নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতার কুর্সিতে বসেই তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার ছক কষে ফেলেছিলেন৷ দলের মধ্যে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীদের যথাসম্ভব সরিয়ে দিয়ে চলার পথ মসৃণ করেছিলেন৷ তৎকালীন শীর্ষ নেতারা যাতে তাঁর পথের কাঁটা হতে না পারেন, তার জন্য নতুন ফর্মুলা চালু করলেন৷ ৭৫ বছর উত্তীর্ণ সব নেতাদের সাংগঠনিক পদ থেকে সরিয়ে মার্গ দর্শকে পরিণত করলেন৷ মোদি প্রবর্তিত ফর্মুলায় বিজেপির লৌহমানব বলে পরিচিত লালকৃষ্ণ আদবানি থেকে শুরু করে মুরলিমনোহর যোশী, সুমিত্রা মহাজনরা মার্গ দর্শকে পরিণত হলেন৷ তারপর থেকে দলে ও সরকারে নিজের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব কায়েমের প্রক্রিয়া চলে জোর গতিতে৷ দলের মধ্যে দ্বিতীয় সারিতে থাকা নেতাদের মধ্যে যাঁরাই নানা কারণে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছিল বেছে বেছে তাঁদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে৷ আসলে মোদি তাঁর আশেপাশে অন্য কোনও নেতার অস্তিত্ব সহ্য করতে পারেন না৷ তাঁর কথাই শেষ কথা৷ এই ভাবনা থেকেই তিনি ‘এক দেশ এক নেতা’র স্লোগান দিয়েছেন৷ ভারতে তিনিই হবেন একমাত্র নেতা৷ তাঁর দলে তো বটেই, অন্য কোনও দলেও কোনও সম্ভাবনাময় নেতার অস্তিত্ব তিনি মেনে নেবেন না৷ এ এক ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিস্ত মানসিকতা৷
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে মোদি দশ বছর আগে নেতৃত্বদানের বয়সসীমা ৭৫-এ বেঁধে দিয়ে আদবানির মতো নেতাদের সরিয়ে দিয়েছিলেন, সেই নরেন্দ্র মোদির বয়স আগামী সেপ্টেম্বরে ৭৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে৷ নিজের তৈরি নিয়ম অনুযায়ী এবার জিতলেও তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব নয়৷ অথচ গোটা নির্বাচনটা হচ্ছে মোদির নামে৷ বিজেপি এখানে অপ্রাসঙ্গিক, মোদিই সব৷ ভোটাররা দলের গ্যারান্টি পাচ্ছে না, পাচ্ছে মোদির গ্যারান্টি৷ তবে কি তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে নিজের তৈরি নিয়ম নিজের হাতেই ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন? যদি উচ্চাভিলাষ সরিয়ে প্রধানমন্ত্রী নাও হন, তাহলে ডান হাত অমিত শাহকে বসিয়ে ক্ষমতার রাশ নিজের হাতেই রাখবেন৷ সেক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারেন যোগী আদিত্যনাথ৷ অতএব অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না যদি যোগীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দেওয়া হয়৷ এর আগে বসুন্ধরা রাজে, শিবরাজ সিং চৌহান, রমন সিংদেরও গুরুত্বহীন ও অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হয়েছিল৷
নরেন্দ্র মোদির স্বৈরাচারী মানসিকতাকেই তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল৷ ক্ষমতায় ফেরার জন্য বিরোধী শক্তিকে নির্মূল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন মোদি৷ জনগণের ভোটে না জিতেও যেমন রাজ্যে রাজ্যে বিরোধী বিধায়ক কিনে ক্ষমতা দখল করে বিরোধীদের দুর্বল করা হয়েছে, তেমনই লোকসভা ভোটে বিরোধীরা যাতে কোমর সোজা করে না দাঁড়াতে পারে তার জন্য বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে ইডি, সিবিআই, আইটি লেলিয়ে দিয়ে তাদের নাস্তানাবুদ করা হচ্ছে অথবা জেলে বন্দি করা হচ্ছে৷ ইতিমধ্যে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছে৷
লোকসভা ভোটের পর যদি কোনওভাবে মোদি ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে, তাহলে দেশের কোনও বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী জেলের বাইরে থাকবেন না৷ এমনকি তেজস্বী যাদব, উদ্ধব ঠাকরেদের মতো বিরোধী নেতাদেরও রাজনীতির ময়দান থেকে সরিয়ে এক দেশ এক নেতার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করা হবে৷ গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করে সেখানে ওড়ানো হবে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের পতাকা৷
আাঁটঘাঁট বেঁধে মোদি সর্বত্র ঘুঁটি সাজিয়ে রাখছেন এক এবং অদ্বিতীয় নেতা হবার বাসনায়৷ কিন্ত্ত এ যাত্রায় তাঁর সেই বাসনা হয়তো অপূর্ণই থেকে যাবে৷ হরিয়ানা, রাজস্থান, কর্ণাটক, দিল্লি, বিহার, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, কেরল, পশ্চিমবঙ্গ সর্বত্র বিজেপির আসন কমবে৷ নিম্নমুখী ভোটের হারে বিজেপি নেতৃত্বের কপালের ভাঁজ আরও চওড়া হচ্ছে৷ সোমবার পঞ্চম দফা চলাকালীনই দিল্লির সদর দফতরে শীর্ষস্তরের নেতাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক সারলেন দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা৷ ভোটের মাঝে বিজেপির এমন স্ট্রোটেজি বৈঠক এক কথায় নজিরবিহীন৷ ২০২৪-ই হয়তো মোদির স্বপ্নভঙ্গের সাল হয়ে উঠবে৷