জনগণের রায় সবসময় ভোটের জয়ে প্রতিফলিত হয় না !

স্বপনকুমার মণ্ডল

জীবনে জয়-পরাজয় থাকলেও জয়েই জীবন দেখার বাতিকগ্রস্ত মনই পরাজয়ে মৃত্যুতে পৌঁছে যায়। অস্তিত্বের সোপানে জয়ের ক্ষুধাই পরাজয়ের গ্লানি বয়ে আনে। জয়ের সাফল্যে মুখে হাসি আর তার ব্যর্থতায় বোবাকান্না । সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী মানে বিরোধী, আর বিরোধী মানেই শত্রু । তখন স্বাভাবিক ভাবেই ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’র দুর্নীতি সক্রিয় হয়ে ওঠে । আর এই শত্রুতাবোধ থেকেই গণতন্ত্র আজ বিপন্ন। সেখানে গণতন্ত্রের আশীর্বাদই তার অভিশাপ হয়ে উঠেছে । মুখে গণতন্ত্র বললেও মনে তার একনায়কতন্ত্র । স্বাভাবিকভাবেই তাতে গণের তন্ত্রই ষড়যন্ত্রের শিকার, আর তার সাফল্যেই ব্যর্থতার আধার। যা ছিল সমাধানের শ্রেষ্ঠ পথ,তাই আজ সমস্যার বিপথ। সরকারের নির্বাচনে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে ব্যক্তিগত বা দলগত স্বার্থরক্ষার প্রকট আয়োজন । সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতের ভিত্তিতে শাসন-শোষণের মৌরসী পাট্টা লাভের নির্বাচনই আজ প্রশ্নের সামনে এসে পড়েছে । বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের মতো নানা রকমের ফন্দিফিকিরের প্রকট উপস্থিতি থেকে বিপক্ষের প্রার্থীকে হাতে, নয় ভাতে মারার প্রচ্ছন্ন বা প্রকট চেতাবনি গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে । তার চেয়েও ভয়ঙ্কর মনে হয় যখন তার প্রতিরোধে বা প্রতিবিধানে প্রশাসনের নীরবতা থেকে সেই চেতাবনিতেই সক্রিয় ভূমিকা উঠে আসে। যেন তেন প্রকারে জয়ী হওয়ার আয়োজন সেখানে আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে । গণতন্ত্রে নির্বাচনের মাধ্যমেই তার সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে । অথচ সেই নির্বাচনই আজ নির্বিচারে তার মৃত্যু ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে! আসলে আমরা গণতন্ত্র পেলেও তার সৌরভ আমাদের অধরা মাধুরী ।

আধুনিক সভ্যতায় মানুষের কাছে গণতন্ত্রই শ্রেষ্ঠ উপহার । সেখানে উনিশ শতকের নবজাগরণের পথে আধুনিকতার আলো যত ছড়িয়েছে,তার মননের অন্ধকার তত ঘুচেছে,ততই জ্বলেছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো, যুক্তির রংমশাল । সেখানে ঈশ্বর বা ধর্মবিশ্বাসের অন্ধভক্তির পরিবর্তে যুক্তি ও প্রমাণ যত মান্যতাবোধে জাগ্রত হয়েছে,তত মানুষের অধিকারবোধ তীব্র গতি লাভ করেছে,ততই গণতন্ত্রের পথ প্রশস্ত হয়েছে । সেই গণতন্ত্রে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার ত্রিবেণী সঙ্গমে মানুষের অধিকারবোধ সামাজিক শৃঙ্খলমোচনেও সক্রিয় করে তোলে । উনিশ শতকেই ব্যক্তি বনাম সমাজের ঘাত-প্রতিঘাত নানাভাবে মূর্ত হয়ে পড়ে। সমাজ-সংস্কারের মধ্যেও সেই ব্যক্তির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সক্রিয় ছিল । বিশ শতকে সেই স্বতন্ত্রতার আলোয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ প্রকট হয়ে ওঠে ।  এতে সমাজের সঙ্গে ব্যক্তিমানসের নিবিড় সংযোগ শিথিল হয়ে পড়লেও তা একেবারে নিঃস্ব করে তোলেনি। কেননা সমাজবদ্ধ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও সমষ্টিচেতনায় সমাজের ভূমিকা অনস্বীকার্য । কেউ একা চলতে পারে না, পারস্পরিক সম্পর্কের ভিতেই মানুষের সভ্যতা এগিয়ে চলে। আবার সেখানেই বিকল্প সমাজের ধারণায় রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রভাব তীব্রতা লাভ করে । সমাজের মধ্যে তার ছায়া ঘনিয়ে আসে। একদিকে সমাজের অস্তিত্ব যখন বিপন্নপ্রায়, অন্যদিকে রাজনৈতিক সমাজের উত্থান ঘটে। আর সেখানেই গণতন্ত্রের মানবিক ভূমিকাই দানবিক হয়ে ওঠে ।


যুক্তির আলোতে শুধু ভক্তির অন্ধত্ব দূর হয় না, অন্ধ আনুগত্যও চলে যায় । ব্যক্তির অধিকারবোধও সক্রিয় হয়ে ওঠে । শিক্ষা-সংস্কৃতির বিস্তারে বাইরের দৃষ্টি যত দ্রুত প্রসারিত হয়, অন্তর্দৃষ্টি তার চেয়েও বেশি বৃদ্ধি পায় । আর সেখানেই গণতান্ত্রিক চেতনায় যুক্তিবোধ যত প্রখরতা লাভ করে, ততই তাতে ব্যক্তিস্বার্থের চেতনা ঘনিয়ে ওঠে। মানুষ স্বভাবতই নিজেকে ভালোবাসে, নিজের স্বার্থসিদ্ধিতেই সাফল্য খুঁজে পায়। যতক্ষণ নিজের অতৃপ্তি না মেটে,ততক্ষণ অন্যের দিকে ফিরে তাকায় না। সেক্ষেত্রে যুক্তির তীব্রতায় ‘আপ ভালা তো জগৎ ভালা’র আত্মকেন্দ্রিকতা সক্রিয় হয়ে ওঠে । যে যুক্তিবোধে আধুনিক মানুষ গণতন্ত্রের মাধ্যমে  দাসত্বমোচন থেকে মুক্তির পথে রাজত্বের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল,তা অচিরেই সর্বজনীনতায় দুঃস্বপ্নে মিলিয়ে যায় ।

যেখানে সবার মনে রাজার বাস, সেখানে তার রাজত্বের বিস্তার অতিদ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে শহরতলি, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। স্বাভাবিকভাবেই তাতে রাজ করার নীতিতে গণতন্ত্রের উদার হাতছানি সবাইকে আমন্ত্রণ জানায়,সকলে সাড়াও দেয়। অথচ আপন স্বার্থসিদ্ধিতে মনের রাজা ধনেও রাজা হতে চাইল,মানেও চাইল রাজকীয় সমাদর। সেদিক থেকে জনগণের ক্ষমতায়নে গণতন্ত্র মাধ্যম না হয়ে প্রকৌশল হয়ে উঠল। তখন ‘আমরা করব জয় নিশ্চয়’-এর ‘আমরা’ ‘আমি’তে এসে ঠেকে।  ক্ষমতায়নের হাতছানিতে সমাজ অকেজো হয়ে পড়ে, বহুধাবিভক্ত রাজনৈতিক সমাজ গড়ে ওঠে। সেখানে সমাজপতি নেই,কিন্তু অসংখ্য দলপতির জন্ম হতে থাকে । যত দলের প্রভাব বাড়ে,ততই জনগণের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। দলীয় পরিচয়ই সেখানে প্রাধান্য লাভ করে। ‘কোন্ দল’ থেকে কোন্দল শুধু সময়ের অপেক্ষায় ওত পেতে থাকে । শুধু তাই নয়, ভিন্ন মত হলেই বিরোধী দলের লোক বলে উপেক্ষা করার প্রবণতা তাতে সক্রিয় ।  দলীয় ব্যবস্থায় যেখানে অগণতান্ত্রিক সঙ্কীর্ণতা তীব্রতা লাভ করে, সেখানে ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের পথটিই আপনাতেই দুর্গম হয়ে ওঠে। ক্ষমতা লাভ করাই লক্ষ্য হয়ে ওঠায় গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পথটিকেই কণ্টকাকীর্ণ মনে হয় । আর সেখানেই দলীয় অস্তিত্ব প্রকট হয়ে ওঠে । যেখানে ব্যক্তি বড় অসহায়,সেখানেই সংগঠনের আধিপত্য ।

অন্যদিকে জনগণের রায় আর ভোটের জয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক । সেখানে জনগণের জয় প্রতিফলিত হয় না,সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ের নামে দলীয় জয়োচ্ছ্বাসই মান্যতা লাভ করে । আর তার সাফল্যেই গণতন্ত্রের জনকণ্ঠ চাপা পড়ে যায়, বিপক্ষের মনে জেগে ওঠে অস্তিত্ব সংকটের বিপন্নতাবোধ ।

নির্বাচনের পথের কাঁটা দূর করার জন্য যে সঙ্ঘশক্তির প্রয়োজন,তাতেই দলীয় সংগঠনের যূথবদ্ধ শক্তির বিস্তার সর্বব্যাপী । তাতে গণতন্ত্রের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে দলতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত স্বাভাবিক । অন্যদিকে জনগণের নির্বাচনের চেয়ে নির্বাচনের জনগণ আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। সেখানে আমরা-ওরা’র বিভাজনে বৈষম্যপীড়িত জনসাধারণ পরের নির্বাচনে পালাবদলের প্রতীক্ষায় থাকে । গণতন্ত্রের সৌরভও তার অধরা মাধুরী । সাম্য নিয়ে দলীয় স্তরে বা তার প্রার্থী বাছাই-এ যাও-বা লক্ষ করা যায়, দলের বাইরে শুধুই বৈষম্যের ঘনঘটা । শুধু তাই নয়, সেই বৈষম্যবোধ জিইয়ে রেখে দলীয় স্বতন্ত্র আভিজাত্য খোঁজার বাতিক সমান সচল । গণতন্ত্রের লক্ষ্য যা ছিল মিলনের বাণী, ক্রমশ তাই হয়ে ওঠে বিচ্ছেদের পারানি । স্বাভাবিক ভাবেই মৈত্রীও দলীয় স্তরে সীমাবদ্ধ । এসব না থাকাটাই জনমনে যত স্বাভাবিকতা লাভ করে, গণতন্ত্রের ট্রাজিক পরিণতি ততই প্রকট হয়ে পড়ে । অন্যদিকে গণতন্ত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী স্বাধীনতাই অন্যদুটির চেয়ে ভয়কেও ছাপিয়ে যায় । ভয় হয়ে ওঠে আতঙ্ক । স্বাধীনতার নামান্তরে স্বেচ্ছাচারিতা সক্রিয়তা লাভ করে । অন্যের অধিকার হরণেই তার অবাধ বিস্তার, ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে চলাতেই তার বাহাদুরি । এই স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে যেমন কায়েমি স্বার্থ জড়িত থাকে,তেমনই ক্ষমতায় নির্বিরোধী আধিপত্যের মানসিকতাও ভর করে। শুধু তাই নয়, ক্ষমতায়নের লক্ষ্যেই নির্বাচন থেকে উন্নয়নের ছকবন্দি ধারণাই সকলের মধ্যে মান্যতা পেয়ে যায় । সেখানে দলীয় নীতি আদর্শের চেয়ে ক্ষমতায়নই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে । নির্বাচন তার ছাড়পত্র পাওয়ার আয়োজন । আর তাতে প্রতিশ্রুতি থেকে উন্নয়ন সবেতেই ক্ষমতায়নের রণকৌশল। গণতন্ত্র নয়,দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই তার প্রথম ও শেষ কথা। ক্ষমতায়নের পথে জনগণ ভোটারে পরিণত হয়, তার মতামতই ভোট হয়ে ওঠে । সেক্ষেত্রে জনগণের সার্বিক উন্নয়ন নয়, দলের লোকজন বা দলীয় স্বার্থ বিস্তার করাই তার পাখির চোখ ।

স্বাভাবিকভাবেই তাতে নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই  জনমানসে অশনি আতঙ্ক নানাভাবে নেমে আসে । সেখানে ক্ষমতায়নের চেয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে । গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যা ছিল জনগণের ক্ষমতায়ন,তাই অচিরে পরিণত হয় জনসাধারণের ক্ষমতাকেই নিঃস্বকরণ। সেখানে ভোটে জেতার জন্য মরিয়া চেষ্টার মধ্যেই গণতন্ত্রকে অস্বীকার করার প্রবণতা জারি থাকে । একটি পরিবারের মধ্যেই যেখানে তীব্র মতানৈক্য দেখা দেয়, সেখানে প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের ক্যারিশমায় ছড়িয়ে পড়ে ! । নির্বাচনের সূচনা থেকেই পারস্পরিক বিবাদ-বিতর্ক থেকে রক্তক্ষয়ী হানাহানি চলতে থাকে। আত্মবিশ্বাসের অভাব হলেই লোকে অবৈধ পথের আশ্রয় নেয় । তাতেও জয় নিশ্চিত মনে না হলে বা আত্মবিশ্বাস ফিরে না পেলে প্রতিদ্বন্দ্বীকেই নিঃস্ব করায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। ভোটে জিততে গিয়ে আসলে গণতন্ত্রকে পরাজিত করা হয় । জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে অবৈধ পথে জেতার মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র বেঁচে ওঠে,গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় । কেননা গণতন্ত্র জনগণের মতামতকেই প্রতিষ্ঠা করতে বলে। অবৈধ পথে জিতের চেয়ে বৈধ পথে হারাও তার গৌরব। ছলেবলে জিত নয়, জনগণকে জেতানোই গণতন্ত্রের লক্ষ্য । আমরা কি এখনও গণতন্ত্রমনস্ক হতে পারিনি? না হলে জেতার এত প্রাণঘাতী লড়াই বা সংঘবদ্ধ সাংগঠনিক ষড়যন্ত্র কেন? এত গণতন্ত্রে অনাস্থারই নামান্তর!