আদি ও নব্যদের গ্রাম দখলে সংঘাত বাড়ছে
খায়রুল আনাম: রাজনৈতিক দিক থেকে বীরভূম জেলার অজয় নদ তীরবর্তী নানুর ও পাঁড়ুই থানা এলাকা উত্তেজনাকর এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। নানুরের পালিতপুরে বোলপুর-পালিতপুর সড়কে অজয় নদের উপরের লোচনদাস সেতুর ওপার পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোট থানা এলাকা। দু’পাড়েই অজয় নদে এখানে বৈধ কোনও বালিঘাট না থাকা সত্ত্বেও দু’পাড়েই প্রতি নিয়ত নদীগর্ভ থেকে অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করে তা ট্রাক্টর ভর্তি করে পাচার হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দিক থেকেই শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন হলেই হবে না, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কোন গোষ্ঠী বেশি শক্তিশালী তার উপরেই নির্ভর করে এখানকার অবৈধ বালিঘাটের দখল কার বা কোন গোষ্ঠীর হাতে থাকবে। নানুরের দিকে পালিতপুরে অজয় নদের পাশে শাসক দলের একটি বিশাল পাকা বাড়ির কার্যালয় রয়েছে। এই এলাকার শাসক দলের দলীয় কার্যালয়ের দেওয়ালে থাকা বীরভূম জেলা তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ছবি জ্বলজ্বল করতো।
কিন্তু গোরুপাচার মামলায় অনুব্রত ওরফে কেষ্ট মাণ্ডল সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হয়ে আসানসোল জেল থেকে দিল্লির তিহাড় জেলে স্থানান্তরিত হওয়ার পরই এখানকার দলীয় কার্যালয়ের দেওয়াল থেকে অনুব্রত মণ্ডলের ছবি-ই মুছে দেওয়া হয়। দলে অনুব্রত মণ্ডলের বিরোধী গোষ্ঠী এই কাজ করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। এই এলাকারই থুপসাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের গোয়ালপাড়ায় জমি দখলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শাসক দলের দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে চরম অশান্তি শুরু হয়। এনিয়ে এক পক্ষ স্থানীয় বাসাপাড়া পুলিশ ক্যাম্পে অভিযোগ জানালে পুলিশ সেই অভিযোগের ভিত্তিতে দু’জনকে আটক করে। সেই ব্যক্তিদেরই মুক্তির দাবিতে স্থানীয় দান্যপাড়া, রোহিণীপুর, গোয়ালপাড়া, রোহিণীপুর থেকে বহু সংখ্যক ব্যক্তি বাসাপাড়া পুলিশ ক্যাম্পে ধর্ণা দিতে যাওয়ার সময় অন্য পক্ষ তাদের বাধা দিলে উভয়পক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়। যাতে শেখ ফরিদ, ভাসান খান, শেখ হিরু, শেখ মিনারুল গুরুতরভাবে জখম হন। তাদের নিয়ে এসে ভর্তি করা হয় বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে। নানুরের বিধায়ক বিধান মাঝি একে গ্রাম্য বিবাদ থেকে সংঘর্ষ বলে দাবি করে জানিয়েছেন, এই ঘটনার সাথে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
অপরদিকে বোলপুর-শ্রীনিকেতন ব্লকের পাঁড়ুই থানার সাত্তোর গ্রাম পঞ্চায়েতের বিষ্ণুখণ্ডা গ্রামে মঙ্গলবার ১৮ জুন শাসক দলের দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে সারাদিন ধরে ব্যাপক সংঘর্ষ, বোমাবাজি ও লুঠপাটের ঘটনা ঘটে। ওই এলাকার মানুষজনদের অভিযোগ, সাত্তোর গ্রামের শেখ বশির ও শেখ সুজন গোষ্ঠীর মধ্যে এলাকার দখল কোন গোষ্ঠীর হাতে থাকবে, তা নিয়েই এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদের জেরে ২০২৩ সালে শেখ বশির তার অনুগামীদের নিয়ে শাসক দল ছেড়ে সিপিএমে যোগ দেন। কিন্তু এবার লোকসভা ভোটের আগে শেখ বশির সিপিএম ছেড়ে পুনরায় শাসক দলে ফিরে এলে শেখ সুজন গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের বিবাদ শুরু হয়ে যায়। বরাবর শাসক দলের সঙ্গে থেকে যাওয়া শেখ সুজন গোষ্ঠী শেখ বশির গোষ্ঠীকে ‘নব্য তৃণমূল’ হিসেবে অবহিত করলে আদি ও নব্য তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। তারই জেরে এদিন উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে প্রথমে হাতাহাতি থেকে ধারালো অস্ত্র নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। তারপরই একাধিক বাড়িতে লুঠপাট শুরু হতেই চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে শুরু হয়ে যায় ব্যাপক বোমাবাজি। পাঁড়ুই থানার পুলিশ গ্রামে পৌঁছলেও ব্যাপক বোমাবাজির কারণে প্রথমে পুলিশ গ্রামের ভিতরেই প্রবেশ করতে পারেনি। বোমার ধোঁয়ায় ঢেকে যায় চারদিক। পরে বিশাল পুলিশবাহিনী গ্রামে পৌঁছে একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সংঘর্ষে আহত এগারো জনকে নিয়ে এসে ভর্তি করা হয় বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে। এই ঘটনাকেও গ্রাম্য বিবাদ বলে মন্তব্য করা হয়েছে শাসক শিবিরের পক্ষ থেকে। ঘটনার জেরে এখনও গ্রামে উত্তেজনা থাকায় পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে ।