কঠিন পরীক্ষা মোদির, বাংলায় এগিয়ে মমতাই, আসন কমছে বিজেপির

পুলক মিত্র

সাত দফার ম্যারাথন ভোট পর্বের পর এবার ফল ঘোষণার প্রহর গুনছেন দেশের মানুষ৷ ৪ জুন ভোটের ফল কী দাঁড়াবে, সেদিকে এখন নজর গোটা দেশের৷ নরেন্দ্র মোদি কি আবার ক্ষমতায় ফিরবেন? নাকি ১০ বছরের বিজেপি জমানার অবসান ঘটিয়ে দিল্লির দখল নেবে ‘ইন্ডিয়া’ জোট? আর বাংলাতেই বা কী হবে? কার আসন বাড়বে? তৃণমূল কংগ্রেস, নাকি বিজেপির?

প্রথমে আসি পশ্চিমবঙ্গের কথায়৷ ভোটের দামামা বাজার আগে থেকেই এই রাজ্যে ৩৫টি আসনে জয়ের কথা বারবার শোনা গিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড অমিত শাহের মুখে৷ তারপর তা কমে দাঁড়ায় ৩০-এ৷ এরপর তিনি নিজেই তা ২৫টিতে নামিয়ে আনেন৷ এতে বিজেপির নেতা কর্মী তথা ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়৷


গত লোকসভার নির্বাচনে বাংলা থেকে ১৮টি আসন পেয়েছিল মোদির দল৷ এখন প্রশ্ন হল, এবার কি বিজেপি সেই সংখ্যা বাড়াতে পারবে? অঙ্কের হিসেব বলছে, বিজেপির পক্ষে আসন বাড়ানো কঠিন৷ গত কয়েকদিন ধরে ভোট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, ২০২৪-এ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আসন ১০ ছাড়ানো কঠিন৷ খুব ভালো ফল হলে, ১২ থেকে ১৪টিতে জিততে পারে৷ অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের আসন সংখ্যা গতবারের ২২টি থেকে বেড়ে ২৮-৩০ হতে পারে৷ এছাড়া কংগ্রেস বড়জোর ২টি এবং সিপিএম ১টি (মুর্শিদাবাদ) আসন পেতে পারে৷ অর্থাৎ গতবারের চেয়ে এবার ভালো ফল হবে তৃণমূলের৷

কেন তৃণমূলের আসন বাড়বে, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা৷ তাঁদের মতে, যে সন্দেশখালি নিয়ে এত হৈ চৈ করেছে বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস, সেই ঘটনা এবারের নির্বাচনে তৃণমূলের, আরও স্পষ্ট করে বললে, মমতার ভোট-ব্যাঙ্কে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না৷ তাছাড়া সন্দেশখালি একটি এলাকার ঘটনা৷ শাহজাহান বাহিনী সেখানে যা করেছে, তা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হলেও, তাতে গোটা রাজ্যের ভোটচিত্র বদলে যাবে, তা ভাবার কোনও কারণ নেই৷ এছাড়া, রেখা পাত্রের নেতৃত্বে মহিলারা যেভাবে পথে নেমে বিক্ষোভ করেছেন, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে৷ কারণ, পরবর্তীকালে যেসব ভিডিও এবং কথোপকথন সোশ্যাল মিডিয়ায় ফাঁস হয়েছে, তাতে এই ঘটনার পিছনে বিজেপির হাত থাকা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে৷ সবচেয়ে বড় কথা হল, যাঁরা রেখার নেতৃত্বে পথে নেমেছিলেন, তাঁদের বেশিরভাগই পরে রেখার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন৷ সন্দেশখালিতে শাহজাহানের লোকজন জমিদখল, কিংবা অন্যভাবে অত্যাচার চালালেও, নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে কিন্ত্ত যথেষ্ট সংশয় রয়েছে৷

এবারের নির্বাচনে যে কয়টি ইসু্য তৃণমূলকে এগিয়ে রাখছে, তার মধ্যে রয়েছে, সিএএ, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার এবং মহিলাদের মধ্যে মমতার অপ্রতিরোধ্য জনপ্রিয়তা৷ বিজেপি সিএএ-কে তুরুপের তাস করার ভাবলেও, তা বু্যমেরাং হয়ে গিয়েছে৷ মতুয়াদের একটা বড় অংশ এখন বিজেপির ওপর ক্ষিপ্ত৷ দীর্ঘকাল চুপচাপ থাকার পর হঠাৎ ভোটের মুখে সিএএ কেন, এই প্রশ্নও তুলছেন তাঁরা? যে পদ্ধতিতে নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে, তাতেও তাঁরা খুশি নন৷ তৃণমূল নিঃশর্ত নাগরিকত্ব প্রদানের যে দাবি তুলেছে, তাতে সায় রয়েছে মতুয়াদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের৷

মতুয়াদের পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের বড় অংশের সমর্থনও পাবেন মমতা৷ এছাড়া, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ভোট রাজনীতিতে তৃণমূলকে এগিয়ে রাখছে৷ সিপিএম, বিজেপি মমতার বিরুদ্ধে সরব হলেও, একবারও তারা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বিরুদ্ধে বলতে পারেনি৷ বরং লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে টাকার পরিমাণ আরও বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি শোনা গেছে এই দুই দলের নেতাদের মুখে৷ গতবার উত্তরবঙ্গের সবকটি আসনে জয় পেয়েছিল বিজেপি৷ এবার সেখানে ৩-৪টি আসনে জয় পেতে পারে তৃণমূল৷
দক্ষিণবঙ্গেও আসন বাড়বে তৃণমূলের৷

প্রধানমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতারা ভেবেছিলেন, সন্দেশখালিকে সামনে রেখে তাঁরা এবার বাংলায় বাজিমাৎ করবেন৷ তাই বারবার মোদি এই রাজ্যে প্রচারে ছুটে এসেছেন৷ বাংলায় মোট ২০টি নির্বাচনী কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন মোদি, যা অতীতে কখনও দেখা যায়নি৷ ভোট ঘোষণার আগে থেকে ধরলে, পশ্চিমবঙ্গে মোট ২৪টি নির্বাচনী কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, যার মধ্যে রয়েছে ২৩টি জনসভা এবং একটি রোড শো৷

শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা দেশে পরিস্থিতি মোদির অনুকূল নয়৷ এবার যেভাবে তিনি মেরুকরণের কদর্য রাজনীতি করেছেন, দেশের ইতিহাসে কেউ কখনও তা করেননি৷ ১৬ মার্চ ভোট ঘোষণার পর থেকে ৭৬ দিন ধরে ২০৬টি জনসভা (২০১৯-এ করেছিলেন ১৪৫টি) করেছেন৷ প্রথম দিকে নিজের সরকারের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরলেও, ভোটপর্ব যত এগিয়েছে, তত মুসলিমদের সরাসরি আক্রমণের পথে হেঁটেছেন৷ ইন্ডিয়া জোট জিতলে, তফশিলি জাতি, উপজাতি এবং ওবিসিদের সংরক্ষণ তুলে তা মুসলিমদের দিয়ে দেবে, এমন কথাও শোনা গেছে ভারতের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশের একজন প্রধানমন্ত্রীর মুখে৷ শুধু তাই নয়, ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে, মেয়েদের ‘মঙ্গলসূত্র’ও কেড়ে নেবে, এমন কথাও বলেছেন মোদি৷
এ প্রসঙ্গে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ২২৪ বার মুসলমান, সংখ্যালঘু, পাকিস্তান প্রসঙ্গ তুলেছেন৷ ৪২১ বার মন্দির-মসজিদ নিয়ে কথা বলেছেন৷ আর নিজের প্রচারে তিনি এতটাই আত্নমগ্ন যে, শেষ ১৫ দিনের বক্তৃতায় ৭৫৮ বার মোদি শব্দটি ব্যবহার করছেন৷’’

ভোটে ইসু্য করবেন বলে, জানুয়ারিতে তড়িঘড়ি করে রামমন্দিরের উদ্বোধন করেছিলেন মোদি৷ কিন্ত্ত দিন যত এগিয়েছে, ফিকে হয়েছে রামমন্দির৷ উঠে এসেছে বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, কৃষক অসন্তোষের মতো জ্বলন্ত ইসু্য, যা দেশবাসীকে প্রতিনিয়ত জর্জরিত করে চলেছে৷ বুদ্ধিমান মোদি তা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন৷ তাই দিশাহীনভাবে বারবার বদলেছেন প্রচারের অভিমুখ৷ একদিকে নির্লজ্জভাবে সংখ্যালঘুদের নিশানা করেছেন৷

অন্যদিকে, ব্যতিক্রমী পথে হেঁটে দেশের ৮০টি টিভি চ্যানেলকে নিজের বাসভবনে ডেকে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী৷ আশ্চর্যের হলেও সত্যি যে, গত ১০ বছরের শাসনে একবারও সাংবাদিক বৈঠক করেননি মোদি৷ দেশদ্রোহিতার মত মামলায় ফাঁসিয়ে যিনি একের পর এক সাংবাদিককে জেলে ঢুকিয়েছেন, সেই মোদি হঠাৎ মিডিয়ার প্রতি এতটা সদয় হয়ে উঠলেন কেন?

দক্ষিণ ভারত যে তিনি খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন না, তা আগেই বুঝে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী৷ তাই নজর ছিল উত্তর ভারতের দিকে৷ আর ভারতে ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে উত্তর ভারত৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসন রয়েছে উত্তরপ্রদেশে, ৮০টি৷ এই উত্তরপ্রদেশেই সবচেয়ে বেশি ৩১টি নির্বাচনী কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন মোদি৷

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এবারের ভোটে উত্তরপ্রদেশ তো বটেই, পশ্চিমবঙ্গ (৪২টি আসন) সহ আরও পাঁচটি রাজ্যের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে৷ বাকি চারটি রাজ্য হল, মহারাষ্ট্র (৪৮), বিহার (৪০), মধ্যপ্রদেশ (২৯) এবং কর্নাটক (২৮)৷ ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে এই ৬টি রাজ্যের ২৬৭টি আসনের মধ্যে এনডিএ পেয়েছিল ২১৬টি৷ এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ১৮, বিহারে ৩৯, উত্তরপ্রদেশে ৬৪, মহারাষ্ট্রে ৪১, কর্নাটকে ২৬ এবং মধ্যপ্রদেশে ২৮টি কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিল এনডিএ৷

এবার একাধিক রাজ্যে ভোটের হিসেব বদলে গিয়েছে৷ উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি এবার চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে বিজেপিকে৷ এই রাজ্যে ৩০টির মতো আসনে জয় আশা করছে ইন্ডিয়া জোট৷ ২০১৯-এ মহারাষ্ট্রে বিজেপির জোটে ছিল শিবসেনা৷ এবার শিবসেনা নেতা উদ্ধব ঠাকরে রয়েছেন ইন্ডিয়ার সঙ্গে৷ বিহারে নীতীশ কুমার আবার বিজেপি শিবিরে ফিরে যাওয়ায়, লাভ হয়েছে আরজেডি-কংগ্রেসের৷ কর্নাটকে এককভাবে ক্ষমতায় রয়েছে কংগ্রেস৷ একমাত্র মধ্যপ্রদেশ বাদ দিলে, বাকি সবকটি রাজ্যেই বিজেপির আসন সংখ্যা কমছে৷

ক্ষমতায় ফেরার পথ যে এবার মসৃণ হবে না, তার আঁচ অনেক আগেই পেয়েছেন মোদি৷ তাই রেকর্ড নির্বাচনী জনসভা থেকে শুরু করে মিডিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকার, সব ধরনের মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছেন তিনি৷ কিন্ত্ত শেষ হাসি হাসতে পারবেন কি?