এবার সংসদে আমরা শূন্য থাকব না, আমরা কনফিডেন্ট: বিমান

সৈয়দ হাসমত জালাল ও দেবাশিস দাস

নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট পনেরো আগেই আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিআই(এম)-এর হেড অফিসে৷ দোতলার ঘরে গিয়ে বসতেই জল, চা আর বিস্কুট দেওয়া হল আমাদের৷ চা খাওয়া শেষ হওয়ার একটু পরেই ঘরে ঢুকলেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু৷ আর ক’দিন পরেই ৮৫ বছরে পা রাখবেন তিনি৷ বহু রোদ-ঝড়-বৃষ্টি পেরিয়ে আসা এই পোড়খাওয়া মানুষটির চেহারার বিশেষ কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ল না৷ এই বয়সেও নির্বাচনী প্রচারে যাচ্ছেন, পথ হাঁটছেন, বিপুল পরিশ্রম করছেন এই রাজনৈতিক লড়াইয়ে৷

পাশের একটি ছোট ঘরে আমাদের ডেকে নিয়ে গিয়ে বসলেন৷ খোঁজখবর নিলেন স্টেটসম্যানের৷ এই ঐতিহ্যময় সংবাদপত্রটির আগেকার কথা, পূর্বতন সম্পাদকদের কথাও বললেন কথা প্রসঙ্গে৷ তারপর আর এক দফা চা খেতে খেতে শুরু হল আমাদের প্রশ্নোত্তর পর্ব৷


প্রশ্ন: কয়েক দফা ভোট হয়ে গেছে৷ এ রাজ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে৷ অন্তত এরকম একটা বাইনারির কথাই বেশি শোনা যাচ্ছে৷ সেখানে আপনাদের অবস্থান কী? কোন কোন বিষয় আপনারা তুলে ধরছেন, যা অন্য দলগুলো বলছে না?
বিমান বসু: হঁ্যা, চার দফা ভোট হয়েছে৷ শুরু থেকেই রাজ্যে রাজনৈতিক দিক থেকে যে দ্বিমেরু প্রচার বা বাইনারির কথা বলা হচ্ছিল, তাকে পরাস্ত করে এবার হচ্ছে ত্রিমুখী লড়াই৷ কংগ্রেসের সঙ্গে এখানে আমাদের ‘আনডারস্ট্যান্টিং অফ সিট’ হয়েছে৷ এটাকে ঠিক জোট বলা যাবে না৷ কারণ যৌথ ইস্তাহার হয়নি৷ বামফ্রন্টের পক্ষে আবেদন জানানো হয়েছে আর সিপিআই(এম) ও সিপিআই-এর নিজেদের ইস্তাহার হয়েছে৷ দেশের এবং রাজ্যগুলোর অবস্থা যতটা বলা যায়, উল্লেখ করেছি৷ মানুষের জীবনযন্ত্রণা উপশম করার কথা বলেছি৷ ইস্তাহারে বলেছি, বিজেপি মানুষের শত্রু, সংবিধানের বিরোধী৷ তারা নতুন সংবিধান করতে চায়৷ বিজেপি আর তৃণমূলের বোঝাপড়ার কথা বলেছি৷ উভয়কেই হারাতে হবে৷ তা না পারলে দেশের, রাজ্যের মানুষের কথা সংসদে বলতে পারব না৷ রাজ্যের এবং দেশের কথা একসঙ্গে বলতে চাই, যা সাধারণত বিজেপি বা তৃণমূলের পক্ষ থেকে বলা হয় না৷

তৃণমূলের প্রচার দেখে মনে হচ্ছে, এটা রাজ্যের নির্বাচন৷ সিএএ-র বিরুদ্ধে বলছে তৃণমূল৷ কিন্ত্ত সংসদে সিএএ পাশ করানোর সময় তারা বেরিয়ে গিয়েছিল৷ এখন আবার মুখ্যমন্ত্রী সিএএ সমর্থন করছেন৷
ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার বিরোধী আমরা৷ ঋষি সুনাক ইউকে-র প্রধানমন্ত্রী, তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দু৷ তাঁর সরকারের মুসলিম প্রতিনিধি আছেন৷ বিলেত, আমেরিকা, কানাডা— কোথাও ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব হয় না৷ কোনও বড়ো দেশে হয় না৷ ভারত একটা বড়ো দেশ৷ সব বিষয়েই ‘ঘুসপেটিয়া’ চলে না৷

এগুলো তুলে ধরছি৷ সাধারণ মানুষের জীবনয.ন্ত্রণা, জিনিসের দরদামের সমস্যার কথা বলছি৷ ২০১৩ সালে দারিদ্রের সূচকে ভারতের স্থান ছিল ৫৫৷ এখন ১১১৷ মোদির গ্যারান্টি কী হলো গত ১০ বছরে? দারিদ্র বাড়ল কেন? অন্যদিকে ‘কনসেনট্রেশন অফ ওয়েল্থ্’৷ ১ শতংশ ধনী ব্যবসায়ীর হাতে দেশের ৪০ শতাংশ সম্পদ৷ দারিদ্র দূরীকরণ তো হচ্ছে না!

প্রশ্ন: এখন ভোটের প্রবণতা নিশ্চয়ই কিছুটা বুঝতে পারছেন? পশ্চিমবঙ্গে বামজোটের অবস্থা এবার কীরকম হবে বলে মনে করছেন?
বিমান বসু: ৪ঠা জুনের পর এবার সংসদে আমরা শূন্য থাকব না৷ আমরা কনফিডেন্ট৷

প্রশ্ন: এবার নির্বাচনে বিজেপি সব জায়গাতেই ধর্মীয় বিভাজনের এবং মেরুকরণের উপর জোর দিচ্ছে৷ নরেন্দ্র মোদিকেও সরাসরি এই ধরনের ভাষণ দিতে শোনা গেছে৷ এর বিরুদ্ধে আপনাদের লড়াইটা এই নির্বাচনে কি একটু বেশি কঠিন হয়ে যাচ্ছে? আপনারা এটাকে কীভাবে মোকাবিলা করছেন?
বিমান বসু: ধর্মীয় মেরুকরণ— এ তো মনুবাদী দর্শন৷ এতে মানুষের ঐক্য, সম্প্রীতির মেলবন্ধন নেই৷ বৈশ্য শূদ্রের মধ্যেও ভাগাভাগি৷ এ রাজ্যে এই মেরুকরণের প্রধান সহায়ক তৃণমূল কংগ্রেস৷ বিজেপি হচ্ছে আরএসএস-এর রাজনৈতিক সংগঠন৷ এখানে অতীতে আরএসএস-এর ইউনিট যা ছিল, এখন তৃণমূলের সহায়তায় কয়েকশো গুণ বেড়েছে৷

আরএসএস-এর নেতা মোহন ভাগবত অনেক সময় গোপনে এসে তাঁদের মিটিং করে যান৷ সেসব কথা প্রকাশ্যে আসে না৷ কিন্ত্ত তিনি যখন প্রকাশ্যে আসেন, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে ফল, দই, মিষ্টি ইত্যাদি পাঠান৷ জনসভায় মমতা বলেছেন, ভগবতজী আসবেন, তাঁকে ভালো করে দেখাশোনা করবেন৷
আমরা সেখানে মানুষের ঐক্য, সম্প্রীতির কথা বলি৷ সংবিধানের নিরপেক্ষতার দাবিগুলি আমরা করি৷

প্রশ্ন: অযোধ্যায় রামলালা প্রতিষ্ঠার কোনও প্রভাব এ রাজ্যের নির্বাচনে?
বিমান বসু: রামনবমী আগেও হতো৷ হনুমান জয়ন্তী হতো না৷ এখন গেট হয় বড়ো করে, আগে সেসব ছিল না৷ তৃণমূলও হনুমান জয়ন্তী করেছে৷ এরকম প্রতিযোগিতা করলে আরও বাড়বে৷ আমাদের রাজ্যে সরকারি টাকায় দিঘায় মন্দির হয়েছে৷ প্রতিযোগিতা চলছে৷

আমরা বলি, ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মেলাবেন না৷ কিন্ত্ত এঁরা প্রতিযোগিতা করে সেটা করছেন৷
একটা ঘটনার কথা বলি৷ প্রথম নন-অ্যালাইনমেন্ট কনফারেন্স— নেহরু, ক্রুশ্চেভ, নাসের আছেন৷ সেখানে সিদ্ধান্ত হয় পরের সম্মেলনটা হবে কায়রোতে৷ নাসের দেখলেন, কায়রো এয়ারপোর্টের গেট বড়ো করতে হবে৷ এদিকে গেটের পাশে একটা মসজিদ ছিল৷ তিনি মৌলবীদের সঙ্গে কথা বললেন৷ বললেন যে, তিনি মেশিনের সাহায্যে মসজিদটা তুলে একটু দূরে বসিয়ে দেবেন৷ তার জন্যে জায়গা, খরচ সব তাঁর সরকারই দেবে৷ মৌলবীরা বললেন, আপনি শুধু মসজিদ সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন৷ জায়গা কিনে এবং অন্যান্য সব খরচ করে আমরা বানিয়ে নেব৷ সরকারের টাকা তাঁরা নেননি৷

এখানে রাষ্ট্র জনগণের টাকায় মন্দির করছে৷ এই প্রতিযোগিতার ফলেই আরএসএস বাড়ছে৷ তবে একটা সময় মানুষের সম্বিৎ ফিরবে৷ এগুলো করে মানুষের বেঁচে থাকার সমস্যা দূর হবে না৷

প্রশ্ন: পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনেক অভিযোগ উঠেছে৷ কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধেও নির্বাচনী বন্ডের দুর্নীতির অভিযোগ৷ এর প্রতিফলন কি ভোটের ফলাফলে পড়বে?
বিমান বসু: সার্বিকভাবে প্রতিফলন পড়ছে না৷ কিন্ত্ত সচেতন মানুষদের মধ্যে একটা অভিঘাত তৈরি হচ্ছে৷ নির্বাচনী বন্ড সাধারণ মানুষ তেমন বুঝতে পারছে না৷ শিক্ষিত লোকেরা বুঝেছে৷

প্রশ্ন: এবার আপনারা দলের তরুণ নেতা-নেত্রীদের প্রার্থী করেছেন৷ এঁরা কি আপনাদের কয়েক বছরের পরিস্থিতি বদলে দিতে পারবেন?
বিমান বসু: সব সময়েই যখন এই ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি হয়, যেখানে মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে পারে না, মানুষ কি শুভ বোধ নিয়ে চলতে পারবে— এরকম একটা সংশয় তৈরি হয়, এই সময় সব দেশেই তরুণরা নিজেদের শ্রম ব্যয় করার জন্যে প্রস্ত্তত থাকে৷