কৌশিক রায়
দুটো শব্দ এখন চারদিকে বেশ আলোড়ন তুলেছে— আটিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (AI) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা৷ অর্থাৎ মানুষের মতোই উদ্ভাবনী ধীশক্তির অধিকারী রোবটরা বা যন্ত্রমানব এবং কম্পিউটাররা আমাদের সব মুশকিল আসান করে দেবে৷ বিভিন্ন কল্পবিজ্ঞানে, যেমন সত্যজিৎ রায়ের কলমে সৃজিত কম্পু, অনুকূল, বিধুশেখর, ডন ব্যারি আর অ্যালেক্স রেমন্ড-এর ফ্ল্যাশ গর্ডন কমিকসে নোয়া এবং আইজ্যাক আসিমভের লেখাতে রোবি, জিসকার্ড আর দানিয়েল অলিভো নামক রোবো-চরিত্রগুলির মধ্যে চলচ্চিত্রে আর্নল্ড শোয়াৎর্জেনেগার অভিনীত ‘টারমিনেটর’ চরিত্রটির মধ্যে আমরা এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ধারণা পেয়েছি৷ তবে, সভ্যতার পিলসুজকে তিলে তিলে গে.ড় তোলা মানবজাতির বুদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া এই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স আমাদেরকে আরও বেশি হারে যন্ত্রনির্ভর করে তুলে আমাদের জীবনে অভিশাপও হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকেই৷ নানাভাবেই আমাদের জন ও ব্যক্তিজীবনচর্চা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ফলে৷ যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁদের পেশা ও নেশাকে বড় ধাক্কা দিতে পারে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স৷ চেক-ব্রাজিলিয় দার্শনিক ভিলেম ক্লুসের তো রীতিমতো ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছেন, ইতিহাসবিদ আর প্রাবন্ধিক ছাড়া ভবিষ্যতে আর কোনও লেখক-লেখিকা তৈরি হবে না৷ সব লেখা ও বই-ই আসবে এআই-এর মাধ্যমে৷ এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই নির্বাচন করবে রচনার ব্যাকরণ ও বিষয়বস্ত্ত৷ জিপিটি-৩ নামক একটি বিশেষ কম্পিউটার প্রোগ্রামের সাহায্যে নিত্যনতুন বিষয় নিয়ে লিখবে এআই৷ শিখণ্ডী হিসেবেই শুধু থাকবেন লেখক-লেখিকারা৷ তবে নতুন করে কোনও হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, প্রথম প্রতিশ্রুতি, অলিভার টুইস্ট বা ল্যে মিজেরেবল-এর মতো অমর সাহিত্যকীর্তি তৈরি হবে না এই এআইয়ের কৃত্রিম বাতাবরণে৷ এছাড়াও রেডিমেড লেখালেখির জন্য তৈরি হয়েছে এআই-এর সিউডোরাইট, মিডিয়াম, গানরোড, রটেন টোমাটোজ, ওয়ার্ল্ড প্রেস-এর মতো বেশ কিছু প্রোগ্রাম৷ এআই-এর মাধ্যমেই লেখার আলোচ্য বিষয় খুঁজে নিতে পারবেন লেখকরা৷ এর ফলে আশঙ্কা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে রবীন্দ্রনাথ, আশাপূর্ণা দেবী, চার্লস ডিকেন্স, জুলে ভের্ন, আর্নেস্ট হেমিংওয়েদের নকল তৈরি হবে না তো?
আমাদের নিত্যদিনের এবং বিশেষ অনুষ্ঠানে পরিধেয় বস্ত্রের নকশার মধ্যেও হস্তক্ষেপ করতে চলেছে এআই৷ নিউইয়র্কে এআই ফ্যাশন উইক পালিত হয়েছে৷ দমিতির রিউকু্যনোভ নামক এক রুশ ফ্যাশন ডিজাইনার, এআই-এর কারিগরিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের জামাকাপড, বিশেষ করে ইউনিসেক্স কালেকশন বানিয়েছেন৷ ‘সফট অ্যাপোক্যালিপস’ নামক এক ধরনের এআই ফ্যাশন ঘরানার প্রবর্তন করেছেন র্যাচেল কোউবাল নামক এক ফ্যাশন ডিজাইনার৷ গৌরব গুপ্তার মতো অনেক ভারতীয় ফ্যাশন ডিজাইনারও এআই নিয়ে কাজ করছেন৷ এআই-এর মাধ্যমে চ্যাট জিপিটি, গুগল বার্ড, মিডিজার্নি, ড্যাল-ই, অটার পাইলট, অ্যাডোবে ফায়ারফ্লাই-এর মতো প্রোগ্রাম ল্যাঙ্গুয়েজগুলিকে নিয়ে কাজ করছেন অনেকেই৷ এআই-এর দ্বারা তৈরি হওয়া যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর, আজ পপ, রক এবং ইলেকট্রনিক মিউজিকে শুনতে পাওয়া যাচ্ছে৷ এই কাজটা সর্বপ্রথম শুরু করেছিলেন জার্মানির ‘ক্রাফটওয়র্ক’ নামক একটি বাদ্যযন্ত্রী ও গায়কদল— তাঁদের ‘রোবট’, ‘ম্যান মেশিন’, ‘ওটোবান’, ‘মডেল’, ‘কম্পিউটার ওয়ার্ল্ড’ নামক গানগুলির মাধ্যমে৷ এআই-এর মাধ্যমে তাহলে কি ভবিষ্যতে আবারও ফিরে আসবে ম্যাডোনা, মাইকেল জ্যাকসন, টিনা টার্নার, এলা ফিটজেরাল্ড, সাগর সেন, সুচিত্রা মিত্র, বব মারলিদের কণ্ঠ? তাহলে কি সেটা এই কিংবদন্তীদের সুকণ্ঠের প্রতি অবিচার করা হবে না? ইতিমধ্যেই এআই-এর মাধ্যমে তৈরি হওয়া ‘হার্ট অন মাই স্লিভ’ গানটি নিয়ে যুবমানন উদ্বেলিত৷ বর্তমানের চার নামকরা রক ও পপ গায়িকা আরিয়ানা গ্রান্দে, রিহানা, দুয়া লিপা এবং শাকিরা মাবারেক রিপোলে তাঁদের গানে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার করে চলেছেন৷ তবে আধুনিক প্রজন্ম এই এআই প্রযুক্তির উদ্দাম মাদকে আসক্ত হয়ে দ্রুত হুলিও ইগলেসিয়াস, হ্যারি বেলাফন্টে, টিনা চার্লস, নাজিয়া হাসান, ব্রুস স্প্রিংস্টিন, জন ডেনভারদের মতো সোনালি অতীতের গায়কদের স্মৃতিটুকু পর্যন্ত বিসর্জন দিতে চলেছে৷ এআই প্রযুক্তির উদ্যোগে তৈরি হওয়া যান্ত্রিক সুরঝংকার ব্রাত্য হতে বসেছে জোডিয়াক সুরগোষ্ঠী, আনন্দশংকরের টেম্পটেশনস, রবিশংকরের সেতার, লিও রোহাস আর হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি, ইয়েহুদি মেনুহিনের বেহালা আর রন গুডউইনের ‘ডেজার্ট অব অ্যারাবিয়া’ অর্কেস্ট্রা, লুডভিগ ভ্যান বেঠোফেন-এর ‘মুনলাইট সোনাটা’ আর ভ্লাদিমির চাইককস্কির ‘সোয়ান লেক’ কম্পোজিশনগুলি৷
এআই-এর উদ্যোগে এখন চলচ্চিত্রেও রক্তমাংসের চরিত্রের প্রয়োজন আস্তে আস্তে কমে আসছে৷ ব্ল্যাক মিরর চলচ্চিত্রে প্রখ্যাত নায়িকা সালমা হায়েক-এর বদলে কিছু দৃশ্যে অভিনয় করেছে এআই দিয়ে তৈরি একটি যান্ত্রিক বা অ্যানিমেটেড চরিত্র৷ বিপজ্জনক অ্যাকশনপূর্ণ ছবিতে অক্ষয়কুমার, সলমন খান, জঁ ক্লদ ভান ডাম, জন আব্রাহামদের বদলে এআই-সৃজিত অ্যানিমেটেড চরিত্ররা অভিনয় করবে৷ তবুও, এআই দিয়ে কি ম্লান করা যাবে ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’ চলচ্চিত্রে ক্লিন্ট ইস্টউড, শোলে ছবিতে অমিতাভ-ধর্মেন্দ্র-আমজাদ, ‘খণ্ডহর’ ছবিতে শাবানা আজমি, সপ্তপদী ছবিতে উত্তমকুমার-সুচিত্রা, আর ‘দ্য টেন কম্যান্ডমেন্টস’ ছবিতে চার্লটন হেস্টন-এর প্রবাদপ্রতিম অভিনয়কে?