নিজস্ব প্রতিনিধি: রেলব্যবস্থার মেরুদন্ড যেন ভেঙে গিয়েছে। ২০২৩ সালে বাহানগায় করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা ভোলার নয়। তারপর চলতি বছরে একের পর এক রেল দুর্ঘটনা। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস, ডিব্রুগড় এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার বিভীষিকা কাটতে না কাটতেই এবার মঙ্গলবার হাওড়া থেকে মুম্বইগামী এক্সপ্রেস পড়লো দুর্ঘটনার কবলে। ঘন ঘন এই রেল দুর্ঘটনা এবং কেন্দ্র সরকারের ‘অকর্মণ্যতা’র প্রসঙ্গ তুলে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক্স বার্তায় কেন্দ্রকে আক্রমণ শানিয়েছেন কড়া ভাষায়। তৃণমূল সুপ্রিমো কেন্দ্রকে দুষতেই একে একে কেন্দ্র সরকারকে বিঁধতে শুরু করেছেন তৃণমূলের অন্যান্য শীর্ষ নেতৃত্বগণ এবং বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র নেতা-নেত্রীরা। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, ‘কবচ’ সুরক্ষা ব্যবস্থার বাস্তবায়নে ‘ঢিলেমি’ নিয়ে। পৃথক রেল বাজেট তুলে দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে বিরোধী দলগুলি। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের পর সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদব বলেছেন, “রেলে যাত্রী সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে বড় বড় দাবি করে সরকার! তারপরও এই দুর্ঘটনা কীভাবে হচ্ছে? কেন সাধারণ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে?”
রেলের ‘কবচ’ ব্যবস্থা থেকে রেল দুর্ঘটনায় কেন্দ্রের উদাসীনতা এমন একাধিক প্রসঙ্গ তুলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন ইন্ডিয়ার শরিক দল তৃণমূলের সাংসদরা। তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সাগরিকা ঘোষ বলেন, “আর কত রেল দুর্ঘটনা ঘটলে মোদী সরকারের চৈতণ্যদ্বয় হবে? জনসাধারণ দিনের পর দিন এই দুর্দশা এবং সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু কেন্দ্র সরকার জবাবদিহিতাকে এড়িয়ে চলছে। কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব বিজেপির রাজনৈতিক ক্ষেত্র এবং নির্বাচন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে রেল মন্ত্রক নিয়ে ভাবার সময় পাননি!” তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সুস্মিতা দেব বলেন, “প্রধানমন্ত্রী রেল সম্পর্কে বড়ো বড়ো ভাষণ দেন। তিনি বলেন, বিগত দশ বছরে রেলের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হয়েছে। বাস্তবে বিগত দশ বছরে ভারতে রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে। এর দায় কে নেবে? রেলের বাজেট সংক্রান্ত সংসদের আলোচনাও স্তব্ধ করে দিয়েছে কেন্দ্র সরকার। এভাবেই জবাবদিহিতা এড়িয়ে চলা হচ্ছে।” রাজ্য তৃণমূলের মুখপাত্র কুনাল ঘোষ এ প্রসঙ্গে বলেন, “নিত্য দিনের ঘটনা হয়ে গিয়েছে, দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে রেল সফর! এমনকি দুর্ঘটনার পরও উদ্ধারকার্যে বিলম্ব করেছে রেল। ধারাবাহিক দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী, আপনি পদে বসে থাকবেন? যাত্রী সুরক্ষা থেকে প্রযুক্তির উন্নতি, সুরক্ষাকবচের কোনো বালাই নেই! ধনী লোকেদের জন্য কিছু ট্রেনের উদ্বোধন করে চলেছেন নরেন্দ্র মোদী আর সাধারণ মানুষকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিচ্ছেন।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্তমানে রেল বাজেট কেন তুলে দেওয়া হল, সুস্মিতার পাশাপাশি তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূল সাংসদ কীর্তি আজাদও। অতীতে ১৯৬৫ সালে রেল দুর্ঘটনার কারণে তৎকালীন রেলমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মন্ত্রিত্ব ছেড়েছিলেন। সে কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন কীর্তি। উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করার সময় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের মুখে রেলের উল্লেখ শোনা গিয়েছিল মাত্র একবার। প্রায় দেড় ঘণ্টার সুদীর্ঘ বাজেট বক্তৃতায় রেলের জন্য বিশেষ কিছুই ঘোষণা ছিল না নির্মলার গলায়। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সাংসদ মহুয়া মাজিও কেন্দ্রকে একহাত নিয়েছেন। হেমন্ত সোরেনের দলের সাংসদ নির্মলার বিরুদ্ধে তোপ দেগে বলেন, “অর্থমন্ত্রী রেলের ব্যাপারে কোনও কথাই বললেন না (বাজেটে)। আগে রেলের জন্য পৃথক বাজেট হত। আর এখন রেলের জন্য কিছুই করছে না কেন্দ্র।” রেল বাজেট তো তুলে দেওয়া হলো, কিন্তু কোথায় ‘কবচ’ ব্যবস্থা? আরজেডি সাংসদ মনোজ ঝাঁ প্রশ্ন তুলেছেন এই ‘কবচ’ ব্যবস্থা নিয়েই।
তিনি বলেন, “এখন রেল দুর্ঘটনা ছাড়া একটি দিনও যদি কেটে যায়, সাধারণ মানুষ ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান। গত বছরের বাজেটে কবচ ব্যবস্থা নিয়ে বড় বড় দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু এবারের বাজেটে এক বারের জন্যও সেটির কথা উল্লেখ করলেন না।” কংগ্রেস সাংসদ মানিকরাম ঠাকুর আবার ঝাড়খণ্ডের রেল দুর্ঘটনার বিষয়টি নিয়ে কড়া আক্রমণ শানিয়েছেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবকে। তিনি বলেন, “অশ্বিনী বৈষ্ণব রেলমন্ত্রী হিসাবে নন, রেল দুর্ঘটনা মন্ত্রী হিসাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।” কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন শিব সেনা নেত্রী প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদীও। একাধিক রেল দুর্ঘটনাকে কেন্দ্রের ‘লজ্জাজনক উদাসীনতা’ বলেছেন প্রিয়াঙ্কা। রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবকে কটাক্ষ করে তিনি লিখেছেন, “আজ পর্যন্ত অসংখ্য মৃত্যুর পরেও জবাবদিহি নেই। আমার ধারণা এই ঘটনাও কোনও প্রভাব ফেলবে না। ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করে, তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আরও একটি ইনস্টাগ্রাম রিল বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন তিনি।”