বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম জনস্বার্থে রাজনৈতিক দলও গড়েছিলেন, ভোটেও দাঁড়িয়েছিলেন!

স্বপনকুমার মণ্ডল

জীবনযুদ্ধের অপরাজেয় সৈনিক ছিলেন কাজি নজরুল ইসলাম৷ তাঁর লড়াকু মনের নেপথ্যেই ছিল জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা৷ বৈষম্যপীড়িত সমাজের শোষণ-শাসনের ছকবন্দি জীবন থেকে মুক্তিপিয়াসী মনের তীব্র প্রতিবাদই তাঁকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল৷ সেখানে দেশের চেয়ে দশের কথাই তাঁকে বেশি ভাবিয়েছে, স্বাধীনতা আন্দোলনের চেয়ে মানুষের জীবন সংগ্রাম বা বেঁচে থাকার লড়াইয়ের প্রতি তাঁর অন্তর্দৃষ্টি জ্বলে উঠেছে৷ রুশ বিপ্লবোত্তর বাংলা সাহিত্যে সাম্যবাদী চেতনার বিস্তারে তাঁর অবিসংবাদিত ভূমিকা আপনাতেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ এখনও সমাজের বিভেদকামী শক্তির শোষণ- শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহী সত্তাই বাঙালিমানসে অনির্বাণ দীপশিখা হয়ে ওঠে৷ উৎপীড়িতের ক্রন্দন বা অত্যাচারিতের আর্তনাদের বিরুদ্ধে তাঁর ‘বিদ্রোহী’র অস্তিত্ব আজও সজীব ও সরব৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজি নজরুল ইসলাম দুজনেই গ্রীষ্মের সন্তান৷ প্রথমজন গ্রীষ্মের মধ্যে ঋষিকে দেখেছেন৷ সমস্ত প্রতিকূল আবহের মধ্যে ঋষির সাধনায় সৃষ্টির প্রাণশক্তিকে খুঁজে ফিরেছেন কবি৷ অন্যদিকে সমস্ত প্রতিকূলতাকে ধ্বংস করে সৃষ্টিকে সুরক্ষা দিতে চেয়েছিলেন নজরুল৷ তাঁর কাছে কালবৈশাখীর ধ্বংসলীলাও নতুনের আগমনের বার্তা বয়ে আনে, জয়ধ্বনি আমন্ত্রণ জানায়৷ যেখানে রবীন্দ্রনাথ বৈশাখের আমন্ত্রণে সতৃষ্ণ, সেখানে নজরুল জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে নতুনের আহ্বানে মুখর৷ ধ্বংসকামী চেতনায় থাকে প্রতিবাদের পরাকাষ্ঠা, নবজীবনের হাতছানি৷ সেখানে অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত নজরুল৷ আগুন শুধু পোড়ায় না, তাপও দেয়,আলোও দেখায়৷ সেদিক থেকে নজরুল আলোকদিশারি৷ স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর স্বাধীনচেতা মনে কোনোরকম সংযমী আড়াল ছিল না,আলোর মতোই তা স্বচ্ছ ও স্পষ্ট আড়ালহীন৷ কোনো রকম ধানাইপানাই সেখানে নেই, নির্ভীক যোদ্ধার মতোই তাঁর স্পষ্টবাকমূর্তি৷ অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাঁর আগমন আভিজাত্যে আবির্ভাব হয়ে ওঠে৷ দেশের মানুষের দুর্দশার কথাই শুধু তাঁর কবিতায় উঠে আসেনি, তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদই সেখানে মূর্ত হয়ে ওঠে৷ এজন্য দেশের পরাধীনতায় তাঁর আত্মগ্লানিবোধে কবিজনোচিত সংযমী অনুশোচনা আত্মগোপন করেনি,বরং তীব্র প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে৷ সেখানে নজরুল প্রতিবাদী কণ্ঠে সর্বপ্রথম দেশের পূর্ণ স্বাধীনতা বেরিয়ে আসে৷ শুধু তাই নয়, তিনি কবি হয়েও নিজেই একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন৷

আসলে নজরুল তাঁর জীবনের পাঠশালাতেই আতীব্র মানবতাবাদের পাঠ লাভ করেন৷ এজন্য তাঁর মনে বিদেশি সাদা ইংরেজের সঙ্গে দেশি কালো ইংরেজের একাকার হয়ে ওঠে৷ অন্যদিকে দেশের মানুষের প্রতি তাঁর সহমর্মিতার কোনো অভাব ছিল না৷ শুধু তাই নয়, সেখানে পদানত দেশবাসীর দাসত্বের জীবন যে তাঁকে কুরে করে খেত,তা তাঁর অচিরেই স্বাধীনতা লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশের মধ্যেই প্রকট হয়ে ওঠে এবং এজন্য তাঁকে কম মূল্য চোকাতেও হয়নি৷ মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে তাঁর যৌথ সম্পাদনায় ১৯২০-এর ১২ জুলাই সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশিত হয় এবং ১৯২১-এর জানুয়ারিতে তা বন্ধ হয়ে যায়৷ এতে নজরুলের অসংখ্য গদ্যরচনায় শাসকবিরোধী প্রতিবাদ ধ্বনিত হলেও সেগুলো তাঁর স্বনামে প্রকাশিত না হওয়ায় সেসব আড়ালে থেকে যায়৷ সম্পাদকীয় স্তম্ভে প্রকাশিত সেসব লেখাই যখন ১৯২২-এর অক্টোবরে ‘যুগবাণী’ নামে প্রবন্ধের বই হয়ে প্রকাশিত হয়,তখন বইটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে নিষিদ্ধ হয়ে যায়৷ নজরুলের কবিতা বা কাব্যের নিষিদ্ধ হওয়ার অনেক আগেই প্রবন্ধের বইটি নিষিদ্ধ হয়েছিল৷


প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নজরুলের আট বছরে পাঁচটি বই ইংরেজ সরকার নিষিদ্ধ করে৷ বাকি চারটি ‘বিষের বাঁশী'(১৯২৪), ‘ভাঙার গান'(১৯২৪), প্রলয়শিখা'(১৯৩০) ও গানের সংকলন ‘চন্দ্রবিন্দু'(১৯৩১)৷ আরও যেগুলি নিষিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, সেগুলি হল ‘অগ্নি-বীণা’ (১৯২২), ‘সর্বহারা'(১৯২৬), ‘রুদ্রমঙ্গল'(১৯২৬), ‘ফণিমনসা’ (১৯২৭), ‘সঞ্চিতা'(১৯২৮) প্রভৃতি৷ নজরুলের প্রতিবাদ যে থেমে থাকার নয়,বরং ক্রমশ বিদ্রোহে তীব্র আকার ধারণ করে,তার পরিচয় অচিরেই বেরিয়ে এসেছে৷ ‘নবযুগ’ বন্ধ হওয়ার অনতিকাল বিলম্বে তাঁর ‘কামালপাশা’ থেকে ‘বিদ্রোহী’র আবির্ভাব ঘটে৷ ১৯২২-এর ৬ জানুয়ারি সাপ্তাহিক ‘বিজলী’তে ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টির অব্যবহিত পরিসরেই ১৯২২-এর ৩০ জানুয়ারি চিত্তরঞ্জন দাশের ‘বাঙ্গালার কথা’য় বিদ্রোহী কবি ‘ভাঙার গান’ প্রকাশিত হয়৷ সেই কারার লৌহকপাট ভাঙার বার্তাতেই ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের আহ্বান যা অচিরেই নজরুলকে আরও বেশি লক্ষ্যভেদী করে তোলে৷ শারদীয়ার দুর্গার মধ্যেই জেগে ওঠে তাঁর দেশমাতৃকার করুণ মূর্তি৷ এজন্য আনন্দবাজার পত্রিকার পূজা সংখ্যার আমন্ত্রণের লিখে ফেলেন ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ দীর্ঘ কবিতাটি৷ তার ছত্রে ছত্রে কবির দাসত্ব মুক্তির তীব্র আহ্বান প্রতিধ্বনিত হয়েছে৷ এজন্য ইংরেজ সরকারের ভয়ে সেটি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি৷ তৎকালীন পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মৃণালকান্তি ঘোষ তার পরিবর্তে অন্য কবিতা চেয়ে নেন৷ অন্যদিকে নজরুল থেমে থাকার পাত্র নন৷ ইতিমধ্যে বৈষম্যপীড়িত সমাজের শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর সম্পাদিত অর্ধ-সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ (১৯২২-এর ১১ আগস্টে সূচনা) প্রকাশিত হয়৷

‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি অবশেষে সেই ‘ধূমকেতু’তে (২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২) প্রকাশিত হলে বিদেশি শাসকের রোষানলে পড়ে৷ যে কবিতা আনন্দবাজার পত্রিকায় seditions Act-এর ভয়ে ছাপা হয়নি,তাই নজরুল নিজের পত্রিকায় ছেপেছিলেন! আসলে তাঁর মধ্যে যে বিদ্রোহী সত্তা ছিল, তাতে কোনোরকম বাধা বিপত্তি মেনে চলার দৈন্য ছিল না৷ প্রকাশই তাঁর অস্তিত্বের সোপান হয়ে ওঠে৷ কবি হয়ে রাজনীতি করা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা’র(‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায়) রসিকতাকেই নজরুল শিরোধার্য করেছিলেন৷ ‘ধূমকেতু’র জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা আশীর্বাণীতেও(২৪ শ্রাবণ ১১২৯) নজরুলের রাজনীতি করার সদিচ্ছাকে সমর্থন করেছেন বলে মনে করেন মুজফ্ফর আহমদ৷ সেই আশীর্বাণীতে শেষ দুই লাইনে কবি জানিয়েছেন : ‘জাগিয়ে দে তোর চমক মেরে/ আছে যারা অর্দ্ধচেতন৷’ সেই জাগিয়ে তোলার অব্যর্থ প্রয়াসে ‘ধূমকেতু’ তীব্র গতিতে ছুটে চলে৷ ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ তারই প্রকাশ চমকে দেয়: ‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?/ স্বর্ণ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাঁড়াল৷’ আসলে নজরুলের দুঃসাহসী প্রকৃতির মধ্যেই ছিল লক্ষ্যভেদী অর্জুনের আদর্শ৷ এ জন্য তাঁর কাছে রাজনীতিও স্বাভাবিকতা লাভ করে৷ দেশ ও দশের স্বার্থে তাঁর লেখনীর সক্রিয়তা পত্রিকা সম্পাদনাতেও সমান মুখর৷ সেখানে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ও ঋজু বক্তব্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জনতার দরবারে বিপুল সাড়া ফেলে দেয়৷

রাজনৈতিক মতবাদের চেয়ে মানবতার আদর্শই ছিল নজরুলের পাথেয়৷ ‘ধূমকেতু’র আগে ১৯২২-এর মাঝামাঝি অসহযোগ আন্দোলনের প্রচারমূলক পত্রিকা ‘সেবক’-এর সম্পাদনাতে কিছুদিন যুক্ত হয়েছিলেন৷ অন্যদিকে ১৯২২-এর মে-জুন মাসে গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে৷ সেই সময় কংগ্রেস মতাদর্শের নরম ও চরমপন্থী রূপ প্রকট ওঠে৷ তখন সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনও নিষ্ক্রিয়প্রায়৷ সেই পরিসরে নজরুলের ‘ধূমকেতু’ নতুন করে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে শুধু জাগিয়ে তোলেনি, দাবিদাওয়া নিয়েও সোচ্চার হয়ে উঠেছে৷ সেখানে ‘ধূমকেতু’র লক্ষ্য যে দেশের পূর্ণ স্বাধীনতা,তাও স্পষ্ট করে দেয়৷ ১৯২২-এর ১৩ অক্টোবর ‘ধূমকেতু’র ত্রয়োদশ সংখ্যায় সম্পাদকীয়তে নজরুল সুস্পষ্ট করে জানিয়ে দেন : ‘সর্বপ্রথম, ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়৷ স্বরাজ টরাজ বুঝিনা, কেননা, ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন৷ ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না৷ ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসন-ভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে৷….’ তখন নজরুল তেইশ বছরের যুবক৷ তারুণ্যের সহজাত স্পর্ধায় দেশের পূর্ণ স্বাধীনতার কথা তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় সর্বপ্রথম যেভাবে তুলে ধরেছেন,তাতেই বোঝা যায় নজরুল শুধু কবিতাকেই বক্তব্যের বাহন করে ক্ষান্ত হননি, সার্বিকভাবে শোষণ-শাসনমুক্ত স্বাধীন দেশের লক্ষ্যেই তাঁর লেখনী নিরন্তর সক্রিয় ছিল তাঁর লেখকজীবন জুড়ে৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নজরুল পরবর্তীতে তাঁর ‘আমার কৈফিয়ৎ’ (১৩৩২-এর আশ্বিন সংখ্যায় ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রকাশিত৷) কবিতায় স্বরাজ নিয়ে একই কথা তুলে ধরেছেন৷ কবির ভাষায়, ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ,চায় দুটি ভাত একটু নুন’ বা, ‘আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস!’ এজন্য পূর্ণ স্বাধীনতার পরিবর্তে নজরুলের অন্য কোনো বিকল্প ঠাঁই পায়নি৷ সেই লক্ষ্যে তাঁর জনমত গড়ে তোলায় অবিরাম পথচলা, অফুরান জনসংযোগ৷ সমাজের বৈষম্যপীড়িত শোষিত-শাসিত মানুষের স্বার্থে আরও বেশি সক্রিয় হওয়ার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল গড়ে তোলাতেও তাঁর স্বকীয় ভূমিকা অপূর্ব ইতিহাস সৃষ্টি করেছে৷ জনপ্রিয় কবি হয়েও এবং চরম আর্থিক কষ্টের মধ্যে অস্থির জীবনের প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করেও যেভাবে নজরুলের মধ্যে রাজনৈতিক দল গঠনের তীব্রতা লক্ষ করা যায়, তা শুধু অতুলনীয়ই নয়, বিস্ময়করও বটে৷ বাংলায় তাঁর নজির নেই আর৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নজরুল ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ লেখায় ইংরেজ শাসকের রোষানলে পড়েন৷ তাঁর বিরুদ্ধে ১৯২২-এর ৮ নভেম্বর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার পর ২৩ নভেম্বরে কুমিল্লা থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে৷ ১৯২৩-এর ১৬ জানুয়ারি বিচারে তাঁর এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়৷ জেলেও তাঁর প্রতিবাদ থেমে থাকেনি৷ সেখানে তাঁর ‘শিকল পরার গান’-এ শিকল ভেঙে মুক্তির বার্তা ঝরে পড়ে৷ ১৯২৩-এর ডিসেম্বরে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেও তাঁর প্রতিবাদী সত্তা থেমে যায়নি, কলমও চলেছে,রাজনীতিও জড়িয়েছে৷ ১৯২৪-এর ২৫ এপ্রিল প্রমীলার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হওয়ার পরে দাম্পত্য জীবনও তাঁকে বেঁধে রাখতে পারেনি৷ একাধিক কাব্য প্রকাশিত হয়ে নিষিদ্ধ হয়, রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হন কবি৷ ১৯২৫-এ চিত্তরঞ্জন দাশ থেকে গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে৷ অথচ কারও প্রতি তাঁর অন্ধভক্তি ছিল না৷ শুধু তাই নয়,তিনি অচিরেই সমাজের শোষিত-শাসিত শ্রমজীবী মানুষের জন্য একটি দল তৈরি করেন৷ কুতবুদ্দীন আহমদ, হেমন্তকুমার সরকার ও শামসুদ্দীন হুসয়ন প্রমুখ বন্ধুর সঙ্গে নজরুলের ‘The Labour Swaraj Party of the Indian National Congress’ দলটি ১৯২৫-এর ১০ নভেম্বর গড়ে ওঠে৷ পরবর্তীতে দলটির নামে একাধিক বার পরিবর্তন ঘটে৷ ‘The Bengal Peasants and Workers’ Party’ থেকে শেষে হয় ‘The Workers’ and Peasants Party of Bengal’৷ সেই শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দলের মুখপত্রের হিসাবে সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ পত্রিকাটি (সম্পাদক বাঙালি পল্টনের বন্ধু মণিভূষণ মুখোপাধ্যায়) প্রকাশিত হয় ১৯২৫-এর ১৬ ডিসেম্বর৷ প্রথম সংখ্যাতেই নজরুলের ‘সাম্যবাদী’র কবিতাগুচ্ছে সাতটি কবিতা(‘সাম্যবাদী’, ‘ঈশ্বর’, ‘মানুষ’, ‘পাপ’,বারাঙ্গনা’, ‘নারী’ ও কুলিমজুর’) প্রকাশিত হয়৷ এই পত্রিকার ১৯২৬-এর ৭ জানুয়ারিতে বেরোয় নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘সব্যসাচী’৷ তাতে সরাসরি গান্ধীজির কংগ্রেসি আন্দোলনকে কটাক্ষ করেছেন কবি : ‘সুতা দিয়া মোরা স্বাধীনতা চাই,ব’সে ব’সে কাল গুণি !/জাগোরে জোয়ান ! বাত ধ’রে গেল মিথ্যার তাঁত বুনি’! ১৯২৬-এর ১৫ এপ্রিল ‘লাঙল’ বন্ধ হয়ে যায়, তার মাস চারেক পরে ১২ আগস্টে সংগঠনের মুখপত্র রূপে সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’ (সম্পাদক গঙ্গাধর বিশ্বাস) প্রকাশিত হয়৷ এই ‘গণবাণী’তেও নজরুলের আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের অনুবাদ থেকে ‘রক্ত-পতাকার গান’ প্রকাশিত হয়৷ সর্বত্র কবি শোষিত-শাসিত অসহায় মানুষের সংগ্রামে শরিক হয়েছেন৷ যেখানেই পরাধীনতার গ্লানি,দাসত্বের হীনমন্যতা, মানবতার সংকট অনুভব করেছেন,সেখানেই নজরুলের আত্মিক যোগ তাঁকে প্রতিবাদী করে তুলেছে, বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে তাঁর অন্তরাত্মা৷ সেখানে তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যেই শুধু নয়, ব্যক্তিজীবনেও তাঁকে সক্রিয় রাজনীতিতে সামিল হতে দেখা যায়৷ যখনই যেভাবে মনে হয়েছে, প্রতিবাদে বৈষম্যপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভোটেও দাঁড়িয়ে ছিলেন কবি৷ ১৯২৬-এ কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নজরুল পরাজিত হয়েছিলেন৷ নিজের কেরিয়ারের দিকে না তাকিয়ে জনপ্রিয় কবি হয়েও দেশের মানুষের স্বার্থে মানবতার পূজারি নজরুল ইসলাম যেভাবে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার নজির সৃষ্টি করেছেন,তা শুধু অনন্য দৃষ্টান্তই স্থাপন করেনি,অপূর্ব ইতিহাসও সৃষ্টি করেছে৷ সেই ইতিহাস তাঁর সৃষ্টিকর্মের সঙ্গেও একাত্ম হয়ে আছে, নীরবে নিভৃতে কথা বলে চলে, হাতছানি দেয় অবিরত৷ সেখানে নজরুলের সৃষ্টিকর্মের কথা যেভাবে আলোচিত হয়,সেভাবে তাঁর আত্মত্যাগের কথা আলো পায় না, ভাবা যায়!