শুভেন্দুর মেশিনারির মোকাবিলাই চ্যালেঞ্জ
দেবাশিস দাস: এতদিন কলকাতা হাইকোর্টের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে আমজনতার হয়ে বিভিন্ন মামলার রায় দিয়েছেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়৷ এবার সেই তিনি জনগণের রায় নিজের পক্ষে পেতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছেন৷ উল্লেখ্য, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় তাঁর রায় রাজ্য রাজনীতিতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল৷ এই রায়কে সামনে রেখেই অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ৷ বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীরা তাঁকে অনেকটা ভগবানের আসনেই বসিয়ে দিয়েছিলেন৷ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের একাংশ৷ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে কোনও মামলা ওঠা মানে সুবিচার পাবেন মামলাকারী এটাই যখন ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছিল৷ ঠিক সেই সময় আচমকাই বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বিজেপির হয়ে ভোটের আঙিনায় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়৷ তিনি ইচ্ছে করলে আর কয়েক মাস পর অবসর গ্রহণ করে নিশ্চিন্তে খুব আরামদায়কভাবে জীবনটাকে অতিবাহিত করতে পারতেন৷ কিন্ত্ত তা না করে কেন তিনি ভোটের ময়দানে এসে পড়লেন, তা নিয়ে অন্তহীন বিতর্ক চলছে৷ রাজনীতিতে সম্পূর্ণ আনকোরা এই ব্যক্তিত্বকে ভোটের ময়দানে নিয়ে এসে তাঁর স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে পুঁজি করে মমতা প্রশাসনকে বার্তা দিতে চায় বিজেপি৷ যদিও তাঁর এই স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে বিভিন্নভাবে কটাক্ষ করা হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে৷ তাঁর দেওয়া রায় নিয়েও তীব্র আপত্তি রয়েছে শাসক শিবিরে৷ তমলুক লোকসভায় বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দেখানো পথেই জনসংযোগ নিবিড় করার চেষ্টা করছেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়৷ তীব্র গরমের মধ্যেও চষে বেড়াচ্ছেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে৷ প্রচণ্ড গরমে পাঞ্জাবি ভিজে গিয়েছে, ঘেমে-নেয়ে একসা৷ তাও তিনি হাল ছাড়তে নারাজ৷ নির্বাচনী ময়দানে নেমে তাঁর বিভিন্ন মন্তব্য নিয়ে জোরদার বিতর্ক হয়েছে৷ নির্বাচন কমিশন তাঁর প্রচারের উপর ২৪ ঘণ্টা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে৷ তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর মন্তব্যে অনড়৷ কমিশনের বিরুদ্ধে তিনি কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন৷ তাঁর বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলাও দায়ের হয়েছে৷ এ সবকিছুই নির্বাচনের অঙ্গ মেনে নিয়ে তিনি পড়ে রয়েছেন তমলুক লোকসভা কেন্দ্রে৷
অন্যদিকে তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন তরুণ মুখ দেবাংশু ভট্টাচার্য, যিনি লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ প্রার্থী৷ তাঁর বয়স ২৮৷ একই সঙ্গে বামেদের হয়ে এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সায়ন ব্যানার্জি৷ তিনি পেশায় কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী৷ এই তিনজনের মধ্যে অনেক অমিল থাকলেও, এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল এঁরা এর আগে কোনও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি৷ সেই সঙ্গে যে লোকসভা কেন্দ্রে এই তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, এঁরা কেউই ভূমিপুত্র নন৷ বিজেপির অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় থাকেন সল্টলেকে৷ দেবাংশুর বাড়ি হাওড়ার বালিতে৷ সায়ন ব্যানার্জি সোনারপুরের বাসিন্দা৷ এই তিন প্রার্থীর লড়াইকে ঘিরে আপাতত সরগরম রাজ্য-রাজনীতি৷ আরও বেশি করে বললে, উত্তাপ বাড়ছে তমলুকে৷ এই কেন্দ্রের নির্বাচন রয়েছে আগামী ২৫ মে৷ ভোটের আঙিনায় আরও বেশ কয়েকজন প্রার্থী রয়েছেন৷ যদিও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে এই তিন প্রার্থীর মধ্যে৷ এই কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ভোটারের সংখ্যা ১৮ থেকে ২০ শতাংশ৷ মোট ভোটার ১৮ লক্ষের আশেপাশে৷ মহিলা ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৮ লক্ষ৷ এই কেন্দ্রের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা, যা এবারের ভোটে অন্যতম প্রধান ইসু্য হতে চলেছে৷ সেগুলি হল নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া, শিক্ষক সহ রাজ্য সরকারের গ্রুপ-সি এবং গ্রুপ-ডি নিয়োগ দুর্নীতি, হলদিয়া শিল্পাঞ্চলে কর্মসংস্থান না হওয়া, নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় মালবাহী জাহাজের যাতায়াত ক্রমশ কমে যাওয়া এবং সেই কারণে পরিযায়ী শ্রমিক বৃদ্ধি, এগুলিকে সামনে রেখে জোরদার প্রচার চালাচ্ছে বিরোধীরা৷
অন্যদিকে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে শুরু করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারের বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক প্রকল্পকে সামনে রেখে বিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য তৃণমূলেরও প্রচার চলছে জোরকদমে৷
এই ত্রয়ীর নির্বাচন নিঃসন্দেহে চিত্তাকর্ষক হতে চলেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ হিন্দু মহল্লাতে বিজেপির প্রচার অন্যদের তুলনায় খানিকটা বেশি৷ উল্টোদিকে সংখ্যালঘু এলাকায় তৃণমূল ও বাম প্রার্থীর উপস্থিতি বিজেপির চেয়ে বেশি৷ উল্লেখ্য, তমলুক লোকসভার অধীন রয়েছে সাতটি বিধানসভা৷ পাঁশকুড়া পূর্ব, নন্দকুমার, মহিষাদল, হলদিয়া, নন্দীগ্রাম, ময়না, তমলুক৷ এই সাতটি বিধানসভার মধ্যে চারটি তৃণমূল কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে৷ বিজেপির দখলে রয়েছে হলদিয়া, নন্দীগ্রাম, ময়না এই তিনটি বিধানসভা৷ পঞ্চায়েত নির্বাচনের নিরিখে তমলুক লোকসভায় তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিপক্ষের থেকে অনেক এগিয়ে থাকলেও লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্র ধরে রাখার জন্য মরিয়া শুভেন্দু অধিকারী৷ কারণ, তিনি দলবদল করে বর্তমানে বঙ্গ বিজেপির অন্যতম প্রধান মুখ৷ স্বাভাবিকভাবে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার দু’টি লোকসভা আসনে তৃণমূলকে বেকায়দায় ফেলার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন তিনি৷ সেই কারণে বাম এবং বিজেপি প্রার্থীদের বলতে হচ্ছে শুভেন্দুর মেশিনারি মোকাবিলা করাটাই তাঁদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ৷ হাতের তালুর মতো তিনি এই এলাকা চেনেন৷ শুধু তাই নয়, অঞ্চল এবং বুথস্তরে নেতাদের নামও শুভেন্দুর কাছে অজানা নয়৷ এই পূর্ব মেদিনীপুর থেকে রাজনীতিতে উত্থান ঘটেছিল শুভেন্দুর৷ তাঁর রাজনৈতিক অাঁতুড়ঘরে তৃণমূল ও বাম প্রার্থী এত সহজে বিজেপিকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে নারাজ৷ অধিকারী দুর্গে আঘাত হানার জন্য তরুণ তৃণমূল প্রার্থীকে সামনে রেখে আসলে সব শক্তি উজাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করছেন মমতা এবং অভিষেক৷ কারণ নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল সুপ্রিমোর হার ভালোভাবে নেয়নি শাসক দল৷
লোডশেডিং করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানো হয়েছে, এই অভিযোগে মামলাও হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে৷
ফলে তমলুকে বিজেপি প্রার্থীকে হারিয়ে সেই ক্ষতে প্রলেপ দিতে চায় তৃণমূল৷ অন্যদিকে সিপিএমের সায়ন ব্যানার্জির সাফ কথা, দুই ফুলের উগ্র গন্ধে নাজেহাল মানুষ৷ তাঁরা বিজেপি এবং তৃণমূল থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইছে৷ মানুষ তাঁদের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছেন দেশের পক্ষে মোদি এবং রাজ্যের পক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল কতটা বিপজ্জনক৷ রুটি-রুজি এবং কর্মসংস্থানের প্রশ্নে মানুষ বামেদেরকেই বেছে নেবে৷ যেখানেই যাচ্ছি, সাধারণ মানুষের অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছি৷