• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল চাকরিপ্রার্থীদের সংকটকে আরও দিশেহারা করে তুলেছে!

স্বপনকুমার মণ্ডল ইতিমধ্যে অষ্টাদশ লোকসভা শেষ হয়েছে। দেশে নতুন সরকারও কাজ শুরু করেছে। অন্যদিকে সারা দেশজুড়ে নির্বাচন হলেও রাজ্যের মানুষের কাছে এবারের নির্বাচন অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। রাজ্যের বিপুল দুর্নীতি থেকে অরাজকতা, কর্মক্ষেত্রে নিয়োগে অচলাবস্থা থেকে শিক্ষাব্যবস্থাতে লক্ষ্যহীন অনিশ্চয়তা প্রভৃতি বহুমুখী অস্তিত্ব-সংকটে শাসকবিরোধী মানসিকতা ক্রমশ তীব্রতা লাভ করে। স্বাভাবিকভাবেই সেক্ষেত্রে লোকসভা নির্বাচনেই কেন্দ্রের

স্বপনকুমার মণ্ডল

ইতিমধ্যে অষ্টাদশ লোকসভা শেষ হয়েছে। দেশে নতুন সরকারও কাজ শুরু করেছে। অন্যদিকে সারা দেশজুড়ে নির্বাচন হলেও রাজ্যের মানুষের কাছে এবারের নির্বাচন অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। রাজ্যের বিপুল দুর্নীতি থেকে অরাজকতা, কর্মক্ষেত্রে নিয়োগে অচলাবস্থা থেকে শিক্ষাব্যবস্থাতে লক্ষ্যহীন অনিশ্চয়তা প্রভৃতি বহুমুখী অস্তিত্ব-সংকটে শাসকবিরোধী মানসিকতা ক্রমশ তীব্রতা লাভ করে। স্বাভাবিকভাবেই সেক্ষেত্রে লোকসভা নির্বাচনেই কেন্দ্রের থেকেও রাজ্যের পালাবদলের উত্তেজনা অনেকের শীতার্ত মনে উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয়। সেখানে নির্বাচনে তার প্রতিফলনে শাসক-বিরোধী দলগুলির আশ্বাসের মধ্যেও সেই স্বপ্নকে আরও নিবিড় করে তোলে। যার ফলে রাজনৈতিক দলের বাইরে যারা মুক্তির প্রতীক্ষায় ভোটের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে ছিল, তারা অনেকেই উল্টো ফলাফলে হতাশ হয়ে পড়ে। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে রীতিমতো দিশাহীনতায় ভুগতে শুরু করে। নিরাশাগ্রস্তদের মনে একটাই প্রশ্ন, ‘এবার কী হবে ?’ তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কাউকে খুঁজে না পাওয়ার অনিশ্চয়তার আতঙ্কই শুধু নয়, সেই সঙ্গে শাসকের প্রতিশোধের ভয়ও সক্রিয় হয়ে ওঠে। একদিকে শাসকবিরোধী দলগুলি নিজেদের অস্তিত্ব-সংকটে পড়ে আত্মসমীক্ষায় ফিরে আগামী নির্বাচনের প্রত্যাশায় এগিয়ে যাবে। অন্যদিকে শাসকের প্রতিশোধস্পৃহায় উপেক্ষা আর বঞ্চনার ভয় আরও বেশি করে জেগে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক প্রবণতা।

কেননা চাকরিপ্রার্থীদের তীব্র আন্দোলনের নেপথ্যে বিরোধীদের ইন্ধন বা চক্রান্ত দেখেছিল সরকার। শুধু তাই নয়, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চাকরিপ্রার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর কথাও সরকারবিরোধী দলগুলি করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই তাতে শাসকদলের কাছে তা সরকারবিরোধী আন্দোলনে সামিল হয়ে পড়ে। এজন্য নানাভাবে দীর্ঘদিনের সেই আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকার যেমন ব্যর্থ হয়, তেমনই বিরোধী দলের চক্রান্ত বলে দেগে দেওয়াও অব্যর্থ হয়ে ওঠে। অথচ বিষয়টি সেরকম নয়। বিরোধী দলগুলো সমর্থন করলেও তা ছিল একান্তই চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন। সেখানে নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনাদেশ নিয়ে শাসকদল পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই সরকারের সহযোগিতা পাওয়ার পথটি আরও বেশি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সেখানে বিশেষ করে যারা শিক্ষাক্ষেত্রে চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছে বা যোগ্য চাকরি হারা হয়ে সরাসরি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে পথে নেমেছে, আজ তাদের সামনে অজানা আশঙ্কা, অচেনা অনিশ্চয়তা তীব্র আকার ধারণ করেছে ।

শাসকের শ্রীবৃদ্ধিই সেখানে শুধু আন্দোলনের অভিমুখকে শ্রীহীন করে তোলেনি, এতদিন ধরে আগলে রাখা বিশ্বাসের বাতিঘরটিই আজ অস্তিত্ব-সংকটের ফেরে পড়েছে। খবরের কাগজেও তার পরিচয় প্রকট হয়ে ওঠে। ৪ জুন মঙ্গলবার লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের দিন গান্ধী মূর্তির পাদদেশে ধর্না মঞ্চ ছিল শুনশান। তার পরের দিন ১২-১৩ জন এলেও সকাল সকাল তাঁরা ফিরে যান। ৬ জুন খবরের শিরোনাম হয় ‘ধর্না মঞ্চের প্রার্থীরা তাকিয়ে কোর্টের দিকে’। সেখানেই শেষ নয়। চাকরিপ্রার্থীদের করুণ পরিণতির প্রতি সংবাদমাধ্যমের সজাগ দৃষ্টি ছিল বরাবর। তাদের আন্দোলনকে প্রচারের আলোতে তুলে ধরার ক্ষেত্রে বিরোধী দলের চেয়েও সংবাদমাধ্যমের নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা বর্তমান। সেক্ষেত্রে চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির প্রতি সংবাদমাধ্যমের তৎপরতা ভোটের পরেও সমান সক্রিয়। ধর্নাস্থল শূন্য হয়ে যাওয়া থেকে ‘অভাবে শহরের ভাড়া বাড়ি ছাড়ছেন চাকরিপ্রার্থীরা’র খবরও মেলে। সেখানে শুধু ধনের অভাবই নয়, মনের অভাবও তীব্র।

ইতিমধ্যে যে বিশ্বাসকে পুঁজি করে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল, সেই বিশ্বাসের অভাবই সেখানে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। খালি পেটে স্বপ্নে শুধু খাবার আসে। আবার বিশ্বাসের অভাব হলে স্বপ্নও ছেড়ে চলে যায়। স্বপ্নহীন জীবন অচল-অসাড়। সেখানে নির্বাচনের ফলাফলে চাকরিপ্রার্থীদের মনে প্রাথমিকভাবে সেই স্বপ্নহীন জীবনের আতঙ্ক জেগে ওঠে। সরকারি ঔদাসীন্যে ও বিরোধী দলের অস্তিত্ব সংকটে বাংলার চাকরিপ্রার্থীদের দিশাহীন অচলাবস্থা ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করেছে। লোকসভা নির্বাচনের পরে তা তীব্র সংকটের মুখোমুখি। সেখানে নির্বাচনের ফলাফলের প্রভাবে ধর্না দেওয়া বা আন্দোলন করার পথটিই আজ রুদ্ধপ্রায়। কোর্টের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া অন্য কোনও পথ আর খোলা নেই। আবার সে পথের দীর্ঘসূত্রিতাও চাকরিপ্রার্থীদের সুরাহার পথকে আরও সুদীর্ঘ করে তুলেছে। সর্বত্র তার অশনি সংকেত, হতাশার নিবিড় আয়োজন। তার মধ্যে নির্বাচনের ফলাফলেও ছিল তার ভয়ঙ্কর পরিণতির আভাস !

আয়োজন যেমনই হোক প্রয়োজনই শেষ কথা বলে। সেখানে চাকরির প্রয়োজনে রাজ্যের শাসকবিরোধী মানসিকতা তো ছিলই, আরও ছিল দুর্নীতির অরাজকতা থেকে মুক্ত হওয়ার তীব্র আকুতি। সেখানে শাসকদলের বিপুল জয়ে সে স্বপ্ন ভেঙে যায়, জীবন দিশাহীন হয়ে পড়ে। এজন্য ‘এবার কী হবে’র প্রশ্নটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ফেসবুকের চলমান ভাষ্যে তার পরিচয়ও নানাভাবে উঠে আসে। তাতেই বোঝা যায়, সংকটটা কত গভীরে। সেখানে জনৈক ছাত্র তার ভোটের ফলে উচ্ছ্বসিত কলেজের শিক্ষককে ‘আমাদের এবার কী হবে স্যার’ বলে সবিনয়ে উত্তরের জন্য মুখিয়ে ওঠে।

দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সেই শিক্ষক তাঁর প্রাক্তন ছাত্রের করুণ অবস্থার প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে চাকরি হারানোর চেয়েও দেশ হারানোর ভয় আরও আতঙ্কের বলে বুঝিয়ে দেন। সেখানে রাজ্যের চেয়েও কেন্দ্রের শাসক পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই একজনকে দুর্বল করতে অন্য কাউকে সবল করা জরুরি। সেখানে রাজ্যের শাসক দলের বাইরেও আরও অনেক দল ছিল। সেই দলগুলোর কোনও একটির প্রতি আস্থা রাখলে কেন্দ্র বা রাজ্যের দুটি ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য সফল হতে পারত। অথচ ক্ষমতার অঙ্ক অত সহজ পথে চলে না। সেখানে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র অত্যন্ত জরুরি। স্বরচিত যুক্তির ফাঁকেও থেকে যায় অস্তিত্বের স্বার্থপরতা, স্বরচিত অঙ্কের হিসেবনিকেশ। ক্ষমতার ভরকেন্দ্রকে সুনিশ্চিত করতে গিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের জীবন আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সেক্ষেত্রে ক্ষমতায়নের অঙ্ক মিলে গেলেও চাকরিপ্রার্থীদের জীবনের অঙ্ক মেলানো যায় না! নির্বাচনের ফলাফলেরও শিকার আজ রাজ্যের অগণিত চাকরিপ্রার্থীরা, ভাবা যায়!