নদীর বাঁধন থেকে খুলে যায় সভ্যতার পাতা

মুহাম্মদ শাহাবুদ্দিন: পৃথিবীর প্রায় সব নদীমাতৃক সভ্যতার ক্ষেত্রে এ কথা খাটে যে, নদী প্রবাহকে ঘিরে জীবন জনপদ সভ্যতার বিবর্তন হয়৷ একদিন তা হারিয়ে যায়৷ সব উত্থানের প্রায় একই ইতিহাস৷ রয়ে যায় সেই প্রবাহিনী, স্রোতস্বিনীর অস্তিত্ব যা একদিন তাকে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল৷ এমনিভাবে রয়ে গেছে সিন্ধু নদ৷ হাজার হাজার বছরের পথ চলায় সে এখন শীর্ণ৷ এই নদীর বাঁধনে বাঁধা সভ্যতা এখন আর নেই৷ তার উপত্যকা ঘিরে ছড়িয়ে আছে জনপদের চিহ্ন প্রাচীন সভ্যতার সাক্ষী হয়ে৷ সিন্ধুর এমন সুবিস্তৃত সভ্যতা হারিয়ে গেল, তা নিয়ে আজও চলেছে গভীর অনুসন্ধান৷ কৃষিকাজ নগরজীবন নিয়ে সিন্ধুর সমৃদ্ধ যুগের ধ্বংস ঐতিহাসিকদের সামনে এসেছে বহু প্রশ্ন৷ এ প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে গবেষকরা উপাদান হিসেবে পেয়েছেন নগরের ধ্বংসাবশেষ, নানান প্রত্নচিহ্ন আর সিন্ধুর গতিপ্রকৃতির রূপরেখা৷ হরপ্পা নগরীর চিহ্ন প্রথম চোখে পড়েছিল এক ইংরেজ সৈন্যের৷ লোথাল বন্দরও খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল আচমকা৷
তিন হাজার তিনশো খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে প্রায় দু’হাজার বছর বেঁচে থাকা সভ্যতা ছড়িয়ে ছিল আরও পশ্চিমে আফগান ইরান পর্যন্ত, এদেশের গুজরাত, মহারাষ্ট্র পর্যন্ত ছিল তার বিস্তৃতি৷ সিন্ধুতে সভ্যতা খুঁজে পাওয়ার আগে ক্যানিংহাম খুঁজে পেয়েছিলেন সিন্ধুর লিপি৷ যার পাঠোদ্ধার আজও সম্ভব হয়নি৷ সুদীর্ঘ কালের এই সভ্যতায় হারিয়ে গেছে ৭০টির মতো ছোটবড় শহর৷ গ্রাম থেকে ধীরে ধরে গড়ে উঠেছিল হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর জনবসতিপূর্ণ নগরী৷

হরপ্পার মতো বিস্ময়কর সভ্যতার অবলুপ্তির কারণ খুঁজতে গিয়ে পণ্ডিতেরা নানা অভিমত ব্যক্ত করেছেন৷ অনেকে মনে করেন ক্রমান্বয়ে সাতবার মহেঞ্জোদারো নগর ধ্বংস হয়েছিল৷ অস্তাচলে গড়িয়ে আসা হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো ছিল শুধুমাত্র সভ্যতার ছায়া৷ অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, সিন্ধু উপত্যাকার সমাজব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে পতনের বীজ বুনে চলেছিল৷ সভ্যতার স্বর্ণযুগের নাগরিক জীবন ক্রমশ ভেড়ে পড়ছিল৷ ভাটা পড়েছিল ব্যবসা বাণিজ্যে৷ মৃৎশিল্পের পূর্ব গৌরব ম্লান হতে শুরু করে৷ হরপ্পার অবক্ষয় নিয়ে ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে৷ একটা সভ্যতার অবক্ষয়ের কোনও নির্দিষ্ট কারণ থাকে না৷ মার্টিমার হুইলারের মতে, সিন্ধু সভ্যতা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় একই সময়ে একই কারণে এই অবক্ষয় শুরু হয়নি৷ অনেকের মতে, কয়েকশো বছর উপত্যকার আবহাওয়ায় পরিবর্তন ঘটে৷ এতে পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হতে শুরু করে৷ গাছপালার মৃতু্য হতে হতে অত্যধিক রুক্ষ হয়ে পড়ে উপত্যকার সবুজ ভূমি৷ স্থাপত্যের কাজে ব্যবহত হয়েছিল পাকা ইট৷ আর ইটের জ্বালানির রসদ জুগিয়েছিল বনভূমি৷ অরণ্য ধ্বংস সিন্ধুর পরিবেশকে আঘাত করেছিল৷ ধ্বংসের পিছনে এই কারণকে অনেকেই মেনে নিতে পারেননি৷ কিছু বিশেষজ্ঞ ভূমিকম্পকে দায়ী করেছেন৷ কিন্ত্ত শুধু ভূমিকম্প একটা সভ্যতাকে নিঃশেষ করতে পারে না৷

ঐতিহাসিকদের ধারণা, ২৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের পরে সিন্ধু সভ্যতায় এক যুগান্তর এসেছিল৷ সমুদ্রপথ ঠিকানা দেখিয়েছিল বহু বন্দর উপযোগী তটভূমির৷ বৃদ্ধি পেয়েছিল গুজরাত উপকূলের বন্দরের সংখ্যা৷ পরপর গড়ে উঠেছিল লোথাল, ধোলাভিরা, সুতকাজেনদোরের মতো বন্দর শহর৷ এই সময় থেকেই জনবসতির ঢেউ এসে লেগেছিল নিম্ন সিন্ধুর অববাহিকায়৷ পুরনো ছোট শহরগুলি নতুন করে নির্মাণে আরও উন্নত চেহারা নিয়েছিল৷ বসতিগুলিকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল সুনির্দিষ্ট নগর পরিকল্পনা৷ অববাহিকার বন্ধনে গড়া শহরগুলি তখন এক একটি বন্দর নগরী৷ শিল্পের উন্নতিতে বাণিজ্যের প্রসারণ ঘটে৷ কাশ্মীর, উত্তর পশ্চিম আফগানিস্তান, ইরানের মালভূমির দিকে প্রসারিত হয়েছিল বাণিজ্যের স্থলপথ৷ সভ্যতার পতনের রেখা ফুটে উঠেছে এই বাণিজ্যপথের দু’পাশে৷


সিন্ধুর প্রত্নচিহ্নের পথ ধরে আবিষ্কৃত হয়েছে পুড়ে যাওয়া শহরের চেহারা৷ বিশেষ করে ইরানের দিকে গড়ে ওঠা জনপদগুলির ঝলসানো চেহারা বেশি চোখে পড়ে৷ শোকতা এমনিই এক শহর, যার মাটি খুঁড়ে দেখা গেছে দগ্ধ শহরের কঙ্কাল৷ অগ্নিকাণ্ডের কারণ খুঁজতে গিয়ে ভূতাত্ত্বিক ঐতিহাসিকরা নানান মত দিয়েছেন৷ ব্রোঞ্জ যুগের শেষে পৃথিবী জুড়েই পরিবর্তন শুরু হয়েছিল৷ তার প্রভাব বেশিরভাগ এসে পড়েছিল নদীমাতৃক সভ্যতার ওপর৷ শুকিয়ে এসেছিল শহরগুলির জলের উৎস৷ ধাতু আর ইটের চুল্লিতে কাঠের জোগান দিতে মানুষ ধ্বংস করেছিল সবুজ অরণ্য৷ অরণ্যহারা প্রকৃতি আরও রুক্ষ হয়ে যায়৷ মনে করা হয় দাবানল, ভূমিকম্প বার বার আঘাত করেছে এখানকার জলবায়ুকে৷ ভূতাত্ত্বিকরা মনে করেন, মরু মাটির রুক্ষ বাতাস আগুনের শিখাকে প্রসারিত করে নিয়ে গিয়েছিল অন্য শহরে৷ দ্বগ্ধ নগরীর এই তথ্যের সমর্থন মেলে জিও-ফিজিক্সের বিজ্ঞানীদের কথায়৷ দাবারকোট, রানাঘুন্ডাইয়ে সবচেয়ে বেশি দগ্ধ শহরের সন্ধান মিলেছে৷ সোয়ান উপত্যকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চোখে পড়ে কবরভূমি৷

সিন্ধু উপত্যকার পতনের চিহ্ন ধারাবাহিকভাবে দেখা যায়নি৷ এক এক জায়গায় ধ্বংসের কারণ আলাদা রকমভাবে দেখা গেছে৷ একই সময়কালে উন্নত সভ্যতাগুলি আরেক সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করে৷ ২০০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের পর টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস নদীর জল লবণাক্ত হতে শুরু করে৷ স্থলভূমিতেও এসে পড়ে নোনাজলের প্রলেপ৷ মেসোপটেমিয়ার জনজীবনে এর প্রভাব পড়ে তীব্রভাবে৷ বাণিজ্য, বসতও উঠে আসতে শুরু করে ভূমধ্যসাগরের তীরে আর আনাতোলিয়ায়৷ ভূমধ্যসাগর চিরদিনই ছিল তার চারিদিকের সভ্যতাগুলির ব্যবহার-উপযোগী জলাধার৷ মধ্যপ্রাচ্যের বাণিজ্যের গতিমুখও ছিল এই শান্ত সাগরের দিকে৷ সুমেরীয় বাণিজ্য পশ্চিম এশিয়ায় সরে আসাতে সিন্ধুর বাণিজ্যেও ভাটার টান পড়তে শুরু করে৷ বাণিজ্যের সংকট সিন্ধুর স্বচ্ছল জনজীবনের ভিতকেও টলাতে থাকে৷ ড. শিরীন রত্নাগরের গবেষণায় এই মতের সমর্থন মেলে৷ তাঁর কথায়, ‘যে সমাজের অর্থনীতি বাণিজ্যকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে, বহির্বাণিজ্যের অবসান ঘটলে, সেই অর্থনীতিতেও ধস নামে৷’ মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধুর ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটেছে৷ সরস্বতী নদীর জলস্রোত শুকিয়ে যেতে শুরু করলে বন্দরগুলির নদী নির্ভরতাও কমে যেতে থাকে৷ ভূতাত্ত্বিকদের ধারণা এই সময় মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া জুড়ে চলেছিল অভূতপূর্ব খরা৷ অনাবৃষ্টি ক্রমশ রুক্ষ করে দিচ্ছিল কৃষিজমি৷ সিন্ধুর নগর জীবনের প্রকৃত অবক্ষয় এই সময় থেকে৷ নাগরিক অবক্ষয় থেকে বাঁচতে মানুষ গড়ে তুলেছিল ছোট ছোট গ্রামজীবন৷ নদীর বাঁধন থেকে সভ্যতার পাতা এইভাবে আলগা হতে শুরু করে৷ পৃথিবীর কোনও সভ্যতাই সহসা একইরকম কারণে পতনের দিকে নেমে আসে না৷ সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রেও তাই৷ সভ্যতার অবলুপ্তির কারণ অনুসন্ধানে গবেষকরা নানান ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক কারণকে খুঁজেছেন৷ অনেকে বহিরাগত আক্রমণ, নানা গোষ্ঠী সংঘর্ষকে এ ব্যাপারে দায়ী করেছেন৷ অনেকেরই ধারণা, হরপ্পার অবসান স্বাভাবিকভাবে হয়নি৷ সভ্যতার ওপর যবনিকা পড়েছিল রক্তপাতের মধ্য দিয়ে৷ বলা হয় বৈদেশিক আক্রমণকারীরা সভ্যতার ওপর হেনেছিল বিধ্বংসী আঘাত৷ ব্রিটিশ প্রত্নবিদ মার্টিমার হুইলার বহিরাগত আর্যদের সিন্ধু উপত্যকার ধ্বংসকারী বলে চিহ্নিত করেছেন৷ ১৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের আগে এশিয়া মাইনরের ‘বোঘজকই’ মৃৎফলকে উৎকীর্ণ হয়েছিল হিটাইট ও মিতান্নী শাসকদের চুক্তিপত্র৷ এই খোদিত চুক্তিপত্র দীর্ঘদিনের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের প্রমাণ৷ সেখানে নাম খোদিত আছে ইন্দ্র, মিত্র, বরুণের৷ মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহাসিকদের দাবি, এরা ছিলেন স্থানীয় গোষ্ঠী নেতা৷ আবার এই নামগুলির উল্লেখ পাওয়া যায় ঋক্বেদে৷ হুইলারের মতে, আর্যগোষ্ঠীর যে শাখা হিন্দুকুশ কারাকোরাম হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিল, তাদেরই হয়ত একজন ছিলেন ‘ইন্দ্র’৷ ঋক্বেদে ইন্দ্রকে ‘পুরন্দর’ নামে অভিহিত করা হয়েছে৷ পুরন্দর অর্থাৎ যিনি পুরবাসীকে জয় করেছেন৷ তাহলে কি সিন্ধুর নগরবাসীদের পরাজিত করে আর্যগোষ্ঠী ইন্দ্রের নেতৃত্বে ভারতে প্রবেশ করে? এই প্রশ্ন বার বার উত্থাপিত হয়েছে ভারতবর্ষের প্রাক্ ইতিহাস চর্চায়৷

এরপর পেরিয়ে গেছে অনেকটা সময়৷ হুইলারের সিদ্ধান্ত নিয়েও নানা বিতর্ক উঠেছে৷ এ এল ব্যাশমের মতে, সভ্যতার ধ্বংসকারী সবাই যে আর্য ছিল, এ বিষয়ে নিশ্চিত করে বলা যায় না৷ তাঁর ধারণা, আক্রমণকারীদের অনেকে বালুচিস্তান থেকে সিন্ধু উপত্যকায় এসেছিল৷ উপত্যকার একই জাতির মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিনের গোষ্ঠী সংঘর্ষের কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন৷ অনেকের মতে সিন্ধুর মানুষের দীর্ঘদিন ধরে চলা আন্দোলন সভ্যতার চেহারা ধীরে ধীরে পাল্টে দিয়েছিল৷ নদী গতিপথ পরিবর্তন হওয়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপার৷ মার্ক অরেলস্টাইন মনে করেন, উপত্যকার নগর জনপদের বাঁধন তৈরি করেছিল যে নদীসমূহ, তাদের গতিপথ পরিবর্তনে দেখা দিয়েছিল বিধ্বংসী প্লাবন৷ ফলে জলপ্লাবনের আঘাত টলিয়ে দিয়েছিল সভ্যতার ভিতকে৷

হরপ্পা-মহেঞ্জোদারো তার পরবর্তী যুগকে স্পষ্টভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি৷ পারলে সিন্ধুর সমাজ সভ্যতাকে আরও পরিপূর্ণভাবে জানা যেত৷ সিন্ধুর বহু তথ্য অজানা৷ তথ্য ও বিশ্লেষণের আলোকে ইতিহাস একটা যুগের পরিচয়কে পরের প্রজন্মের কাছে পেঁৗছে দেয়৷ সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রে তা সবটা হয়ে ওঠেনি৷ ইতিহাসের পাতা ওল্টালে পরবর্তী সময়পর্বে দেখা যায় আর্য যুগের কৃষিসমাজ৷ নাগরিক সভ্যতার অনুসরণ অনুকরণ কোনওটাই আর্যরা করতে পারেনি৷ দুটি সভ্যতার বিবর্তনের মুহূর্তগুলি কেমন ছিল, তার অনেকটাই আমরা জানি না৷ আরও কোনও প্রত্ন আবিষ্কারে আরও অনুসন্ধানে বিবর্তনের দিক হয়ত বেরিয়ে আসবে৷ হাজার হাজার বছরের স্রোতচিহ্ন বুকে নিয়ে সিন্ধু আজও প্রবাহিত৷ শুধু হারিয়ে গেছে সিন্ধু নামাঙ্কিত সভ্যতা৷