• facebook
  • twitter
Sunday, 8 September, 2024

বিজেপি’র অপ্রত্যাশিত ভালো ফলের অধীর অপেক্ষায় শান্তিকুঞ্জ

রাজনীতির মহাসমুদ্রে একটি শিশির বিন্দু দেবাশিস দাস: ক্ষমতার অন্যতম ভরকেন্দ্র শান্তিকুঞ্জ৷ কারণ এই বাড়িতেই থাকেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর পিতা শিশির অধিকারী৷ স্বাভাবিকভাবে এই বাড়িকে ঘিরে রাজ্য রাজনীতিতে কৌতূহল এখন কতটা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ বয়সজনিত কারণে কয়েক দশক পর এবার এই প্রথম সরাসরি নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সম্মুখ সমরে নেই এই বাড়ির সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি৷

রাজনীতির মহাসমুদ্রে একটি শিশির বিন্দু

দেবাশিস দাস: ক্ষমতার অন্যতম ভরকেন্দ্র শান্তিকুঞ্জ৷ কারণ এই বাড়িতেই থাকেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর পিতা শিশির অধিকারী৷ স্বাভাবিকভাবে এই বাড়িকে ঘিরে রাজ্য রাজনীতিতে কৌতূহল এখন কতটা, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ বয়সজনিত কারণে কয়েক দশক পর এবার এই প্রথম সরাসরি নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সম্মুখ সমরে নেই এই বাড়ির সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি৷ কিন্ত্ত তা বলে সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকা যে তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, তা বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন ৮০-র উর্ধ্ব এই প্রাণবন্ত মানুষ৷ দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর ঝুলিতে৷ স্মৃতির সরণি বেয়ে জানা অজানা নানা কথার ভিড় এতটাই উপচে পড়ছে যে কোনটা আগে বলবেন, কোনটা পরে, বলতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন৷ রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ এবং তাঁর দীর্ঘপথ চলা প্রথমে কংগ্রেস, পরে তৃণমূল হয়ে বর্তমানে বিজেপির পতাকায় থাকা অধিকারী পরিবারের রাজনীতির যাত্রাপথ স্বল্প সময়ের মধ্যে তুলে ধরার যথাসাধ্য প্রয়াস দেখে মনে হচ্ছিল এখনও অনেক কিছু রাজনীতিকে দেওয়ার আছে অধিকারী পরিবারের৷ অধিকারী পরিবারের বিশ্বাসযোগ্যতা একদিনে তৈরি হয়নি৷ বর্তমান রাজ্য রাজনীতিতে এই পরিবারের অবদানই জনপ্রিয় করে তুলেছে অধিকারী পরিবারকে৷ যে কারণে নির্দ্বিধায় দেশের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সাংসদ শিশির অধিকারী বলতে পারেন, ‘আমরা যার সঙ্গে থাকি সততার সঙ্গে থাকি৷ বুক ফুলিয়ে থাকি৷ মেদিনীপুরের মাঠ, জল, বাতাসের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে৷ এই মাটির ঋণ কখনও অস্বীকার করতে পারব না৷

সময়ের দাবি মেনে তৃণমূলকে শক্তিশালী করেছিলাম৷ গণতান্ত্রিকভাবে নন্দীগ্রামের আন্দোলন সংগঠিত করার পেছনে আমাদের কী ভূমিকা ছিল বাংলা ও দেশের মানুষের কাছে তা অজানা নয়৷ জঙ্গলমহলে সাধারণ মানুষকে সংঘবদ্ধ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠিত করার পিছনে নিষ্ঠা সহকারে যে পরিশ্রম করেছি, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না৷ নেতাইয়ের গণহত্যা নাড়িয়ে দিয়েছিল জঙ্গলমহলের ভিত৷ নন্দীগ্রামের মতো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পাশাপাশি লালগড়ের নেতাইয়ে দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল মানুষজন৷ সেদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শুভেন্দুই প্রথম নেতাই পৌঁছেছিল৷ বাকিটা ইতিহাস৷ সাধারণ মানুষকে পাশে নিয়ে মাওবাদীদের বিচ্ছিন্ন করে কোণঠাসা করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করার কাজটা কোনওভাবেই সোজা ছিল না৷ ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া জঙ্গলমহলের এই তিন জেলায় অতি বামপন্থীদের সক্রিয়তাকে রুখতে দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়েছে৷ ফলে বাংলার মানুষের কাছে অধিকারী পরিবারকে নতুন করে পরিচয় করানোর কিছু নেই৷’

একটা সময় বুলেটের দাপাদাপি আর বারুদের ঘ্রাণে চিঁড়েচ্যাপ্টা ছিল জঙ্গলমহল৷ খুন ছিল রোজকার ঘটনা৷ ত্রস্ত জঙ্গলমহলে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সেখানকার আমজনতার মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর কাজটা করে যেতে হয়েছে দিনের পর দিন৷ তার ফলেই শান্তি ফিরেছে৷ জঙ্গলমহলের শান্তিকে চিরস্থায়ী করার পিছনে কাদের কী ভূমিকা ছিল, তা ওখানকার মানুষজনই আপনাদের ভালোই বলতে পারবেন৷ বাংলার মানুষের কাছে আমাদের উচ্চতাকে যতই খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করা হোক না কেন, এর থেকে কোনও রাজনৈতিক ফায়দা পাওয়া যাবে না, সাফ জানালেন শিশির৷

সেই সঙ্গে শিশিরবাবু আরও বলেন, ‘রাজ্যের সাধারণ মানুষের আশীর্বাদ, ভালোবাসা আমাদের সঙ্গে রয়েছে৷ কেউ আমাদের কিছু সহজে পাইয়ে দেয়নি৷ আমাদের অর্জন করতে হয়েছে৷ আমাদের পরিবার থেকে যাঁরা এমপি, এমএলএ হয়েছেন, সবই আন্দোলনের ফসল৷ কিন্ত্ত যেভাবে আমাদের বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে, আমাদের বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা দেখে আমরা তাজ্জব বনে গিয়েছি৷

সিপিএমের বিরুদ্ধে এত লড়াই করেছি, তারা এভাবে কোনও দিন অপদস্থ করার চেষ্টা করেনি৷ জীবনে মাথা উঁচু করে বাঁচার শিক্ষা মেদিনীপুর দিয়েছে, সেখান থেকে কখনও পিছাবনী৷’ রাজ্যের শাসক দল প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে একরাশ অভিমান ও ক্ষোভ উগরে দিয়ে অধিকারী পরিবারের সবচেয়ে প্রবীণ মানুষটি বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন বিশেষণে অভিহিত করা হচ্ছে৷ যিনি বা যাঁরা এটা করছেন, তাঁরা নিজেরাও জানেন, ঠিক করছেন না৷ কালিমালিপ্ত করার এই প্রয়াস বাংলার মানুষ ভালোভাবে নেয়নি৷ সে কারণেই তো শুভেন্দুর জনপ্রিয়তা দিনের পর দিন বাড়ছে৷ তৃণমূলকে রাজ্যে ক্ষমতায় আনার পিছনে অধিকারী পরিবারের কতটা অবদান আছে, তা সবাই জানেন৷ শুভেন্দুকে রোখার জন্য ৪২টি মামলা করা হয়েছে৷ আমাদের সম্পত্তির হিসেব নেওয়ার জন্য পুলিশের যে আধিকারিকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁদের কেউ কেউ ফোন করে আগাম আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন৷ এসব করে আমাদেরকে দমানো যাবে না৷ অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাদের৷ তা সত্ত্বেও আমাদের টলানো যায়নি৷ জঙ্গলমহল থেকে ফেরার পথে আচমকাই আমার গাড়ির কনভয় থেকে পাইলট ভ্যান উধাও হয়ে যায়৷ নিরাপত্তারক্ষীরা সরতে থাকে৷ মানুষের নিরাপত্তার উপর নির্ভর করে সেই রাতে জঙ্গলমহল পেরিয়ে কাঁথিতে আসি৷ ফলে অনেকদিন ধরেই আমাদেরকে টার্গেট করা হচ্ছে৷ কিন্ত্ত আমাদেরও নিজস্ব সোর্স রয়েছে৷’

যে জোড়াফুলকে জল, আলো, বাতাস, উষ্ণতা দিয়ে বড় করলেন, তার সঙ্গে বিচ্ছেদ কি আপনাকে ভাবায় না? এই প্রশ্নের উত্তরে শিশিরবাবু বলেন, ‘তৃণমূলে সুদিন যেদিন থেকে শুরু হল, সেদিন থেকে আমাদেরকে ব্যাকফুটে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়৷ তৃণমূলে আগে যাঁরা ছিলেন, যাঁদের সঙ্গে রাজনীতির আলোচনা হত, তাঁরা এখন এই দলে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছেন৷ আসলে তাঁদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে৷ এখন তো তৃণমূল দু-একজনের উপর নির্ভর৷ বামেদেরকে সরিয়ে যে ধরনের বাংলা গড়ার সংকল্প নেওয়া হয়েছিল, তার ছিঁটেফোটাও পূরণ করা সম্ভব হয়নি৷ শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, সর্বত্রই নৈরাজ্য৷ ভেবেছিলাম এক, হল আরেক৷ ত্রাণ নয়, এই সরকার থেকে পরিত্রাণ চাইছে বাংলার মানুষ৷ আমজনতা তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং উপলব্ধির দ্বারা বুঝেছেন, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রয়োজনীয়, কিন্ত্ত তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান আর শিক্ষা শেষে চাকরি৷ এই ব্যবস্থা করতে না পারলে, বাংলার সুদিন ফিরবে না৷ শিক্ষাক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর দুর্নীতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমরা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছি৷ ফলে নতুন ধরনের পরিবর্তনের অধীর অপেক্ষায় দিন গুণছে বাংলার মানুষ৷ যে ছ’সাতজন প্রধানমন্ত্রীকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, নিঃসন্দেহে বলতে পারি, মোদিজি তাঁদের মধ্যে প্রচণ্ড পরিশ্রমী৷ দেশের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস মোদিজির প্রতি বাড়ছে৷ শক্তিশালী ভারতবর্ষ উপহার দেওয়ার জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন৷ স্বনির্ভর হচ্ছে দেশ৷ প্রতিরক্ষা বাজেট দেশের আগের থেকে অনেক কমেছে৷’

সেই মোদি ম্যাজিকের উপর ভর করে বাংলায় অপ্রত্যাশিত ভালো ফল করবে বিজেপি৷ অবিভক্ত মেদিনীপুরের কাঁথি, তমলুক লোকসভা শুধু নয়, মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, ঘাটাল পাঁচটি আসনেই বিজেপি ভালো ফল করবে, এই ভালো ফলেই তৃণমূলের মাথাব্যথা বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে৷ জঙ্গলমহলের ন’টি আসনেও বেকায়দায় পড়তে হবে তৃণমূলকে৷ রাজ্যজুড়ে শাসক পরিবর্তনের দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে৷ উত্তর থেকে দক্ষিণ, পাহাড় থেকে জঙ্গলমহল সর্বত্রই শাসক বিরোধী কণ্ঠস্বর মাথাচাড়া দিচ্ছে৷ পরিবর্তনই সমাজের নিয়ম৷ কালের স্রোতে ভেসে যেতে হবে তৃণমূলকে৷ দিঘার সমুদ্র থেকে ৩৪.৬ কিলোমিটার দূরে শান্তিকুঞ্জের কুশীলবরা নতুন করে নিজেদের তৈরি করছেন পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করার জন্য৷ রাজনীতির মহাসমুদ্রে অধিকারী পরিবার সেই পরিবর্তনের স্রোতে শাসককে উৎখাত করতে একটি শিশির বিন্দুর ভূমিকায় নিজেদের দেখতে চায়৷