পুঁজিবাদের খোলা হাওয়ায় সবচেয়ে সংবেদনশীল শেয়ার বাজারের ফাটকাবাজি৷ এখানে পুঁজিবাদী উচ্ছ্বাসের সর্বোচ্চ প্রকাশ যেমন ঘটে, তেমনই বিপর্যয়কালে মড়াকান্নাও প্রথমে শুরু হয়৷ অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি, মোড় নেওয়া, তার অাঁচ থাকে শেয়ার বাজারের খেলোয়াড়দের মনোভাবে৷ ডুবন্ত জাহাজ থেকে সবার আগে যেমন ইঁদুররা পালায়, তেমনই বিপর্যয়ের আভাস পেয়ে ফাটকার লগ্নি তুলে পালায় বাঘা খেলোয়াড়রা৷
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গত দশ বছরে কোনওদিন যাঁকে শেয়ার বাজার নিয়ে একটিও শব্দ উচ্চারণ করতে শোনা যায়নি তিনি আগবাড়িয়ে লগ্নিকারীদের আশ্বাস ও ভরসা দিয়ে বলছেন, আপনারা বাজারে যান, শেয়ার কিনুন৷ নিশ্চিত থাকুন ৪ জুন ভোটের ফল প্রকাশের পর বিপুল মুনাফা ঘরে তুলতে পারবেন৷ কিন্ত্ত বিদেশি লগ্নিকারীরা শাহ’র আশ্বাসকে আমল দেয়নি৷ তারা যথারীতি তাদের লগ্নি তুলে নিয়ে চিন ও হংকংয়ে পাড়ি দিয়েছে৷
সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গের এক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, ভারতে শেয়ার বাজারের হাল গত দশ বছরের মধ্যে এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থায়৷ বিদেশি লগ্নিকারী সংস্থাগুলির মনোভাব অনেকটাই নেতিবাচক৷ তাদের অনুমান, বহুল বিজ্ঞাপিত ৪০০ আসনের গরিষ্ঠতা নিয়ে মোদি সরকার ফিরবে না৷ শেষ পর্যন্ত টেনেটুনে মোদি সরকার গড়লেও সেই সরকার হবে দুর্বল৷ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বা নীতি নির্ধারণের দৃঢ়তা সেই সরকারের থাকবে না৷
ভোট চলাকালীন শেয়ার বাজারে অস্থিরতা টালমাটাল অবস্থা বাড়তে থাকায় উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় সরকার, উদ্বিগ্ন শাসক দল৷ ভোটে বিজেপি বা এনডিএ ঠিক কত আসন পাবে, মোদির নেতৃত্বে আদৌ সরকার গড়া সম্ভব হবে কিনা, এমন জল্পনাই এখন শেয়ার বাজারের কেন্দ্রবিন্দুতে৷ ফলে দালালদের হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও লগ্নিকারীরা লগ্নিতে উৎসাহ দেখাচ্ছে না৷ শেয়ার বাজারের মনোভাব যাতে দাবানলের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে না পড়ে তাই আসরে নেমে পড়েছেন শাসক দলের নেতামন্ত্রীরা৷ অমিত শাহ থেকে শুরু করে বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর সকলেই নানাভবে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন লগ্নিকারীদের৷
বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করই সকলকে অবাক করে দিয়েছেন৷ তাঁর মন্তব্যে অনেকেই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছেন৷ পাঁচ দফায় ভোটের হার কমে যাওয়ার ফলে শেয়ার বাজারের অস্থিরতা সামাল দিতে তাঁর আশ্বাস, ‘যতই নির্বাচন এগোবে ততই শেয়ার বাজারের অস্থিরতা কমবে৷ কারণ, বাজার টের পাবে ঠিক কী হতে চলেছে৷ আমি নিশ্চিত শেষ পর্যন্ত একটা বড় সংখ্যা আমরা পেয়ে যাব৷’
কোনও মারাত্মক কেলেঙ্কারি ছাড়া বাজার সাধারণভাবে দীর্ঘকালের জন্য ধসে পড়ে না৷ অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ওঠাপড়ার প্রেক্ষিতে এই দুই ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে যে ‘পতন’ ঘটে, তা স্বাভাবিক৷ তখন বিনিয়োগকারীরা ধৈর্য ধরতে পারলে অল্প দিনেই ‘কারেকশন’-এর সুবিধাও পেতে পারেন৷ কিন্ত্ত এই আর্থিক বাজারকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিতে পারে কিছু অসাধু দালাল৷ আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার নেশায় তারা বাজারের উপর কৃত্রিম প্রভাব বিস্তার করে৷ শেয়ারের দাম ও বণ্টন ব্যবস্থা নিয়মকানুনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে উল্টোপাল্টে দিতে ওস্তাদ এই কীর্তিমানরা৷ শেয়ার মার্কেটে স্ক্যাম যত ছোটই হোক না কেন, তাতে অভ্যন্তরীণ তো বটেই, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের লগ্নিকারীদেরও আস্থা টলে যেতে পারে৷ আর্থিক বাজার এমন ধরনের অস্থিরতায় টালমাটাল হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় উন্নয়নশীল দেশগুলি, যেখানে ১৪৪ কোটি মানুষের ভারতের পরিণতি কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়৷
ভারতে সাম্প্রতিক অতীতে অন্তত ছয়টি সর্ববৃহৎ শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারির সাক্ষী— হর্ষদ মেহতা, সিআরবি, ইউটিআই, সত্যম, সাহারা এবং এনএসই কোলোকেশন স্ক্যাম৷ ১৯৯২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সংঘটিত এই স্ক্যামগুলিতে সাধারণ ভারতবাসীর হাজার হাজার কোটি টাকা ‘হাওয়া’ হয়ে গিয়েছে৷
অতএব এই স্পর্শকাতর বিষয়ে নেতা-মন্ত্রীদের নাক না গলানো উচিত৷ কারণ তাঁদের কথা শুনে মানুষ ফের প্রতারণার শিকার বা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হলে তার দায় নেবেন কে? প্রধানমন্ত্রী মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রকাশ্য জনসভা থেকে মানুষকে প্ররোচনা দিচ্ছেন শেয়ার বাজারে বেশি টাকা বিনিয়োগের জন্য৷ এই কাজ দেশনেতাসুলভ কোনওভাবেই নয়, অসাধু শেয়ার ব্রোকার বা দালালদের মতো৷