শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখে কোমর৷ হাঁটাচলা বা পুরো পা মাটিতে ফেলে স্বাধীনভাবে নড়াচড়া করা যায় এই কোমরের মাধ্যমেই৷ কোনো কারণে হিটে আঘাত পেলে বা এটি অকার্যকর হলে, তখন ওই হিপ ফেলে দিয়ে কৃত্রিম হিপ প্রতিস্থাপন করা হয়৷ একেই বলে হিপ রিপ্লেসমেন্ট৷
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন অর্থোপেডিক ও অর্থোপ্লাস্টি সার্জন৷ সাধারণত কোমরের ইনজুরি, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, মারাত্মক অস্টিও আর্থ্রাইটিস, হাড় ক্ষয়, হাড়ের টিউমার, অস্থিতে রক্ত সরবরাহ বন্ধসহ নানা জটিল পরিস্থিতিতে হিপ রিপ্লেসমেন্ট করা হয়৷ বেশি ওজনের বা স্থূল আকৃতির বয়স্ক পুরুষ ও নারী, কম হাঁটাচলা করা ব্যক্তি, প্রতিদিন দীর্ঘ সময় হাঁটু ভাঁজ করে পিঁড়িতে বসে কাজ করা ব্যক্তি, অযাচিত ও দীর্ঘমাত্রায় রোগীর স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবনকারীদের হিপ রিপ্লেসমেন্ট করাতে হতে পারে৷
জীবনযাপনে পরিবর্তন আসায় দিন দিন কার্যক্ষমতা কমে যাচ্ছে মানুষের৷ বিশেষ করে কায়িক পরিশ্রম না করা ও প্রযুক্তিনির্ভর জীবনব্যবস্থা মানুষকে খুব অলস করে দিচ্ছে৷ দেহ ভারি হয়ে কোমর ও হাঁটুর জয়েন্ট নষ্ট করে অসহনীয় অবস্থা তৈরি হচ্ছে৷ তখন শুধু তীব্র ব্যথা ও যন্ত্রণাই নয়; বরং পুরো জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ৷ ব্যক্তিটি হয়ে যাচ্ছে পরিবারের বোঝা৷
কোনো কারণে আঘাত পেলে, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, হাড় ক্ষয়, হাড়ের টিউমার, অস্থিতে রক্ত সঞ্চালন বন্ধসহ অন্যান্য অসুখ হলে কোমর বা হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যথা হয়৷ তখন হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যায় এবং অন্যান্য চিকিৎসা দিয়েও রোগীকে সুস্থ করে তোলা যায় না৷ চিকিৎসকরা সেই পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ কোমর ও হাঁটু প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন৷ সাধারণত ষাটোর্ধ্ব রোগীদের এটা বেশি করা হলেও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির উন্নত ও দীর্ঘমেয়াদি কৃত্রিম অস্থিসন্ধি ব্যবহার করে অল্পবয়সি রোগীদেরও আজকাল কোমর ও হাঁটু প্রতিস্থাপন হচ্ছে৷ স্বাভাবিক জীবনকোমরের কৃত্রিম এই জয়েন্ট বা প্রতিস্থাপন আধুনিক চিকিৎসার অংশ৷ মানবদেহের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে যুক্তরাষ্ট্র, জাপানে টাইটেনিয়াম ইমপ্লান্ট (এক ধরনের মেটাল দিয়ে কৃত্রিম জয়েন্ট তৈরি) করা হয়৷ মাত্র এক থেকে দুই ঘণ্টার এই অস্ত্রোপচারের পর এক বা দুদিন রোগীকে হাসপাতালে থাকতে হয়৷ এর পরই উঠে বসা, হাঁটাচলা, ব্যায়াম, সিঁড়ি ভাঙাসহ সব ধরনের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারে৷ এতে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না৷ চিকিৎসার পর রোগী ২০-৩৫ বছর পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে, তেমন কোনো সমস্যা ছাড়াই৷
কৃত্রিম জয়েন্ট প্রতিস্থাপনের পর খেলোয়াড়রাও তাদের খেলাধুলা চালিয়ে যেতে পারেন৷ জটিলতাকোমর ও হাঁটু প্রতিস্থাপনের অপারেশন নিরাপদ৷ তবে অন্যান্য অস্ত্রোপচারের মতো এতে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে৷ এ জন্য পায়ের শিরায় রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধে বিশেষ কমপ্রেশন ডিভাইস যেমন— হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ইলাস্টিক মোজা এবং ব্যায়ামের পরামর্শসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয়৷অনেক সময় শারীরিক আসন নতুন প্রতিস্থাপিত অস্থিসন্ধি থেকে কৃত্রিম অংশকে ছুটিয়ে দিতে পারে৷ এ জন্য রোগীর অস্ত্রোপচারের পর কখনই কোমর সন্ধি বা হিপ জয়েন্টকে ১০০ ডিগ্রির বেশি বাঁকানো এবং পা দুটোকে শরীরের মাঝামাঝি বরাবর ভাঁজ করা ঠিক হবে না৷অনেক সময় প্রতিস্থাপিত কৃত্রিম কোমরসন্ধি ঢিলা হয়ে ব্যথার কারণ হতে পারে৷ এ ছাড়া কিছু কিছু সময় আশপাশের নরম কোষকলাগুলো জমাট ও শক্ত করে নড়াচড়ায় কষ্টকর করে তুলতে পারে৷ এসব সমস্যা মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে৷চিকিৎসা ব্যয়বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি এই হিপ ও হাঁটু রিপ্লেসমেন্ট৷ এতে অপারেশন করে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ডিভাইসটি বসিয়ে দেওয়া হয়৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ চিকিৎসায় খরচ পড়ে ২০-৩০ লাখ থেকে এক-দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত৷
আমেরিকায় হিপ রিপ্লেসমেন্ট বাবদ খরচ হয় ৫০-৫৫ হাজার ইউএস ডলার, সিঙ্গাপুরে ৩০-৩৫ হাজার ডলার, থাইল্যান্ডে ২০-২৫ হাজার ডলার, ভারতে ১০-১২ হাজার ডলার, আর বাংলাদেশে সেটি হচ্ছে মাত্র তিন-চার হাজার ডলার বা আড়াই থেকে তিন লাখ টাকায়৷
প্রতিরোধে শুধু সচেতনতার অভাবে প্রতি বছর কোমর ও হাঁটুর নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে হাজার হাজার নারী-পুরুষ৷ তাই এ অবস্থা থেকে মুক্ত থাকতে করণীয় হলো—
দেহের প্রতিটি মাংসপেশি সচল রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে৷
ফাস্টফুড, ভেজাল খাবার বর্জন করতে হবে৷
ওজন বৃদ্ধি প্রতিরোধ করতে হবে৷
উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল লেভেল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে৷
কবিরাজি ওষুধ, স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ সেবনের কারণে কোমর ও হাঁটুর জয়েন্ট নষ্ট হয়ে যেতে পারে৷ এসব থেকে বিরত থাকতে হবে৷
শুধু শুয়েবসে থাকলে ওজন বাড়বে, তাই মুভমেন্ট বাড়াতে হবে ও চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ গ্রহণ করতে হবে৷