ইরানের নেতৃত্বে প্রতিরোধ অক্ষের তিন ‘হ’-এর এক অংশীদার ‘হুথি’

পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়

ইয়েমেনের হুথি সম্প্রদায়ের সম্বন্ধে একটু বিশদে জানা দরকার৷ ইসলামের নবী মুহম্মদের মৃতু্যর পর কে খলিফা হবেন এই নিয়ে বিরোধ বাঁধে৷ প্রাথমিক তালিকায় উঠে আসেন আবু বকর আল সিদ্দিক, উমর ইবন আল-খাত্তাব, উথমান ইবন আফফান এবং আলি ইবন আবি তালেব (ইমাম আলি)৷ মুহম্মদের উত্তরাধিকার বিরোধ চলাকালীন নবীর সম্পর্কিত ভাই এবং জামাতা ইমাম আলিকে হত্যা করা হয়৷ ইমাম আলির পুত্র আল-হাসানকে বাধ্য করা হয় মু’আউইয়া ইবন আবি সুফিয়ানের কাছে ক্ষমতা অর্পণ করতে৷ মু’আউইয়া ছিলেন এক হামেশীয় যিনি মুহম্মদের বংশীয় না হলেও উমাইয়াদ বংশ প্রতিষ্ঠা করেন৷ কিন্ত্ত আল-হাসানের ভাই আল-হুসেন এই ব্যবস্থা মেনে নিতে অস্বীকার করে দ্বিতীয় উমাইয়াদ খলিফা ইয়াজিদ ইবন মু’আউইয়া’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ইরাকের পথে যাত্রা করেন৷ যাত্রাপথে তাঁকে হত্যা করা হয়৷ এই ঘটনার ফলস্বরূপ শিয়া ইসলাম ধর্মের সৃষ্টি হয়৷ সুন্নি আর শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে এক প্রধান পার্থক্য হল, সুন্নি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস হল যে খলিফার শাসন প্রথম চার খলিফার পথ অবলম্বন করে এক উমাইয়াদকে দেওয়া সঠিক৷ আর শিয়া সম্প্রদায়ের মতে, আল হুসেন হলেন সম্প্রদায়ের ন্যায়নিষ্ঠ নেতা৷ অন্য শিয়া সম্প্রদায়ের মতে ইমাম আলি হলেন মুহম্মদের প্রথম উত্তরাধিকারী৷ সুন্নি সম্প্রদায়ের মতে, ইসলামের নেতা ‘সুরা’ (গণ-আলোচনা) দ্বারা নির্বাচিত হবেন৷ শিয়া সম্প্রদায়ের মতে, আল-হাসান এবং আল-হুসেনের বংশপরম্পরা অনুযায়ীই নেতা নির্বাচিত হবেন৷

শিয়াপন্থীরা পরবর্তীকালে অনেক ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়৷ মুখ্য দুই গোষ্ঠীর প্রধানদের নাম হয় বারো’পন্থী৷ এরা দাবি করেন যে, বংশপরম্পরায় বারো জন ইমাম হলেন আল-হুসেন থেকে তাঁর পুত্র মুহম্মদ ইবন আল-বাকির এবং অবশেষ দ্বাদশতম ইমাম হুজ্জত আল্লা ইবন আল-হাসান৷ দ্বিতীয় প্রধান গোষ্ঠী বিশ্বাস করেন যে নেতৃত্ব ন্যায়ের পথে নির্বাচিত হবেন, যদিও তাঁরা মনে করেন যে এক নেতার উত্তরাধিকারী সাধারণভাবে হবেন আল-হাসান বা আল-হুসেনের বংশ থেকেই৷ এই দ্বিতীয় গোষ্ঠীর নাম হল জায়দি, যারা ইমাম আলির প্রপৌত্র ইমাম জাইদের থেকে উদ্ভূত৷ ইমাম জাইদ মুহম্মদ ইবন আলি আল-বাকির (পঞ্চম ইমাম)-এর ভাই৷ আমাদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এই জায়দি গোষ্ঠী যাঁরা ইয়েমেনে এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কামনা করেন৷ অনেকবারই তাঁরা ইয়েমেনে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ ইয়েমেনকে পছন্দ করার কারণ এই দেশ ইসলামকে সমর্থন করেছিল এবং নির্যাতিতদের রক্ষা করেছিল৷


প্রথম দিককার জায়দিরা উমাইয়াদদের হাত থেকে সুরক্ষা পাওয়ার জন্য ইয়েমেনে পালিয়ে গিয়েছিলেন৷ এর পর ইব্রাহিম আল-রাসি তাঁর ভাই আল-কাসেম ইবন ইব্রাহিম আল-রাসিকে ইজিপ্টে পাঠিয়ে সেখানে প্রথম জায়দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন৷ তাঁরা দুজনেই ব্যর্থ হন কারণ সেখানে জায়দিদের বিদ্রোহী হিসেবে ভাবা হয়৷ তখন আল-কাসেন ইবন আল-রাসি ইয়েমেন থেকে মক্কায় তীর্থ করতে আসা কয়েকজন উপজাতি নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে শুরু করেন৷ সেই ইয়েমেনি উপজাতিরা আল-রাসির পৌত্র ইয়াহিয়া আল-রাসিকে প্রথম জায়দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেন৷ বহুল প্রচলিত কাহিনি থেকে জানা যায় যে, একবার আল-রাসিকে উপজাতি বিরোধের মীমাংসা করতে ইয়েমেনে আমন্ত্রণ জানানো হয়৷ নিজের প্রজ্ঞার সাহায্যে তিনি উপজাতি সদস্যদের হূদয় এবং মন জয় করেন৷ এই ঘটনাই আল-রাসিকে ইয়েমেনে রাজনৈতিক প্রভাব স্থাপন করতে সাহায্য করে৷ প্রথম জায়দিরা জানতেন যে উপজাতি সর্দারদের সাহায্যেই সেই দেশের আপার জনগণের সমর্থন অর্জন করে রাজনৈতিক প্রভাব পাকাপাকিভাবে কায়েম করতে পারবেন৷ উল্লেখযোগ্য দেশের উদীয়মান সুন্নিপন্থার বিষয়ে জনগণের মধ্যে বিরূপ মনোভাব ছিল৷ এইভাবে নবম শতাব্দীর শেষদিকে ইয়াহিয়া আল-রাসি প্রথম জায়দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন৷ বিভিন্ন জায়দি রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রকার উগ্রপন্থার সাহায্যে উপর্যুপরি ইয়েমেনে উত্থান এবং পতন ঘটে৷ শেষ মুতাওয়াক্কিলিয় রাজ্য ছিল ১৯১৮ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত৷ নবম শতাব্দী থেকে ইয়েমেনের মানুষ সুন্নিপন্থা (শাফি শাখা) এবং জায়দিপন্থার মধ্যে বিভক্ত ছিলেন৷

জায়দিদের মধ্যে বিংশ শতাব্দীতে শেষতম রাজনীতিকরণ আসেন যখন তদানীন্তন জায়দিদের বিলুপ্ত জারুদি শাখা থেকে হুথিদের উত্থান ঘটে৷ প্রভাবশালী নেতা হুসেন আল হুথি জারুদি জায়দিপন্থাকে বেছে নেন কারণ তিনি জায়দিপন্থার মূল ধারা হাদুউই’দের থেকে ভিন্নমত পোষণ করতেন৷ অনেকবার ইরান সফর করে তিনি জারুদি মতকে জঙ্গিবাদী আন্দোলনে পরিবর্তন করতে চান৷ এই আন্দোলনের বিশ্বাস ছিল যে আল-হুসেনের উত্তরপুরুষেরা ঐশ্বরিক নির্দেশে শাসন করার অধিকারী এবং তাই এই জঙ্গিরা অন্য সকল সম্প্রদায় থেকে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে৷ এর ফলে এই সম্প্রদায়ের মানুষের ধারণা হয় যে হিংসাসহ যে কোনও কাজ করতে পারেন সমাজে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে৷

একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে হুথিদের ক্ষমতা সংহত করার প্রয়াস নিতে হয়৷ এই প্রয়াসে তাঁরা প্রথমেই সতর্ক হন যে শেষ জায়দি রাজবংশ মুতাওয়াক্কিলিয় রাজ্যের মতো এরা নিজেদের উত্তম ভেবে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করবেন না৷ ইয়েমেনিদের মন জয় করতে তাঁরা ইমামবাদের পরিবর্তে অন্য নাম আল-উইলাইয়া ব্যবহার করেন৷ ‘হুথি আন্দোলন’ একংবিশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ইয়েমেনিদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে৷ হুথিদের বর্তমান নেতা আবদুল মালিক আল-হুথি হলেন আন্দোলনের প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতা হুসেন আল-হুথির ভাই, যার নাম থেকেই আন্দোলনের নামকরণ হয়েছে৷

একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় হুথিরা ইয়েমেনের দীর্ঘকালীন একনায়ক রাষ্ট্রপতি আলি আবদুল্লা সালের বিরুদ্ধে উপর্যুপরি বিদ্রোহ সংঘটিত করেন৷ উদ্দেশ্য উত্তর ইয়েমেনে অবস্থিত তাদের রাজ্যের অধিক স্বায়ত্তশাসন অর্জন করা৷ ২০১১ সালের জনপ্রিয় ‘আরব বসন্তে’ আলি আবদুল্লা সালে তার উপরাষ্ট্রপতি আবরাব্বু মনসু হাদি-এর হাতে ক্ষমতা অর্পণ করেন৷ হাদি সরকারের বিবিধ সমস্যার সুযোগ নিয়ে হুথিরা (যাদের আনসার আল্লা বা ঈশ্বরের সমর্থক নামেও ডাকা হত) ২০১৪ সালে ইয়েমেনে রাজধানী সানা দখল করে৷ ইয়েমেনের সব পদবির উৎস যেমন কোনও স্থানের নাম, তেমনি হুথি নামের উৎস ‘হুথ’৷ হুথ হল আমরান প্রদেশের সাদা এবং সানা মধ্যবর্তী একটি গ্রাম৷ হুথি আন্দোলনের সাংগঠনিক উৎস জানতে ১৯৯২ সালে পিছিয়ে যেতে হবে৷ তখন এক ইসলামিয় জায়দি গবেষক মোহাম্মদ আজ্জান ‘দি বিলিভিং ইয়থ’ (বিওয়াই) আন্দোলনের সহ-প্রতিষ্ঠা করেন৷ এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য জায়দি বিশ্বাসকে উজ্জীবিত করা, যেখানে উপজাতিগত বা বংশগত উৎস নিয়ামক মত হবে না৷ কিন্ত্ত অচিরে অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে আল-হক দল প্রতিষ্ঠা করেন৷ এর ফলে বিওয়াই দলের মধ্যে এক বিভাজন দেখা দেয়৷ এখান থেকে যে গোষ্ঠীর জন্ম হয় তারা বিওয়াই এবং আল-হক উভয় দলের থেকে পৃথক৷ এদের দখল চলে যায় হুথি পরিবারের হাতে এবং প্রথম নেতা হন হুসেন আল হুথি৷ এই নেতা অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন এবং আমেরিকার প্রভাবে হতাশা অনুভব করেন৷ আজ্জান এবং তাঁর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়৷
২০১৪ সালে ইয়েমেনে স্বীকৃত সরকারকে উৎখাত করার পরে এক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়৷ ২০১৫ সালে তা এক বৃহত্তর যুদ্ধে পরিণত হয়, যখন সৌদি আরবের নেতৃত্বে এক জোট হুথিদের পরাজিত করতে অগ্রসর হয়৷ আট বছর পরে এই জোট হুথিদের ক্ষমতাচু্যত করতে অসমর্থ হয়৷ কিন্ত্ত ছয় মাস পরেই বিরতির অবসান ঘটে৷ যদিও পূর্ণমানের যুদ্ধ এর পরে আর হয়নি৷

গৃহযুদ্ধে ৩,৭৭,০০০ মানুষ মারা যায়৷ এর অর্ধেকের বেশি মানুষ মারা গিয়েছে খাদ্য, জল এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার অভাবে৷ অর্থাৎ, যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণে নয়৷ বর্তমানে ইয়েমেনি জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষের মানবিক সাহায্য এবং সুরক্ষার প্রয়োজন৷ এই অবস্থাতেও জঙ্গিবাদ দমেনি৷ ২০১৪ সাল থেকেই ইরান তার অস্ত্র এবং রণকৌশল সরবরাহ করে আসছে৷ আমেরিকা, ইজরায়েল এবং সৌদি আরবের জোটের বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছে ইরানের নেতৃত্বে ‘প্রতিরোধ অক্ষ’৷ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামাস হামলার পরে হামাসের পক্ষ সমর্থন করে সক্রিয়ভাবে হুথিরা হেজবোল্লার সঙ্গে ইজরায়েল এবং লোহিত সাগরে অবস্থিত আমেরিকার নৌবহরকে আক্রমণ করে চলেছে৷ হামাস, হেজবোল্লা এবং হুথি— এই তিন ‘হ’কে ইজরায়েল এবং আমেরিকার জোট কি শায়েস্তা করতে পারবে? সাম্প্রতিক ইতিহাসই বলে যে একমাত্র তালিবানকে দীর্ঘ বিশ বছরেও পরাস্ত করতে পারেনি আমেরিকা৷ প্রতিরোধের অক্ষ কি ইজরায়েলকে পরাস্ত করে প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করতে পারবে?
তিন ‘হ’কে যদি লাল সন্ত্রাসবাদ বলি, তবে আমেরিকা, ইজরায়েল, রাশিয়ার যুদ্ধপ্রিয়তাকে কেন শ্বেত সন্ত্রাসবাদ বলব না?