চতুর্থবারের জন্য শতাব্দীকে সংসদে পাঠাতে মরিয়া তৃণমূল

সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু তাসের খেলা বীরভূমে

খায়রুল আনাম: হঠাৎই ছন্দপতন ঘটে গিয়েছে বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের তিনবারের তৃণমূল কংগ্রেসের তারকা সাংসদ শতাব্দী রায়ের গাড়ি যেতে দেখে রবিবার ৫ মে রাত ৯ টার সময় সিউড়ি শহরের ডাঙ্গালপাড়া এলাকায় বেশকিছু যুবক বিজেপির পতাকা হাতে নিয়ে ‘চোর চোর’ শ্লোগান দিতে থাকায়৷ সেইসাথে বিজেপির পতাকাধারী ওই যুবকেরা ‘তিহাড় জেলে গোরু চোর অনুব্রত মণ্ডল’ বলেও শ্লোগান দেয়৷ যদিও শতাব্দী রায় ওই সময় তাঁর গাড়ির আসনে বসে মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলতে তুলতে বেরিয়ে যান নিঃশব্দে৷ শতাব্দী রায়কে চতুর্থবারের জন্য দলীয় মনোনয়ন দিয়ে তাঁকে জেতাতে তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এসে একাধিক জনসভা করে গিয়েছেন৷ রবিবার ৫ মে-র রাতের এই ঘটনার পরদিনই ৬ মে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাঁইথিয়ায় এসে শতাব্দী রায়ের সমর্থনে জনসভা করে তাঁকে জেতানোর জন্য ভোট প্রার্থনাও করে গিয়েছেন৷

সিউড়ির ডাঙ্গালপাড়ার রাতের ওই ঘটনাকে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস যে হাল্কাভাবে নিচ্ছে না, তারও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে৷ বীরভূম লোকসভার তিনবারের সাংসদকে চতুর্থবারের জন্য জয়ী করতে মরিয়া তৃণমূল কংগ্রেস মনে করছে যে, ভীষণভাবে ভোট মেরুকরণের তাস খেলতে পোক্ত হাথরস, উন্নাওয়ে নারী নির্যাতন ঘটনার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে দিয়ে বিজেপি মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল সিউড়িতে যে জনসভা করে, সেখানে যোগী আদিত্যনাথ সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরু তাস খেলে যাওয়ার পর থেকেই বিজেপির একটা অংশ আগ্রাসী হয়ে উঠেছে৷ সিউড়ির ডাঙ্গালপাড়ার ঘটনা তারই বহিঃপ্রকাশ৷ এই জায়গা থেকেই এবার তৃণমূল কংগ্রেস দলীয় প্রার্থী শতাব্দী রায়কে জেতাতে বিজেপির সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু ভোট কাটাকুটির খেলার মোকাবিলায় রাজ্যের মন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমকে দু’দিনের সফরে বীরভূম লোকসভা এলাকায় নিয়ে এসে শতাব্দী রায়ের প্রচারে নামালো৷ এর আগেও ফিরহাদ হাকিম সিউড়ি ইণ্ডোর স্টেডিয়ামে দলীয় সম্মেলনে এসে ভোটে দলীয় কর্মীদের করণীয় বিষয় সম্পর্কে অবহিত করে গিয়েছেন৷ দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল গোরু পাচার মামলায় সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়ে দিল্লির তিহাড় জেলে যাওয়ার পর বীরভূম জেলার দায়িত্ব দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের হাতে রাখার সাথে সাথে জেলার সাংগঠনিক দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন বিশ্বস্ত সেনাপতি ফিরহাদ হাকিমের হাতে৷
সেই ফিরহাদ হাকিমই এবার দু’দিনের কর্মসূচিতে জেলায় এসে শতাব্দী রায়ের ভোট বাড়াতে নেমে পড়লেন৷ আর এক্ষেত্রে সংখ্যালঘু ভোট অনুকূলে আনা যে একটা বড় লক্ষ্য, তা সুস্পষ্টভাবেই মনে করা হচ্ছে৷ লোহাপুর এলাকার শীতলগ্রামের বান্দখালা দিয়ে ফিরহাদ হাকিমের প্রচার শুরু করার সিদ্ধান্ত সে কথাই বলছে৷ এর আগে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে এখানে বাম সিপিএম–কংগ্রেস তেমন কোনও দাগ কাটতে না পারলেও শতাব্দী রায় যেখানে ৬, ৫৪,০৭৭ ভোট পান সেখানে বিজেপির দুধকুমার মণ্ডল ৫, ৬৫, ১৫৩ টি ভোট পেয়েছিলেন৷ শতাব্দী রায় ৭৮, ৯২৪ ভোটের ব্যবধানে জিতলেও, সংখ্যালঘু ভোট যে তিনি হারিয়েছেন তা বোঝা গিয়েছিল৷ ২০১৯ সালের লোকসভা এবং ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে বাম বা সিপিএম–কংগ্রেস জোট তেমন কোনও দাগ কাটতে না পারলেও, এবার এই জোটের প্রার্থী হিসেবে এখানে রয়েছেন কংগ্রেসের জেলা সভাপতি হাসন বিধানসভার প্রাক্তন বিধায়ক মিল্টন রশিদ৷ যাঁর বেশকিছুটা জনপ্রিয়তাও রয়েছে৷ বিশেষ করে, তিনি সংখ্যালঘু ভোটে থাবা বসালে তাতে শতাব্দীর ঘর-ই খালি হবে৷ বীরভূম লোকসভার ১৮ লক্ষ ৫৭ হাজার ভোটারের মধ্যে মহম্মদবাজার এবং রাজনগরে সংখ্যালঘু ভোট গড়পড়তা ৩০ শতাংশ হলেও মুরারই, নলহাটি এবং হাসনে সংখ্যালঘু ভোট-ই সংখ্যাগুরুর দিকে রয়েছে৷ এমন সব অনেক এলাকাতেই অতীতে শতাব্দী রায় পিছিয়ে থেকেছেন৷ এমন কী, জেলার ১১ টি বিধানসভা আসনের মধ্যে বিগত বিধাসভা ভোটে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস ১০ টি আসন দখল করতে পারলেও একমাত্র দুবরাজপুর বিধানসভা আসনটি তৃণমূল কংগ্রেসকে বিজেপির কাছে হারাতে হয় লজ্জাজনকভাবে৷ বীরভূম লোকসভার অধীন দুবরাজপুর বিধানসভায় বিজেপির কাছে তৃণমূল কংগ্রেসের পরাজয় সে সময় মুক্ত অঙ্গনে থাকা জেলা তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকেও লজ্জায় ফেলে দিয়েছিলো৷ সে কথা তিনি নিজেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন৷ বীরভূম লোকসভার অধীন ওই বিধানসভা এলাকায় সংখ্যালঘু ভোটের প্রভাব থাকা সত্ত্বেও বিজেপির জয় রীতিমতো অস্বস্তিতে ফেলে শতাব্দী রায়কেও৷ একে রাজনৈতিক দিক থেকে ভোটের নিরিখে সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরুর বন্ধনীতে প্রকাশ্যে না ফেলে ‘সব ভোটই সমান’ বলা হলেও ফিরহাদ হাকিমের এই ঝাঁপ কিন্ত্ত রাজনৈতিক ব্যাখ্যায় ভিন্ন কথা-ই বলছে৷ এমন কী, বিজেপি গ্ল্যামার জগতের কঙ্কনা রানাওয়াত বা স্মৃতি জুবিন ইরানিকে নিয়ে সিউড়িতে রোড-শো করলে, তার পাল্টা হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসও গ্ল্যামার জগতের দীপক অধিকারী ওরফে দেব এবং রাজ্যের মন্ত্রী তথা গায়ক বাবুল সুপ্রিয়কে সামনে রেখে তাঁদের গ্ল্যামার জগত থেকে আসা প্রার্থী তিনবারের সাংসদ শতাব্দী রায়ের সমর্থনে রোড-শো করার দিকে যে হাঁটবে তা প্রায় নিশ্চত৷ জেলার দু’টি লোকসভায় ১৩ মে ভোট গ্রহণ করা হবে এবং প্রচারের শেষ লগ্নে তৃণমূল কংগ্রেস এই রোড-শো করবে বলেই মনে করা হচ্ছে৷