• facebook
  • twitter
Sunday, 8 September, 2024

যে কারণে বিজেপির এই ভরাডুবি

শোভনলাল চক্রবর্তী মাস কয়েক আগে নির্বাচন নির্ঘণ্ট ঘোষণার সময়ও যে নির্বাচনকে ‘ডান ডিল’ বা ‘ফলাফল তো জানাই’ বলে ভাবা হচ্ছিল – হঠাৎ করেই ভারতের সেই নির্বাচনটা কি করে একেবারে ‘ওপেন’ হয়ে গেল এবং অবাক করার মতো ফল হল – এই কথাটা রাজনৈতিক পন্ডিত থেকে সাধারণ ভোটারদের অনেককেই এখন প্রবলভাবে ভাবাচ্ছে। কীভাবে এমনটা ঘটল, তারই কয়েকটি

শোভনলাল চক্রবর্তী

মাস কয়েক আগে নির্বাচন নির্ঘণ্ট ঘোষণার সময়ও যে নির্বাচনকে ‘ডান ডিল’ বা ‘ফলাফল তো জানাই’ বলে ভাবা হচ্ছিল – হঠাৎ করেই ভারতের সেই নির্বাচনটা কি করে একেবারে ‘ওপেন’ হয়ে গেল এবং অবাক করার মতো ফল হল – এই কথাটা রাজনৈতিক পন্ডিত থেকে সাধারণ ভোটারদের অনেককেই এখন প্রবলভাবে ভাবাচ্ছে। কীভাবে এমনটা ঘটল, তারই কয়েকটি কারণ বিশ্লেষণ করার উদ্দেশ্যেই এই প্রবন্ধ। গত ২২ জানুয়ারি অযোধ্যাতে ভেঙে ফেলা বাবরি মসজিদের জায়গায় নির্মিত নতুন রামমন্দিরে প্রধানমন্ত্রী মোদী যখন বিগ্রহের ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ করেন, সেরকম জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে খুব কমই হয়েছে। দেশের শাসক দল বিজেপি তখন খুব গর্বের সঙ্গে বলেছিল, তারা ক্ষমতায় ছিল বলেই চারশো বছরের পুরনো একটা ‘ঐতিহাসিক ভুল’-কে শুধরে নিয়ে হিন্দু দেবতা রামচন্দ্রকে তাঁর জন্মস্থলে সসম্মানে অধিষ্ঠিত করা গেল। বস্তুত বহু বছর ধরে বিজেপি-র যে তিনটি প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডা – কাশ্মীরের বিশেষ স্বীকৃতি বিলোপ, অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠা ও ভারতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা – এর মধ্যে দিয়ে তার দু’টি কাজ শেষ হয়ে গেল এটাও বলার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল তারা।

রামমন্দিরের উদ্বোধনের পর দেশজুড়ে যে হিন্দু ধর্মীয় ভাবাবেগের জোয়ার লক্ষ্য করা যাচ্ছিল, সম্ভবত তার জোরেই প্রধানমন্ত্রী মোদীও চারশোরও বেশি আসনে জেতার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ঘটনার তিন-চার মাসের মাথায় এসেই দেখা গেল যে, রামমন্দির কিন্তু দেশের নির্বাচনে সেভাবে আর সাড়া ফেলতে পারছে না।ভোটের মাঝপথে প্রধানমন্ত্রী মোদী আবারও অযোধ্যায় ফিরে গিয়ে মন্দির দর্শন করেছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে খুব বেশি কিছু পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। আসলে বিজেপি অযোধ্যাকে ‘নির্বাচনী ইস্যু’-তে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি, দেশের যে সব অংশ থেকে বিজেপি বাড়তি আসন জেতার আশা করছিল, সেখানেও তা তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। মন্দিরের ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠার’ মাস চারেক পরে এসে ভারতের নির্বাচনী চালচিত্র ইস্যু হিসেবে এটি ক্রমশ ম্লান হয়েছে। একই সঙ্গে মন্দির ইস্যুতে ভর করে বিজেপির বাড়তি আসন জেতার স্বপ্নও নিশ্চিতভাবে হোঁচট খেয়েছে।

এই নির্বাচনের আগে ভারতে বিরোধীদের প্রধান অভিযোগ ছিল, সিবিআই বা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) মতো কেন্দ্রীয় সরকারি এজেন্সিগুলোকে শীর্ষ বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে বিজেপি সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছে। নির্বাচনের বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই রাজ্যে রাজ্যে অজস্র বিরোধী নেতার বাড়িতে বা দফতরে এজেন্সিগুলো হানা দিয়েছে। অনেককে আটক করা হয়েছে – ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকেও তুলে নিয়ে গিয়ে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অন্যতম প্রধান মুখ ও ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার নেতা হেমন্ত সোরেন আজ পর্যন্ত জেলেই রয়েছেন। আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে মদ দুর্নীতির অভিযোগে ইডি গ্রেফতার করার পর এই ইস্যুটি একটি নাটকীয় মাত্রা পায়। কেজরিওয়ালের গ্রেফতার দিল্লি ও পাঞ্জাবে আম আদমি পার্টির নেতা-কর্মীদেরই শুধু সংহত করেনি, কংগ্রেসও তার গ্রেফতারির বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলনে নামে।

রাহুল গান্ধী থেকে মমতা ব্যানার্জী বা তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী স্ট্যালিন – বিরোধী শিবিরের স্তম্ভরা সবাই তীব্র নিন্দায় সরব হন। দিল্লিতে আম আদমি পার্টি ও কংগ্রেসের মধ্যে তেমন সুসম্পর্ক না-থাকলেও শেষ পর্যন্ত রাজধানীর সাতটি লোকসভা আসনেই যে এই দুই দল মসৃণভাবে আসন সমঝোতা করতে পেরেছে – তার পেছনেও ক্যাটালিস্টের কাজ করেছিল কেজরিওয়ালের জেলে যাওয়া। এই মুহূর্তে যদিও দিল্লির সাতটি আসনই বিজেপির দখলে, তথাপি কেজরিওয়ালকে ভোটের ঠিক আগে ইডি তুলে নেওয়ায় আম আদমি পার্টির অনুকূলে একটা সহানুভূতির হাওয়া তৈরি হয়েছে। জেল থেকে সাময়িক মুক্তি পেয়ে তিনি শুধু দিল্লিতেই নয়, উত্তরপ্রদেশ-পাঞ্জাব-হরিয়ানার মতো বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচারে রীতিমতো ঝড় তুলেছেন। বিজেপি সরকারের এজেন্সিগুলোই তাকে এই ‘ভিক্টিম কার্ড’ খেলার সুযোগ করে দিয়েছে।

নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণার ঠিক পরে পরেই অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে হাজতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত কতটা সমীচিন ছিল, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে পিছনে তাকিয়ে সে কথা এখন ভাবতেই হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশে, হরিয়ানা, পাঞ্জাব-সহ বিভিন্ন রাজ্যেই দলকে এর চড়া মাশুল গুণতে হয়েছে। এবারের লোকসভা নির্বাচনে নিজেদের আসন সংখ্যা বাড়ানোর জন্য বিজেপি বিশেষ করে যে রাজ্যগুলোকে নিশানা করেছিল, তার মধ্যে একেবারে প্রথমেই ছিল পশ্চিমবঙ্গ। আসন সংখ্যার বিচারে ৪২টি কেন্দ্র নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম রাজ্য – উত্তরপ্রদেশ (৮০) ও মহারাষ্ট্রের (৪৮) ঠিক পরেই। গতবার পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসনের মধ্যে বিজেপি জিতেছিল ১৮টিতে। এবারে কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পর্যন্ত ওই রাজ্যে এসে প্রকাশ্যেই দলকে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫টি আসন জেতার টার্গেট বেঁধে দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন শুরুর ঠিক আগেও রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমন ছিল – পরের দিকে প্রায় রাতারাতি কিন্তু সেই অবস্থা অনেকটাই পাল্টে গিয়েছিল। আর এর পেছনে কাজ করেছে তিনটি ফ্যাক্টর – সন্দেশখালিতে নারী নির্যাতন নিয়ে একের পর এক স্টিং অপারেশনের ভিডিও ফাঁস, স্কুলে হাজার হাজার বেআইনি শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে আদালতের রায় এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের রুল জারি।

সন্দেশখালিতে নারীদের ওপরে ধর্ষণ আর নির্যাতনের অভিযোগ মাস কয়েক আগে যখন সামনে আসে, তখন থেকেই বিজেপি বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সরব হয়েছিল। সেখানকার ‘নির্যাতিতা’ নারীদের সঙ্গে ভোট ঘোষণার আগেই দেখা করেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।পুরো রাজ্যে তো বটেই, জাতীয় স্তরেও সন্দেশখালির নারী নির্যাতন নিয়ে প্রচারে নেমে পড়েছিল বিজেপি। সন্দেশখালি যে লোকসভা আসনের অন্তর্গত, সেই বসিরহাট থেকে প্রার্থীও করে দেওয়া হয় নির্যাতিতা বলে পুলিশে কাছে অভিযোগ দায়ের করা নারীদের অন্যতম, রেখা পাত্রকে।সন্দেশখালির নারীদের সারা রাজ্যেই প্রচারে নিয়ে যাচ্ছিল বিজেপি – যাতে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের ঘটনাটা আরও জোরালোভাবে তুলে ধরা যায়।এরপর হঠাৎই ময়দানে চলে এলো প্রথম ‘গেম চেঞ্জার’ বা খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার ঘটনা। সন্দেশখালির এক বিজেপি নেতা গঙ্গাধর কয়ালের সঙ্গে গোপন ক্যামেরায় রেকর্ড করা কথোপকথনে ফাঁস হয়ে গেল যে সেখানে কোনও ধর্ষণ বা কোনও নারী নির্যাতন হয়নি। তিনি ক্যামেরার সামনে স্বীকার করলেন, পুরোটাই ‘সাজানো’ ঘটনা, অর্থের বিনিময়ে ওই অভিযোগ করানো হয়েছিল বিজেপির নেতাদের পরিকল্পনায়।

যদি সন্দেশখালি প্রথম ‘গেম চেঞ্জার’ হয়, তাহলে দু নম্বরে থাকবে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীর চাকরিচ্যুত হওয়ার ঘটনা।শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি, সেই অভিযোগে তৃণমূল কংগ্রেসের অতি বড় নেতা ও প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জী, তার বান্ধবী অর্পিতা মুখার্জী সহ গোটা স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার তাবড় কর্মকর্তাদের জেলে যাওয়া, মন্ত্রীর বান্ধবীর দুটি ফ্ল্যাট থেকে প্রায় ৫০ কোটি ভারতীয় টাকা উদ্ধার হওয়া বা কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে গান্ধী মূর্তির নীচে প্রায় চার বছর ধরে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় বঞ্চিত চাকরীপ্রার্থীদের ধরনা – এসব খবরই বাসি হয়ে গিয়েছিল।

ভোটের প্রচারে খুবই কম উঠে আসছিল শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির প্রসঙ্গটা।কিন্তু ভোট চলাকালীনই কলকাতা হাইকোর্ট এক রায় দিয়ে জানিয়ে দেয় যে ২০১৬ সালে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে বিভিন্ন স্কুলে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীদের মধ্যে কে যে নিজের যোগত্যতায় চাকরি পেয়েছেন আর কারা ঘুষ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন, তাদের আলাদা করা সম্ভব নয়। তাই ওই বছর যে প্রায় ২৬ হাজার মানুষ স্কুলের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন, তাদের সবার নিয়োগ বাতিল করে দেয় হাইকোর্ট।আর এই রায়ের ফলে পথে বসেন হাজার হাজার মানুষ। তাদের একটা বড় অংশ জড়ো হন কলকাতার শহীদ মিনারে। প্রতিবাদের সঙ্গেই চলতে থাকে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন দাখিলের প্রস্তুতি।শেষ পর্যন্ত মানুষের মনে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয় এই ইস্যু ।

তৃতীয় ফ্যাক্টর হল সিএএ। বিজেপি যেমন সন্দেশখালির নারী নির্যাতন নিয়ে প্রচার তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, তেমনই তারা আশা করেছিল যে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করার প্রায় চার বছর পরে ভোটের মুখে সেই আইনের বিধি জারি করে দিয়ে আইনটি চালু করলে তারা মতুয়া এবং বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তু ভোটের একটা বড় অংশ নিজেদের দিকে টেনে আনতে পারবে।স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বা বিজেপির অন্য নেতারাও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সুফল তুলে ধরার চেষ্টা করছিলেন ভোট ঘোষণার আগে থেকেই।তারা মনে করেছিলেন এই আইনটা হবে তাদের পক্ষে একটা ‘গেম চেঞ্জার’।তবে আইন যখন চালু করা হল ভোট ঘোষণার ঠিক আগে, তারপর দেখা গেল একজনও সেই আইন অনুযায়ী নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদনই করলেন না! কারণ আইনের বিভিন্ন ধারায় যা যা বলা হয়েছে, তার অনেকগুলিই উদ্বাস্তু এবং মতুয়াদের বড় অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি বলে বিজেপিরই একাংশ স্বীকার করছে।তাই যেটাকে এক সময় ‘গেম চেঞ্জার’ বলে তারা মনে করছিলেন, সেটা খেলা ঘুরিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই খেলা বিজেপির বিপক্ষে চলে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। ঠিক এই সব কারণেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিজেপির আসন বৃদ্ধি তো দূরের কথা উল্টে কমে গেছে।

লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি শেষ পর্যন্ত গতবারের তুলনায় কীরকম ফল করে, তা অনেকাংশে নির্ভর করেছিল নির্দিষ্ট কয়েকটি রাজ্যের ওপর।এগুলোর মধ্যে অন্যতম হল উত্তরপ্রদেশে, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক ও বিহার। ২০১৯র নির্বাচনে বিজেপি জোট কর্নাটকে ২৮টির মধ্যে ২৫টি, মহারাষ্ট্রে ৪৮টির মধ্যে ৪১টি ও বিহারে ৪০টির মধ্যে ৩৯টি আসন জিতেছিল। এবার চিত্র বেশ খারাপ।কর্নাটকে বিজেপি জিতেছে ১৯ টি আসনে। মহারাষ্ট্র ছিল এবারে গোটা দেশের প্রধান ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট’ – অর্থাৎ ওই রাজ্যটিতেই বিজেপি জোটের সঙ্গে বিরোধীদের সবচেয়ে কঠিন লড়াই হবে বলে মনে করা হচ্ছিল।কিন্তু বিজেপি যেভাবে মহারাষ্ট্রে অন্য দলগুলোকে ভাঙিয়ে সরকার গড়েছে এবং রাজ্যে বিজেপি ও তার জোটসঙ্গীদের যা পারফরমেন্স তাতে রাজ্যের মানুষ এবারে তাদের ওপর ভরসা যে রাখবেন না তা এক প্রকার নিশ্চিত ছিল। বিজেপির ঝুলিতে তাই এবার মাত্র নয়টি সিট। প্রসঙ্গত, বিজেপি মহারাষ্ট্রে প্রথমে উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বাধীন শিবসেনা ও পরে শারদ পাওয়ারের এনসিপি – দুটো দলকেই ভেঙেছে যথাক্রমে একনাথ সিন্ধে ও অজিত পাওয়ারের মতো নেতাদের নিয়ে, তাদের নিয়ে রাজ্যে সরকারও গড়েছে।কিন্তু শিবসেনা বা এনসিপি-র মূল দলগুলোর জনভিত্তি তারা নষ্ট করে ফেলতে পারেনি। এর প্রভাব লোকসভা আসনের ফলাফলে পড়েছে সরাসরি। পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আসলে মহারাষ্ট্র কৃষিপ্রধান রাজ্য। রাজ্যের কৃষকরা সেচের জল বা ফসলের দাম নিয়ে বেশি চিন্তিত, মঙ্গলসূত্র বা হিন্দু-মুসলিম রাজনীতির বিশেষ গুরুত্ব নেই তাদের কাছে।ভোটের ফলে সেটা স্পষ্ট।উত্তরপ্রদেশেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কাজে আসেনি। যোগীর থেকে মানুষ বেশি আস্থা রেখেছেন অখিলেশ যাদব এর দলের প্রতি। বিহারেও ভোটের মাত্র কয়েক মাস আগে ভারতীয় রাজনীতির ‘পালটু রাম’ (যিনি ঘন ঘন দল বা শিবির পাল্টান) নামে পরিচিত নীতিশ কুমারের সঙ্গে আবার হাত মেলানোটা বিজেপির জন্য কতটা লাভজনক হবে, সেই প্রশ্নও উঠেছে ইতিমধ্যেই, আগামী দিনে তার উত্তর মিলবে।

ভারতের নির্বাচন কমিশন যখন টানা প্রায় দেড় মাস ধরে সাত দফার সুদীর্ঘ নির্বাচনি নির্ঘণ্ট ঘোষণা করে, ক্ষমতাসীন বিজেপি সেই পদক্ষেপের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিল।প্রধানমন্ত্রী মোদী বা অমিত শাহ-জে পি নাড্ডার মতো দলের তারকা প্রচারকরা এর ফলে সারা দেশে ঘুরে ঘুরে অজস্র জনসভা আর রোড শো করার সুযোগ আর সময় পাবেন, তখন এটাই ছিল দলের প্রাথমিক ক্যালকুলেশন।বস্তুত এত দীর্ঘ সময় ধরে সংসদীয় নির্বাচন ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে আর কখনও হয়নি – একমাত্র ১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচন ছাড়া। যদিও সেবারের নির্বাচনে কয়েক মাস সময় লাগার কারণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।কিন্তু এবারে দেখা যাচ্ছে যত ভোট এগিয়েছে, দেশে তাপপ্রবাহও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে – এবং ভোট পড়ার হারও গতবারের তুলনায় অনেক কম হয়েছে।বিজেপি যেহেতু ‘প্রো-ইনকামবেন্সি’তে ভর করে ভোটে লড়ছে তাই এতে তাদের চিন্তিত হওয়ারও কোনও কারণ নেই। কিন্তু বিজেপির ভোট কুশলীরা বুঝতে পারেননি যে ‘প্রো-ইনকামবেন্সি’কেও এত দীর্ঘ সময় ধরে টেনে নিয়ে যাওয়াটা খুবই কঠিন একটা ব্যাপার। তা ছাড়া এবারের নির্বাচনে স্পষ্ট কোনও ‘জাতীয় ন্যারেটিভ’ সেভাবে চোখে পড়েনি।

২০১৪তে যেমন ছিল দেশে ‘বলিষ্ঠ নেতৃত্ব’ আনার ডাক, কিংবা ২০১৯-এ পুলওয়ামাতে জঙ্গী হামলার পর জাতীয় নিরাপত্তার দাবি – এবারে সেরকম কোনও নির্ণায়ক ফ্যাক্টর নির্বাচনে ছিল না। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর দিল্লির বিজেপির এক প্রথম সারির নেতা একটি টিভি চ্যানেলে স্বীকারই করেছেন যে, ভোটটা ১০০ মিটারের স্প্রিন্ট বা নিদেনপক্ষে মিডল ডিসট্যান্স রান হলেই বোধহয় ভাল হত। এই ম্যারাথনটা টানা খুব কঠিন হয়ে গেল।