মোদির স্লোগান বাতিলের দাবি জানিয়ে দলের মধ্যেই বিপাকে শুভেন্দু, রাজনৈতিক মহলে বিতর্কের ঝড়

নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসার সময় থেকে প্রচারিত হয়ে আসছে মোদির একটি বহু চর্চিত স্লোগান, ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’। মোদি এবং বিজেপি-র নেতা কর্মীরা দলের ভিতরে ও বাইরে সেই স্লোগানকে এতদিন সযত্নে লালন-পালন করে এসেছেন। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে সেই স্লোগানকে মেনে সরকার চালানোর দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা। আর সেই স্লোগানকে বন্ধের নিদান দিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা তথা নন্দীগ্রামের বিজেপি বিধায়ক। তিনি কার্যত রাজ্যের ভোটে মুসলিমদের ভূমিকা নিয়ে বলতে গিয়েই এই বিতর্কিত মন্তব্য করেন। যা নিয়ে তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি থেকে শুরু করে বিজেপির কেন্দ্রীয় কমিটিও। কারণ বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে চর্চা শুরু হয়েছে। ব্যাখ্যা করা হয়েছে, বিজেপি শুধু হিন্দুদের পার্টি।

প্রসঙ্গত বুধবার সায়েন্স সিটি প্রেক্ষাগৃহে রাজ্য বিজেপির বর্ধিত কর্মসমিতির বৈঠক ছিল। শুভেন্দু প্রথমে সেই বৈঠকে এবং পরে বাইরে এসে সাংবাদিকদের সামনে প্রশ্নের উত্তরে বেশ কিছু উত্তেজক বক্তব্য পেশ করেন। দুপুরে সায়েন্স সিটিতে শুভেন্দু বলেন, অনেক হয়েছে সবকা সাথ, সবকা বিকাশ। যারা আমাদের সঙ্গে নেই। আমরাও তাদের সঙ্গে নেই। ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ বন্ধ করো’। শুধু তাই নয়, দলীয় বৈঠকে তাঁর বক্তৃতার শেষে শুভেন্দু এও বলেন, বিজেপির সংখ্যালঘু সেল রাখার দরকার নেই। লোকসভা ভোটে তিনটি বিষয় প্রমাণ হয়ে গেছে। তার অন্যতম হল, বাংলায় মুসলমানরা বিজেপিকে ভোট দেয় না। সেজন্য মোদির স্লোগানের প্রয়োজনীয়তা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দেন শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ আর বলব না।’ তাঁর বক্তব্য, ‘বলব যো হামারে সাথ, হাম উনকা সাথ। সব কা সাথ সবকা বিকাশ বন্ধ করো। নো নিড সংখ্যালঘু মোর্চা।’ সেই সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর, রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার সহ শীর্ষ নেতারা।

শুভেন্দুর এই মন্তব্যের পরই শোরগোল পড়ে যায় রাজ্য রাজনীতিতে। শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্যের জবাবে তৃণমূল নেতা শান্তনু সেন বলেন, ‘বিজেপির আসল চেহারা প্রকাশ্যে এসেছে। আমরা বারবার বলি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার ১১ কোটি মানুষের মুখ্যমন্ত্রী। নরেন্দ্র মোদী শুধুমাত্র বিজেপির প্রধানমন্ত্রী। বিজেপি স্বার্থপর। মানুষ ভোটবাক্সে যোগ্য জবাব দিয়েছে।’ শান্তনু সেনের সুরে একই কথা বলেন, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরীও। তাঁর কথায়, প্রধানমন্ত্রী নিজে বাংলায় এসে চড়া দাগের হিন্দু-মুসলমান করে গেছেন। ভোটের সময়ে তিনি মুসলমানদের সম্পর্কে কী না বলেছেন। সুতরাং মোদী যা বলছেন, তাঁর দলের নেতারা তো তাই বলবেন। বিজেপির ‘সবকা সাথ’-এর স্লোগান পুরোটাই ভাঁওতা। শুভেন্দু ভাঁওতা ছেড়ে সোজা কথাটাই বলে ফেলেছেন।


এরপরই বিষয়টি ধামাচাপা দিতে আসরে নামেন বিজেপি-র রাজ্য নেতারা। রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিষয়টি নিয়ে শুভেন্দুর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধাচরণ করেন দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যও বিষয়টি নিয়ে শুভেন্দুর মতের উল্টো সুর শোনান। ঘটনার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই প্রতিক্রিয়া দেন শমীক। তিনি এই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেন। শমীক ভট্টাচার্য বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির ঐতিহ্যের কথা বোঝাতে কাজি নজরুল ইসলামের কবিতার প্রসঙ্গ তোলেন। এদিকে মোদী সরকারের মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার শুভেন্দুর এই মন্তব্য নিয়ে আপত্তি জানিয়ে বলেন, শুভেন্দুর ওই বক্তব্য দল ‘অনুমোদন’ করে না। সুকান্তের কথায়,‘‘বাংলায় ঐক্যবদ্ধভাবে বিজেপি এগোবে।’’

তারপরই ঢোক গিলতে বাধ্য হলেন শুভেন্দু। তিনি এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করেন, তাঁর কথার অপব্যাখ্যা হয়েছে। তিনি লেখেন, ‘আমি ও কথা বলতে চাইনি, ভুল ব্যাখ্যা হচ্ছে।’ তড়িঘড়ি সামাজিক মাধ্যমে ‘ব্যাখ্যা’ দেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। তাঁর ব্যাখ্যায়, শুধু মোদীর স্লোগান নিয়ে তাঁর বক্তব্যের কথা রয়েছে। সংখ্যালঘু মোর্চা তুলে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে কোনও বক্তব্য জানাননি বলে দাবি করেন শুভেন্দু। তাঁর বক্তব্য, তিনি শুধু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ওই আহ্বান করেছেন। দেশের ক্ষেত্রে নয়।

উল্লেখ্য, দলের রাজ্যসভাপতির সঙ্গে বিরোধী দলনেতার যে বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে, সম্প্রতি শুভেন্দু ও সুকান্তর বিভিন্ন মন্তব্যে স্পষ্ট হচ্ছিল। সম্প্রতি লোকসভা ভোট ও চার বিধানসভার উপনির্বাচনের ফলাফলে বিজেপির ব্যর্থতার নিরিখে বিজেপির সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে তির্যক মন্তব্য করেন শুভেন্দু। রাজ্যে দলের ভরাডুবি নিয়ে তিনি দাবি করেন, ‘‘আমি বিরোধী দলনেতা। সংগঠনের দায়িত্বে নেই।’’ যা থেকে অনেকেই মনে করছিলেন, ‘সংগঠনের নেতা’ হিসেবে শুভেন্দু পরোক্ষে রাজ্য সভাপতি সুকান্তকেই নিশানা করছেন। সেই প্রসঙ্গে সুকান্ত সরাসরি সহজভাবে জবাব দেন। তিনি বলেন, ভোটে জিতলেই সকলে বলবে সংগঠন দারুন মজবুত। তবে ভোটে সংগঠনের কাজ ২৫ শতাংশ। যদিও সুকান্ত এই মন্তব্যের সময় শুভেন্দুর নাম উল্লেখ করেননি। সাধারণভাবে সংগঠন এবং নির্বাচন নিয়ে নিজের অভিমত জানিয়েছেন। তবে দলের অন্দরে যে ‘মতবিরোধ’ রয়েছে, তা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি। তিনি বলেন, ‘মতবিরোধ’ থাকলেও ‘মনোবিরোধ’ নেই। বুধবার রাজ্য বিজেপির কর্মসমিতির বৈঠকে দলের কর্মীদের উদ্দেশ্যে বার্তা দিয়ে সুকান্ত বলেন, ‘‘আমাদের মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে। কাজ করতে গেলে তা হয়। কিন্তু মনোবিরোধ নেই। তা থাকা উচিতও নয়।’’