নিজস্ব প্রতিনিধি–- বাংলার ৪২টি লোকসভা আসনের গণনা চলছে ৫৫টি কেন্দ্রে৷ মোট ৫০৭ জন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ হবে আজ৷ ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে মোদি-অমিত শাহদের রুখে দিয়ে তৃতীয়বারের জন্য রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এদিকে এবারে লোকসভা নির্বাচনে এনডিএ ক্ষমতায় এলে তৃতীয় বারের জন্য নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়া সময়ের অপেক্ষা৷ প্রায় দেড় দশকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির মানচিত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে৷ যদিও এরাজ্যে পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গিয়েছিল ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল থেকে৷ তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে৷ ২০১১-তে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এরপর রাজ্যে ঘাসফুলের দাপট যত বেড়েছে ততই ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে বামেরা৷ ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিবঙ্গ থেকে লোকসভায় ৩৪ জন সাংসদ পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল মমতার দল। যা এতদিন পর্যন্ত তৃণমূলের কাছে রেকর্ড৷ কিন্ত্ত ২০১৯ সালে সবাইকে চমকে দিয়ে এ রাজ্যে গেরুয়ার চমকপ্রদ উত্থান হয়৷ বিজেপি এ রাজ্য থেকে লোকসভার ১৮টি আসনে জয়ী হয়ে রাজ্য-রাজনীতিতে ইতিহাস সৃষ্টি করে৷ এত বেশি সংখ্যক বিজেপি সাংসদ এর আগে বঙ্গ থেকে লোকসভায় কখনও যায়নি৷ তৃণমূলকে সন্ত্তষ্ট থাকতে হয় ২২ট আসন নিয়ে৷ স্বাভাবিকভাবে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ছিল খুব কঠিন লড়াই৷ সেই লড়াইয়ে জয়ী হয়ে তিনি নজির সৃষ্টি করেন৷ কিন্ত্ত প্রায় দেড় দশকে বঙ্গের রাজনৈতিক মানচিত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে৷ একটা সময়ে এ রাজ্যের রাজনৈতিক রঙ ছিল লাল৷ সেই লাল ক্রমশ ফিকে হয়ে আসতে থাকে। উল্টে গেরুয়ার দাপট বাড়তে থাকে৷ লাল-সবুজের পর গেরুয়ার এই উত্থান নিয়ে রীতিমতো রাজ্য রাজনীতি চিত্তাকর্ষক হতে থাকে৷ একসময়ের বামদুর্গে বিজেপির উত্থান শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, মনে করিয়ে দিচ্ছে ত্রিপুরার কথাও৷ সেখানেও ক্ষমতা হারিয়ে বামেরা এখন অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে৷ ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের পর ফের এ রাজ্যকে নিশানা করে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে বিজেপি৷ খাতায়-কলমে বিজেপির ৭৭জন বিধায়ক থাকলেও, দলবদল করে বর্তমানে তা ৭০-এ এসে দাঁড়িয়েছে৷ এর পাশাপাশি ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হওয়া বাবুল সুুপ্রিয় এখন রাজ্যের মন্ত্রী৷ ব্যারাকপুরের বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং দলবদল করে ফের ফিরে গিয়েছেন বিজেপিতেই৷
অন্যদিকে, শত্রুঘ্ন সিনহার মতো অভিনেতা-রাজনীতিবিদের প্রবেশ ঘটেছে রাজ্যে৷ এবারের নির্বাচনে তৃণমূলের টিকিটে ৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। যাঁরা এই রাজ্যের বাসিন্দা নন৷ যদিও শত্রুঘ্ন সিনহা আসানসোল লোকসভার উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে এ রাজ্য থেকে সংসদে গিয়েছিলেন৷ সেই তিনি এবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন৷ এখনও পর্যন্ত তিনি গণনায় এগিয়ে রয়েছেন। বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে বিজেপি’র প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তৃণমূলের কীর্তি আজাদ৷ সেখানে পিছিয়ে রয়েছেন দিলীপ ঘোষ। তবে সবচেয়ে বড় চমক দিয়েছে তৃণমূল। ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠানকে বহরমপুরে বেতাজ বাদশা, সেই সঙ্গে কংগ্রেস প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রার্থী করে৷ ভোটের রাজনীতির এই উত্তাপ ছড়িয়েছে ক্রিকেটারদের মধ্যেও৷ সেই কারণেই ইউসুফ প্রার্থী হওয়ার পর তাঁকে শুভেচ্ছা জানান ভারতীয় ক্রিকেট টিমের প্রাক্তন অধিনায়ক শচিন তেন্ডুলকর ও সৌরভ গাঙ্গুলির মতো ক্রিকেটাররা৷
বুথ ফেরত সমীক্ষাকে কোনওভাবেই আমল দিচ্ছে না তৃণমূল৷ রাজ্যের শাসকদলের অন্দরে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে তৃণমূল ৩০-৩২টি আসনে জয়ী হবে৷ যদি সবচেয়ে কম হয় তাহলেও অন্তত ২৬টি আসন পাবে৷ তৃণমূল কমপক্ষে ৬টি আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখছে৷ তবে এই ৬টি আসনে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী শাসকদল৷ ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গ এবং জঙ্গলমহলে আশানুরূপ ফল করতে পারেনি তৃণমূল৷ এই অঞ্চলগুলিতে বিজেপি’র জয়জয়কার ছিল৷ পিছিয়ে পড়া জাতি-উপজাতিদের বড়সড় অংশ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল রাজ্যের শাসকদলের থেকে৷ সেই ভোট ব্যাঙ্কের কিছুটা অংশ ফিরে এসেছিল তৃণমূলের বাক্সে। গত বিধানসভা নির্বাচনে৷
উত্তরবঙ্গ এবং জঙ্গলমহলকে পাখির চোখ করে ভালো ফল করার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রীতিমতো ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারে নামেন৷ ১০০ দিনের কাজের বকেয়া টাকাকে সামনে রেখে রাজ্যের গ্রামীণ এলাকাগুলিতে জোরদার প্রচারে নামেন৷ পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিপুল সাফল্য পায় তৃণমূল৷ সেই বঞ্চনাকেই সামনে রেখে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে মমতা-অভিষেকের যুগলবন্দি ছিল চোখে পড়ার মতো৷ ১০৭টি প্রচার সভায় অংশ নেন মমতা৷ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় রোড শো ও নির্বাচনী জনসভা মিলিয়ে ৭৭টি সভায় অংশ নেন৷ লক্ষ্য একটাই মোদি- অমিত শাহের দলকে গতবারে মতো রুখে দেওয়া৷ সেই কাজে তাঁরা সফল হলেন আজ৷ রাজ্যের শাসক দলের নেতা-কর্মীরাও মমতা-অভিষেকের মতো বুথফেরত সমীক্ষাকে পাত্তা দিতে নারাজ ছিলেন৷ তাঁদের দাবি, এবারও মোদি-শাহদের দলকে রুখে দিয়ে মমতাদি প্রমাণ করে দেবেন, তিনি কতটা জনপ্রিয়৷
এদিকে বাম-কংগ্রেসও বেশ কয়েকটি আসনকে সামনে রেখে লোকসভা নির্বাচনে ভালো ফল করার জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি৷ বহরমপুরের কংগ্রেস প্রার্থী অধীর চৌধুরিকে জেতানোর জন্য সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের প্রচার নজর কেড়েছিল৷ ঠিক একইভাবে অধীরও রাজ্যজুড়ে বাম-কংগ্রেস প্রার্থীদের হয়ে প্রচারে নামেন৷ বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু জানিয়েছিলেন, ‘এবার আমরা কনফিডেন্ট, শূন্য থাকব না৷’ ফলে এবার বামেদের ভোটব্যাঙ্কের দিকে বিশেষ নজর থাকবে আমজনতার৷
যাদবপুরের মতো লোকসভা কেন্দ্রে তরুণ মুখকে প্রার্থী করে এবার নির্বাচনী প্রচারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রচারের আলোয় রয়েছে বামেরা৷ শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্রে বামেদের প্রার্থী দীপ্সিতা ধর৷ তৃণমূল ও বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে তিনি কতটা ফাটল ধরাতে পারবেন, সেদিকেও নজর থাকবে৷ মুর্শিদাবাদ আসনে প্রার্থী হয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম৷ এই আসনে ভালো ফল করার জন্য বামেরা মুখিয়ে থাকলেও আশানুরূপ হল না৷ ঠিক একইভাবে দমদম ও যাদবপুর নিয়েও বামেরা যথেষ্ট আশাবাদী ছিল। সেই দুই আসনেও এগিয়ে রাজ্যের শাসক শিবির৷ অন্যদিকে বহরমপুরের পর মালদা দক্ষিণ আসনটিকে ঘিরে আশায় বুক বাঁধে কংগ্রেস৷ আইএসএফ এবার লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও, ভাঙড় বিধানসভা তাঁদের কিছুটা দাপট দেখা গেলেও অন্যত্র সেভাবে তাদের উপস্থিতি দেখা যায়নি৷ তাদের ম্রিয়মানতা রাজ্য-রাজনীতিতে কৌতূহল বাড়িয়ে দিয়েছে৷ সর্বোপরি লোকসভা নির্বাচনের এই মহারণে দেশজুড়ে শেষ পর্যন্ত কী ফলাফল হয়, তার উপর নির্ভর করছে আগামী দিনের এই রাজ্যের রাজনীতির ভবিষ্যৎ৷