প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম স্থান
আমিনুর রহমান , বর্ধমান, ৭ জুলাই: তিনি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শুধু নয়, প্রথম স্থান অর্জন করেছেন মাওবাদী নেতা অর্ণব দাম। হুগলি সংশোধনাগারে বসেই প্রাক্তন মাওবাদী শীর্ষ নেতা অর্ণব দাম ওরফে বিক্রম এবার ইতিহাসে পিএইচডি করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। আর তারপরেই হুগলি সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অর্ণব প্রবেশিকা দিয়ে যান। এবার ওই পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় নিয়ম মেনে আবেদন করার কাজ সম্পূর্ণ করেছিলেন সংশোধনাগারে থাকা ওই প্রাক্তন মাওবাদী নেতা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় ২২০ জন প্রার্থী ইতিহাস নিয়ে পিএইচডি করার আবেদন জানিয়েছেন। তার মধ্যে হুগলি সংশোধনাগারে বন্দী অর্ণব দাম-এর নাম প্রথমেই রয়েছে। সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষই বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দিয়ে এব্যাপারে জানিয়েছিল কয়েকমাস আগে। এদিন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানানো হয়, তিনি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। ফলে তাঁর আর পিএইচডি করার ক্ষেত্রে কোনও বাধা রইলো না।
এর আগে কোনও জেলবন্দী আসামি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করার আবেদন জানিয়েছেন কিনা সে ব্যাপারে কোনও তথ্য নেই বলেই বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানানো হয়। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা বলেই মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, মাওবাদী এই পিএইচডি প্রার্থী সফল হবার পর পরবর্তীতে আর পাঁচজনের মতোই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় নিয়ম মেনেই পড়াশোনার কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন। ন্যূনতম উপস্থিতিও নজরে রাখা হবে। সূত্রের খবর, জেল থেকে পরীক্ষা দিয়েই এর আগে স্টেট এলিজিবিলিটি টেস্ট(সেট)-এ সফলভাবে উত্তীর্ণ হন এক সময় রাজ্যের শীর্ষ এই মাওবাদী নেতা অর্ণব দাম।
রাজ্য কারা দপ্তর সূত্রে খবর, এর আগে কেউ জেলবন্দি অবস্থায় এধরনের কোনও পরীক্ষায় সফল হননি। ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শিলদা ক্যাম্পে মাওবাদী হামলায় ২৪ জন ইএফআর-কর্মী মারা যান। সেই মামলায় ২৩ জন অভিযুক্তের মধ্যে অর্ণব দাম ওরফে বিক্রম ছিলেন অন্যতম। কলকাতার গড়িয়ার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এসকে দামের ছেলে অর্ণব ছোট থেকেই মেধাবী বলেই পরিচিত। তিনি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে খড়গপুর আইআইটি-থেকে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু তিনটি সেমিস্টারের পরেই হঠাৎ-ই খড়গপুর আইআইটির ক্যাম্পাস ছেড়ে নিখোঁজ হয়ে যান অর্ণব। আইআইটি-র ক্যাম্পাস থেকে পুরুলিয়া-ঝাড়খণ্ডের পাহাড়-জঙ্গলে হাতে একে-৪৭ নিয়ে ডেরা বাঁধেন অর্ণব। পুলিশ সূত্রে খবর, নিহত মাওবাদী পলিটব্যুরো নেতা কিষেনজির অত্যন্ত স্নেহের পাত্র ছিলেন অর্ণব। লালগড় আন্দোলনের সময় অযোধ্যা-বাঘমুন্ডির পাহাড়-জঙ্গলে তাঁর গেরিলা বাহিনী নাজেহাল করে দিয়েছিল যৌথ বাহিনী থেকে শুরু করে গোয়েন্দাদের। শিলদা ইএফআর ক্যাম্পে হামলা থেকে শুরু করে একাধিক মাওবাদী হামলায় অভিযুক্ত অর্ণব ২০১২ সালে হঠাৎ-ই ধরা পড়েন আসানসোল থেকে।
জেলবন্দি হওয়ার পর থেকেই ওই গেরিলা নেতা অসম্পূর্ণ থাকা উচ্চশিক্ষায় মন দেন। জেল থেকেই পরীক্ষা দিয়ে স্নাতক হন। প্রায় ৭০ শতাংশ নম্বর নিয়ে সম্পূর্ণ করেন স্নাতকোত্তর পাঠ। তিনি জেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, অধ্যাপনা করতে চান। তাই ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট(নেট)-এ বসার আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতায় শেষ পর্যন্ত তিনি সেই পরীক্ষা দিতে পারেননি। সেই সময় প্রায় ৪০ বছর বয়সী প্রাক্তন ওই মাওবাদী নেতা এরপর সেট পরীক্ষা দেওয়ার আবেদন জানান। সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়ে অবশেষে সেই পরীক্ষা দেন অর্ণব। হুগলির জেলে বসেই অর্ণব তাঁর পাশ করার খবর পান। মার্কশিটও পেয়ে যান হাতে। সেই মার্কশিট তিনি বাড়িতে স্পিড পোস্টে পাঠিয়েও দেন। এরপর মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর সদস্য রঞ্জিৎ সুর সরকারের কাছে আবেদন জানান, “অর্ণব গবেষণা করতে চায়। ওর মতো রাজনৈতিক বন্দিদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হোক। আর ততদিন সরকার নিশ্চিত করুক, যাতে অর্ণব গবেষণা-সহ ভবিষ্যতের পড়াশোনোর সমস্ত সুযোগ পান।” সেই আবেদনের পর এবার অর্ণব গবেষণা করার ছাড়পত্র পেলেন।