থেকে ১৪টি মূর্তিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আয়কর গেট ছয় নম্বরের সামনের পার্কে৷ গান্ধিজি, আম্বেদকরের পাশাপাশি জওহরলাল নেহরু, ছত্রপতি শিবাজি, মহারাণা প্রতাপ, বীরসা মুণ্ডা, দেবীলালের মতো বরেণ্য ব্যক্তিদের মূর্তিগুলির সঙ্গে সাংসদদের এতদিনকার আবেগ ও স্মৃতি জড়িয়ে ছিল৷ সেসবই মুছে দিতে চাইছেন মোদি৷ যুক্তি হল নতুন সংসদ ভবনের সামনে পৌঁছতে সমস্যা হচ্ছে রাষ্ট্রপতির ঘোড়ার গাড়ি ও প্রধানমন্ত্রীর গাড়ির৷ মূর্তি সরিয়ে দিয়ে, নতুন সংসদ ভবনে ‘ওয়েল’ না রেখে কার্যতঃ বিরোধীদের কণ্ঠরোধের নির্লজ্জ প্রয়াস স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মোদি সরকারের আচরণে৷ সংসদের বাইরে-ভেতরে সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করাটাই এখন মোদিজির আসল লক্ষ্য৷