চুপ গণতন্ত্র চলছে! গণতন্ত্রের স্বার্থে নিজেদেরকে বলি দিতে প্রস্ত্তত থাকুন

বরুণ দাস

গণতন্ত্র কি আজ সত্যিই বিপন্ন? গণতন্ত্রের গায়ে কি অনাকাঙ্ক্ষিত অাঁচড় লেগেছে? গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যে সংক্রমণ ঘটেছে? কোনও মারণ-ভাইরাস কি গণতন্ত্রকে অাঁকড়ে ধরেছে? গণতন্ত্র কি মুখ থুবড়ে পড়েছে? গণতন্ত্রের হাল কি বেহাল? গণতন্ত্র কি তার পথ হারিয়েছে? গণতন্ত্র কি নোংরা পাঁকের মধ্যে কেবল হাবুডুবু খাচ্ছে? উত্তরণের পথ খুঁজে পাচ্ছে না? ইদানিং গণন্ত্রকে ঘিরে ইত্যাদি প্রশ্নগুলো উঠেছে৷

গণতন্ত্রকে কেন্দ্র করে উঠে আসা এসব জরুরি প্রশ্ন আজ শুধু বুদ্ধিজীবী আর বিশিষ্টজনদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, সাধারণ মানুষের মধ্যেও ঘুরপাক খাচ্ছে৷ কারণ সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে গণতন্ত্রকে ঘিরে নানাবিধ প্রশ্ন উঠেছে শাসকদলের বিরুদ্ধে৷ তবে আজ যাঁরা গণতন্ত্রের কল্যাণে ক্ষমতার বাইরে, গণতন্ত্রের জন্য সরব, তাঁরাও যখন ক্ষমতার অলিন্দে ছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও উঠেছিল একই অভিযোগ৷


কারা তুলেছিলেন ওই অভিযোগ? আজ যাঁরা ক্ষমতার অলিন্দে৷ তার মানে কী দাঁড়ায়? যে বা যাঁরা যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন, আর যে বা যাঁরা যখন ক্ষমতার বাইরে থাকেন, তাঁদের কাছে গণতন্ত্রের অর্থ আমূল বদলে যায়৷ একই শব্দ, একই দল, অথচ দু’রকম ভূমিকায় দু’রকম অর্থ৷ একেই যদি দ্বিচারিতা না বলে তো আর কাকে দ্বিচারিতা বলা যায়? এরপর তো অভিধানের খোল-নলচেই বদলাতে হবে৷

গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না অবশ্য নতুন কোনও ঘটনা নয়. এই মায়াকান্না আমরা শুনে আসছি প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে৷ দুর্মুখেরা একে আবার মায়াকান্না নয়, ‘মড়াকান্না’ বলেন৷ যদিও অপ্রিয় কথনের জন্য দুর্মুখদের দোষ দিয়ে তেমন কোনও লাভ নেই৷ বাস্তবের প্রেক্ষাপটে একে মায়াকান্না না বলে বরং ওই মড়াকান্না বলাই বিধেয়৷ কেন বিধেয়— এমন অর্বাচীন প্রশ্ন আশা করি আজ আর কেউ করবেন না৷
কেন করবেন না? কারণ সংবাদমাধ্যম আমাদেরকে মায়াকান্না আর মড়াকান্নার ফারাকটুকু অন্ততঃ বুঝতে শিখিয়েছে৷ মুদ্রিত ও বৈদু্যতিন সংবাদমাধ্যমের সৌজন্যে এখন অনেক কিছু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বোধগম্যের মধ্যে এসেছে৷ আমরা বুঝতে পারছি, গণতন্ত্রের ‘অপার মহিমা’র কথা৷ কীভবে শাসকদলের ছল-চাতুর্যের মাধ্যমে গণতন্ত্রের সঙ্গে মিশে গেছে অ-গণতন্ত্রের মনুষ্যত্ব ও মানবতা-বিরোধী বৈশিষ্ট্যগুলি৷

তাহলে অনিবার্য প্রশ্ন ওঠে, ফারাকটুকু যদি আমাদের বোধগম্যের মধ্যেই হয়, তাহলে আমরা কেন চুপটি করে বসে আছি? ‘ভাজা মাছটি উল্টে খেতে না-পারা’র ভান করে দিব্যি দিন কাটিয়ে দিচ্ছি? কেন জেনে-বুঝেও রাজনৈতিক দলের রুদালিদের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছি না? প্রতিবাদের-প্রতিরোধের পথে পা বাড়াচ্ছি না? সবকিছু বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিচ্ছি? উঠে আসা প্রশ্নগুলো কি একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক?

না, মোটেও তা নয়৷ আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ইচ্ছের ‘মেনে ও মানিয়ে নেওয়া’ ব্যাপারটার পিছনে অনেক বাস্তবসম্মত কারণ আছে৷ যে কারণগুলো কোনওভবেই তুচ্ছ করার নয়৷ যে কারণটা সবার আগে আমাদের মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়, তা হলো, সংঘবদ্ধতার দিকটি৷ আমাদের মতো সাধারণ মানুষ মোটেও সংঘবদ্ধ নন৷ তাঁরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন৷ দলীয় রাজনীতি তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে৷

এই বিচ্ছিন্নতারই সুযোগ নিচ্ছে দলমত নির্বিশেষে আজকের রাজনৈতিক দলগুলো৷ তাঁরা ভালো করেই জানেন, জনগণ সংগঠিত কিংবা সংঘবদ্ধ নন৷ তেমনটা হওয়ারও কোনও সমূহ সম্ভাবনা নেই৷ বিচ্ছিন্নতা দুর্বলতার জন্ম দেয়৷ ফলে জনগণকে তোয়াক্কা করারও কোনও প্রশ্ন উঠছে না৷ বরং কী করে আরও বিচ্ছিন্ন হওয়া যায়, তারই ধন্বন্তরি দাওয়াই দিচ্ছেন নেতারা৷ আমাদের অনেকেই তা সর্বান্তকরণে মেনেও নিচ্ছি৷
আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নজর রাখছে সবার ওপর৷ যাতে নিজেদের প্রভুত্ব বা কর্তত্ব কায়েম রাখা যায়৷ মানুষকে পুতুল হিসেবে ‘ব্যবহার’ করা যায়৷ তাঁদের কোনও ‘স্বর’ না থাকে৷

একবার সচেতনভাবে আমাদের চারপাশটা দেখার চেষ্টা করা যাক৷ পরিবারের কর্তা থেকে পাড়ার কমিটি-কর্তা, সমাজ-কর্তা থেকে জেলা-কর্তা, রাজ্য-কর্তা থেকে কেন্দ্র-কর্তা অর্থাৎ প্রশাসনিক প্রধান থেকে সাংবিধানিক প্রধান সব্বাই ‘গণতন্ত্র’-এর জন্য ব্যাকুল৷ সবার মুখেই মুক্ত গণতন্ত্রের কথা৷ রাজনৈতিক মতবাদ নির্বিশেষে আঞ্চলিক ও জাতীয় দলের ছোট-মেজ-বড়কর্তারাও গণতন্ত্রের জন্য আঁকুপাঁকু করেন৷
তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, এতই যদি গণতন্ত্রের জন্য ব্যাকুলতা তো গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের কেন এই আশঙ্কা? সবাই যখন গণতন্ত্রের জন্য মুখিয়ে আছেন, তাহলে গণতন্ত্রের বিপদটা কোথায়? স্বাধীনভাবে সাড়ে সাত দশকে তো গণতন্ত্র আমাদের ঘাড়ে পাকাপাকিভাবে জাকিয়ে বসার কথা৷ যাকে বলে একেবারে ‘শিকড় গেড়ে’ বসা উচিত৷ যে শিকড় এতদিনে দেশের মাটির গভীরে প্রোথিত হয়ে যাওয়ার কথা৷

কিন্ত্ত তা কি আদৌ হয়েছে? বাস্তব কী বলে? আমাদের চারপাশে তাকালে তেমন কোনও চিত্র চোখে পড়ে কি? অথচ স্বাধীনতার পর পায়ে পায়ে এতগুলো বছর পার হতে চলল৷ এতদিনেও যদি গণতন্ত্র তার কিড় গেড়ে বসতে না পারে তো আর কবে বসবে? গণতন্ত্রের বীজ কি তাহলে ঠিকমতো পোঁতা যায়নি? এমন একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে জেগে ওঠা স্বাভাবিক৷ অনেকের মধ্যে হয়তো জেগে উঠছেও৷

অথচ আমরা অনেকেই কথায় কথায় গণতন্ত্রের কথা বলি৷ শুধু বলি না, রীতিমতো বড়াই করি৷ ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ’ বলে গর্ব করি৷ প্রতি পাঁচ বছর অন্তর গণতন্ত্রের পবিত্র মহড়া দিই৷ ভোট-উৎসবে মেতে উঠি৷ উৎসব মানেই মিলন, উৎসব মানেই আনন্দ৷ কিন্ত্ত ভোট-উৎসব কি সত্যিই আমাদের মতো সাধারণের কাছে আনন্দের হয়ে ওঠে? বোধহয় না৷ কারণ এই উৎসবের সঙ্গে থাকে তাণ্ডব৷

যাকে বলে মারণ-তাণ্ডব৷ কিছু সংখ্যক নিরপরাধ মানুষের বলির মধ্য দিয়ে এই ভোট-উৎসবের সমাপ্তি ঘটে৷ সংখ্যাটা কম হলে সরকার-পক্ষ স্বস্তিবোধ করেন৷ অন্যদিকে সংখ্যাটা বেশি হলে বিরোধীরা স্বস্তিবোধ করেন৷ কারণ হইচই করার পক্ষে সুবিধে হয়৷ কিন্ত্ত মৃতের সংখ্যাটা যাই হোক না কেন, একজন হলেও তো সেই পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি, যে ক্ষতি কোনও অর্থের বিনিময়েই পূরণ হওয়া সম্ভব নয়৷

অনেকেই জানেন, আমাদের নেতা-মন্ত্রীরাও তো কথায় কথায় গণতন্ত্রের বড়াই করে বিবৃতি দিয়ে থাকেন৷ ‘পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র’ বলে গলার শিরা ফুলিয়ে বক্তব্যও রাখেন৷ আমরা সেই অমৃত ভাষণ প্রায় প্রতিদিনই সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে সচিত্র শ্রবণ ও পঠন করি৷ গণতন্ত্রের প্রতি তাঁদের মৌখিক আনুগত্য দেখে চমৎকৃত হই৷ ভাবি, এই না-হলে নেতা-মন্ত্রী! অনেকে ‘ধন্য ধন্য’ করেন গণতন্ত্রের প্রতি তাঁদের অপার প্রেম দেখে৷

বিশেষ করে যাঁরা সক্রিয় দলীয় কর্মী-সমর্থক কিংবা দলের শুভানুধ্যায়ী৷ ‘গণতন্ত্রের পূজারী’দের পাশে দাঁড়িয়ে বা মুখ বাড়িয়ে সেলফিতোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন অনেকে৷ অলক্ষ্যে বুঝি বা মুচকি হাসে গণতন্ত্র৷ তার সে অর্থবহ হাসি আমাদের অনেকেরই নজরে আসে না৷ কারণ নোংরা রাজনীতির চাকচিক্যে আমরা বড় বেশি ব্যস্ত থাকি৷ গণতন্ত্রের তাৎপর্য বা মহিমা বোঝার মতো মানসিকতা হারিয়ে ফেলি৷

গণতন্ত্র আর দলীয়তন্ত্রের মধ্যে মৌলিক ফারাকটুকুই গুলিয়ে ফেলি৷ দলীয়তন্ত্রকেই গণতন্ত্র বলে ভুল করি৷ আসলে আমাদেরকে গুলিয়ে দেওয়া হয়৷ অত্যন্ত সচেতনভাবেই এ কাজটি করেন দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক দলের মোড়লেরা আর এই ভুলের মাশুল গুনতে হয় আমাদের মতো আম-জনতাকে৷ মানুষ সচেতন না হলে গণতন্ত্রের ফাঁক-ফোঁকর ধরে উদ্ভূত বিচু্যতি থেকে রেহাই পাওয়ার কোনও উপায় নেই৷
প্রশ্ন হলো, গণতন্ত্রের মূল কথা কী? জনগণ প্রতিনিধিদের নির্বাচন করেন৷ হার কিংবা জিৎ যাই হোক না কেন, জনমতকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে মাথা পেতে মেনে নেওয়াটাই গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত৷ কিন্ত্ত নির্বাচনে পরাজয়কে মেনে নিতে অনেকেই ঠিক প্রস্ত্তত নন৷ পরাজিত দল নানারকম ফন্দি-ফিকির খোঁজেন যাতে বিজয়ী দলকে যে কোনও ভাবে ফ্যাসাদে ফেলা যায়৷ জনগণের রায়কে নস্যাৎ করতে বদ্ধপরিকর৷
অন্যদিকে নির্বাচনে বিজয়ী দল নিজেদেরকে ধরা-ছোঁওয়ার বাইরে ভাবতে শুরু করেন৷ গণতন্ত্রে তাঁরা যে প্রশাসক মাত্র, শাসক নন— একথা বেমালুম ভুলে যান৷ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা নিজেদেরকে আর জনসেবক নয়, জনগণের সম্রাট ভাবতে অভ্যস্থ হয়ে ওঠেন৷ যাঁদের ভোটে তাঁরা নির্বাচিত, সেই মানুষদেরই মানুষ ভাবতে দ্বিধাবোধ করেন৷ তাঁদের ভাবখানা এই, সাধারণ মানুষ যেন নিজেদের তালুকদারির প্রজা৷
দলমত নির্বিশেষে অধিকাংশ নেতা-মন্ত্রীদের সার্বিক আচার-আচরণ, কথাবার্তা, চলাফেরা এবং সর্বোপরি জীবনযাত্রা— সবকিছুর মধ্যেই যেন একটা দম্ভ, দাপট এমনকি, দৌরাত্ম্য প্রকাশ পায়৷ ‘আমিই তোমাদের একমাত্র ত্রাণকর্তা’— গণতন্ত্রে এই ঔদ্ধত্য কোনওভাবেই কাম্য নয়৷ কিন্ত্ত সেকথা মানছেন কে? মন্ত্রী তো বটেই, শাসকদলের ছোট-বড়-মেজ সব মাপের নেতাদের মধ্যেই এই মানসিকতা জন্ম নেয়৷

শাসকদলের এই অবাঞ্ছিত প্রবণতা দেখেই সংসদীয় গণতন্ত্রের পতনপর্বের শুরু৷ প্রশাসক ও নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে অবাঞ্ছিত বিভাজন সৃষ্টি হয়৷ কেউ কাউকে শ্রদ্ধা-সম্মান তো অনেক পরের কথা, বিশ্বাস করতে পারেন না৷ উভয়ের মধ্যে রাজা-প্রজার সম্পর্ক তৈরি হয়৷ যা মুক্ত গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকারক তো বটেই, গণতন্ত্রের চরিত্র বিরোধীও৷ আর এভাবেই গণতন্ত্র তার বৈশিষ্ট্য হারায়, প্রাণ হারায়৷

যে শাসন-ব্যবস্থাকে অন্যান্য শাসন-ব্যবস্থা থেকে অপেক্ষাকৃত ভালো বলে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সচেতন মানুষ মেনে নিয়েছিলেন, সেই ব্যবস্থাকেই শাসকশ্রেণি নিজেদের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে তাকে কালিমালিপ্ত করেছেন৷ সমাজতন্ত্র যেমন মানুষেরই অপব্যবহারের ফলে মুছে যেতে বসেছে, তেমনই গণতন্ত্রও হয়তো শাসকদলের অপকর্মের ফলে ভবিষ্যতে মুছে যাবে৷ তার পদধ্বনিও শোনা যাচ্ছে৷

আমাদের দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রকে কলঙ্কিত করার অপপ্রয়াস শুরু হয়েছে অনেক আগেই৷ গত শতকের সত্তরের মাঝামাঝি গোটা দেশে জরুরি অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে তারই পদক্ষেপ শুরু হয়েছিল৷ বর্তমান শাসকদল তাকে ত্বরান্বিত করে তুলেছেন৷ সরাসরি জরুরি অবস্থা জারি না করেও যে সংসদীয় গণতন্ত্রকে কালিমালিপ্ত ও ধ্বংস করা যায়, তারই নজরকাড়া নজির গড়ে তুলেছেন৷ অতএব সাধু সাবধান৷