পৃথক উত্তরবঙ্গ রাজ্য: ইতিহাস ও বাস্তবতা

প্রবীর মজুমদার

একুশের বিধানসভা নির্বাচনের পর উত্তরবঙ্গ নাম দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু সংখ্যক জেলা নিয়ে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বা আলাদা রাজ্যের দাবি তুলেছিলেন মুখ্যত আলিপুরদুয়ারের সাংসদ বিজেপির জন বার্লা। সুচতুরভাবে এই দাবিকে সমর্থন করে কোচবিহারের বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামাণিকের অনুগামীরা ভার্চুয়ালি সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন বছর দুয়েক ধরে। জন বার্লার দাবি, নিশীথ অনুগামীদের প্রচার “ব্যক্তিগত মতামত” বলে চালাবার চেষ্টা করলেও এই দাবিতে দল হিসাবে বিজেপির প্রচ্ছন্ন মদত ছিল।
সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারেনি বিজেপি৷ এনডিএ শরিক দলগুলির সাহায্যে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে নরেন্দ্র মোদিকে৷

বাংলাতেও আশানুরূপ ফলাফল করতে পারেনি পদ্মশিবির৷ সংসদে কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করার পর থেকে উঠেছে বাংলাকে বঞ্চনা করার অভিযোগও৷ পাশাপাশি, এবার রাজ্য ভাগ না করেই উত্তরবঙ্গের আট জেলাকে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করেছেন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার৷ একাধিক ইস্যুতে বাংলাকে নতুনভাবে আক্রমণ করাই বিজেপির উদ্দেশ্য বলে দাবি করেছে তৃণমূল৷ সুকান্তের তরফে এই প্রস্তাব পেশের পরেই আবার গ্রেটার কোচবিহারের দাবিতে সরব হয়েছেন অনন্ত মহারাজ৷ কেন্দ্রের তরফে তাঁকে এই বিষয়ে মৌখিক আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে বলেও তাঁর দাবি৷ বিজেপি চক্রান্ত করে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বাংলাকে বিভক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ এমনই দাবি করেছেন তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব৷ এই কারণেই বিভিন্নভাবে বাংলাকে কোণঠাসা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের৷ করা হচ্ছে বাংলা ভাগের চক্রান্ত৷


২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই উত্তরবঙ্গ বলে চিহ্নিত অঞ্চলের রাজনীতি সচেতন প্রতিটি মানুষই জানতেন যে একুশের বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ক্ষমতা না পেলে, এই অঞ্চল নিয়ে আলাদা রাজ্যের তাস বিজেপি খেলবেই। সুতরাং বিজেপির এই উত্তরবঙ্গ নামে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বা রাজ্যের দাবি উসকে দেওয়া খুবই প্রত্যাশিত। মালদা থেকে দার্জিলিং অবধি যে ভূখণ্ড উত্তরবঙ্গ নামে চিহ্নিত সেখানকার রাজনৈতিক ইতিহাস খেয়াল করলেই দেখা যাবে বিচ্ছিন্নতার দাবি সেইখানে দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজকের সময় অবধি আলাদা রাজ্যের তিনটি দাবি রয়েছে।

প্রথম দাবি হল পুরো দার্জিলিং, কালিম্পং এবং আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ির খানিক অংশ নিয়ে গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি। গোর্খা পরিচিতি কোনো নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি নয়। প্রাথমিকভাবে দার্জিলিং পাহাড়ে ব্রিটিশদের চা-অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে নেপালের গোরখপুর থেকে আনা নেপালি, যাঁরা মূলত চা-শ্রমিক ও সৈনিক হিসাবে ব্যবহৃত হতেন, তাঁরাই গোর্খা। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই নেপালি, লিম্বু, রাই, লেপচা এই পৃথক কৃষ্টি-পরিচিতিগুলি একত্রিত হয়ে গোর্খা পরিচিতি গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। পৃথক রাজ্যের দাবিতে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই বারবার সহিংস আন্দোলন দেখেছে পাহাড়।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের স্বাধীনতার পর তৎকালীন রাজশাসনে থাকা পৃথক রাষ্ট্র কোচবিহারকে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হলে, কোচবিহারের সাধারণ মানুষের সংগঠন ‘হিতসাধনী সভা’ কোচবিহারি অস্মিতার পক্ষে সওয়াল করে কোচবিহারকে ভারতীয় ইউনিয়নে পৃথক রাজ্য হিসাবে যোগদানের দাবি জানায়। সেই দাবি মানা না গেলে কোচবিহারকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানায় এই সংগঠন, এবং তাও মানা সম্ভব না হলে কৃষ্টিগত নৈকট্যের জন্য পশ্চিমবঙ্গের বদলে অসমের সঙ্গে কোচবিহারকে সংযুক্ত করার প্রস্তাব দেয়। এই দাবিই পরবর্তীকালে ‘গ্রেটার কোচবিহার’ রাজ্যের দাবিতে পরিণত হয় এবং সেই দাবি এখনো রয়েছে। এটি দ্বিতীয় দাবি।

তৃতীয় দাবিটি কামতাপুর রাজ্যের দাবি। দেশভাগের আগেই ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে যোগেন মণ্ডল অধুনা বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুরের কিছু অংশ, স্বাধীন কোচবিহার, অসমের অন্তর্ভুক্ত গোয়ালপাড়া, বাংলার অন্তর্ভুক্ত জলপাইগুড়ি ও বিহারের অন্তর্ভুক্ত পূর্ণিয়া জেলার কিছু অংশ নিয়ে দলিত রাজবংশী অস্মিতাকে মর্যাদা দিয়ে ‘রাজস্থান’ নামে একটা পৃথক রাজ্যের প্রস্তাব দেন যেখানে অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত রংপুর, আংরাপোতা, দহগ্রাম, পাটগ্রামের নমঃশূদ্ররা, জলপাইগুড়ির মদেশীয়, মেচ, রাভা, টোটো, ওঁরাওরা, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারের ইসলাম ধর্মাবলম্বী রাজবংশী নস্য শেখরা একত্রে বসবাস করবে।

দলিতপ্রধান এই প্রস্তাবিত রাজ্যটি প্রকৃতপক্ষে দলিত পরিচিতির একটি কাঙ্খিত সনদের নিদর্শন, যেখানে দলিত পরিচিতি নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও ভাষা পরিচিতিকে অতিক্রম করে দলিত যোগসূত্রে গাঁথার পরিকল্পনা যোগেন মণ্ডলের ছিল। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের শুরু থেকে প্রাথমিকভাবে এই অঞ্চলের রাজবংশী মানুষের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করে উত্তরাখন্ড দল ও উত্তরবঙ্গ তপশীলি ও আদিবাসী ছাত্র সংগঠন। এঁরা সরকারি চাকরিতে এই অঞ্চলের রাজবংশী, মদেশীয়, রাভা, মেচ, টোটো, গোর্খা এই জাতিদের সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্ব দাবি করেন, বাঙালি বর্ণহিন্দুর দ্বারা এই অঞ্চলের দলিত ও আদিবাসী ছাত্রছাত্রীর উপর ঘটা বর্ণবৈষম্যের বিচার চান, বাংলার পরিবর্তে রাজবংশী, সাদ্রী, রাভা, ওঁরাও ইত্যাদি ভাষায় স্কুলস্তরে পাঠদান দাবি করেন।

এই সংগঠনগুলি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি জানায়। এই অঞ্চলের রাজবংশীদের সঙ্গে কোচবিহারি পরিচিতি প্রায় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে যাওয়ায় বাকি জনজাতিগুলি আন্দোলন থেকে সরে আসতে পারে, এই আশঙ্কা থেকেই কামতাপুর পরিচিতির জন্ম। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে উপরোক্ত সংগঠনগুলি কামতাপুর পিপলস পার্টি নাম নিয়ে একটি ছাতার তলায় আসে। ষোড়শ শতাব্দীতে কোচবিহার রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে কামতাপুর নামে যে রাজ্য ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীর থেকে হিমালয়ের তরাই-ডুয়ার্স অবধি বিস্তৃত ছিল বলে কথিত রয়েছে, যে রাজ্যের পতন বাংলার সুলতান হুসেন শাহের হাতে হয় বলে কথিত, সেই খানিক ঐতিহাসিক ও খানিক শ্রুতিনির্ভর আখ্যানের উপর ভর করে কামতাপুরি পরিচিতির জন্ম দেওয়া হয়।

রাজবংশী, মেচ, খেন, রাভা, কৈবর্ত — সকলেই কামতাপুরি নামক বৃহত্তর জাতি পরিচিতির অন্তর্ভুক্ত। যোগেন মণ্ডলের প্রস্তাবিত রাজ্যের মডেলেই উত্তরবঙ্গের সমস্ত জেলা এবং অসমের গোয়ালপাড়া নিয়ে একটি পৃথক কামতাপুর রাজ্যের দাবি কামতাপুর পিপলস পার্টি তখন থেকেই করে আসছে। এই দাবি অনুযায়ী এই অঞ্চলে বাঙালি সংস্কৃতির আগ্রাসন হেতু কামতাপুরি সংস্কৃতি বিপন্ন, বাঙালি উদ্বাস্ত হেতু কামতাপুরিদের জমি ও অর্থনীতি বিপন্ন, এই অঞ্চলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোনো ধরণের উন্নয়নমূলক কাজ করে না দশকের পর দশক। ভূমিপুত্রকন্যাদের অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য এবং এই অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য এই অঞ্চলকে পৃথক রাজ্যে পরিণত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই তিনটি দাবির একটিও ধর্মকে পরিচিতির সূচক হিসাবে ধরেনি। এই তিনটি দাবির কোথাও ‘বঙ্গ’ শব্দটি নেই।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে লক্ষ করার মতো বিষয় হল এই তিনটি আলাদা রাজ্যের দাবিতে এই অঞ্চলে বসবাসকারী আরো দুইটি প্রধান জনজাতির কোনো অংশীদারি নেই: মদেশীয় ও বাঙালি, যারা নদীর নিম্নগতির অঞ্চলের মানুষ হওয়ায় ‘ভাটিয়া’ নামে পরিচিত এই অঞ্চলে। এই ভাটিয়াদের সিংহভাগ পূর্ব পাকিস্তান, অসম ও বাংলাদেশ থেকে প্রাণের ভয়ে, জমি হারিয়ে চলে আসা নমঃশূদ্র উদ্বাস্তু। ভৌগোলিকভাবে এদের অধিকাংশই অধুনা বাংলাদেশের উত্তর দিকের অংশ থেকে এসেছিলেন। ফলত সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবে এরা যোগেন মণ্ডল প্রস্তাবিত অঞ্চলটিরই বাসিন্দা। এঁদের একাংশ আবার দুইবারের উদ্বাস্তু। প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুসলিমদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে অসমে বসবাস করেন পাঁচ-দশ বছর, তারপর ছয়ের , সাতের ও আটের দশকে অসমের হিন্দুদের দ্বারা পুনরায় বিতাড়িত হয়ে এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন।

উল্লেখ করার মতো বিষয়টি হল, পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বা আলাদা রাজ্য দাবি করেছিলেন বিজেপির যে দুই নেতা, জন বার্লা ও নিশীথ প্রামাণিক, তাঁরা যথাক্রমে মদেশীয় ও ভাটিয়া নমঃশূদ্র, যাঁরা কেউ এই অঞ্চলের ভূমিপুত্র নন। আরো মজার ব্যাপার এই, যে উপরোক্ত তিনটি দাবির প্রত্যেকটিতেই ‘বঙ্গ’ জনিত আগ্রাসনের জন্যই বিচ্ছিন্নতার দাবি উঠেছে, অথচ বার্লা ও নিশীথের দাবির নাম দেওয়া হল উত্তরবঙ্গ, যা নিজের নাম দিয়েই স্বীকার করতে চাইছে যে এটি ঐতিহাসিকভাবে বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাহলে এই নাম নিয়ে বিচ্ছিন্ন হতে চাওয়ার বীজ বোনা হল কীভাবে?

উত্তরবঙ্গ নামে যদি কোনো আলাদা রাজ্য কোনোদিন হয়, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব অবশ্যই পাবে কলকাতাকেন্দ্রিক আমলাতন্ত্র। কলকাতাকেন্দ্রিক আমলাতন্ত্রের জন্যই উত্তরবঙ্গ নামে একটি কাল্পনিক অঞ্চল গঠিত হয়েছে। মালদা থেকে শুরু করে দার্জিলিং অবধি অঞ্চলকে একই বন্ধনীতে দেখার প্রবণতা, পূর্বতন জলপাইগুড়ি ডিভিশন নামক একটি আমলাতান্ত্রিক অঞ্চলকে উত্তরবঙ্গ নামে চিহ্নিত করা এবং শুধুই শাস্তিমূলক বদলির জায়গা হিসাবেই এই অঞ্চলকে দেখে যাওয়ার প্রবণতা আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে উত্তরবঙ্গ নামক বিচ্ছিন্নতার বীজতলা। সাতাত্তর বছর ধরে চলতে থাকা বাঙালি বর্ণহিন্দু আধিপত্য প্রধান কলকাতা-উপনিবেশবাদ উত্তরবঙ্গ নামক বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিয়েছে। এই বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিয়ে এই সময়ে বিজেপি নির্মিত স্লোগান “উত্তরবঙ্গ আলাদা রাজ্য চাই” একই সঙ্গে আগ্রহব্যঞ্জক এবং তার চেয়েও বেশি ভঙ্গুর।

গোর্খাল্যান্ড, গ্রেটার কোচবিহার, কামতাপুর — এই তিনটি দাবির মূল সুরই হল বাঙালি কৃষ্টির থেকে পৃথক সত্তা এবং ভূমিপুত্রকন্যাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রাধিকার সুনিশ্চিত করা। তিনটি দাবিই যে ভৌগোলিক অঞ্চলগুলিকে নিজ সীমানার ভিতর রাখতে চায় তা হল তরাই ও ডুয়ার্স। যদি জনসংখ্যার বিন্যাসে ভিন্ন ভিন্ন জাতিসত্তার সহাবস্থানের দিকে আমরা খেয়াল করি তাহলে মালদা, উত্তর দিনাজপুরের সমভূমি মূলত বাঙালি কৃষ্টির, কোচবিহার, দক্ষিণ দিনাজপুর সমভূমি মূলত রাজবংশী বা কামতাপুরি কৃষ্টির, পার্বত্য দার্জিলিং ও কালিম্পং গোর্খা কৃষ্টির। এই সমস্ত ভৌগোলিক অঞ্চল যে ভৌগোলিক অঞ্চলে এসে মিশছে তা হল তরাই ও ডুয়ার্স।

আজকের সময়ের প্রেক্ষিতে এই অঞ্চল মোটামুটিভাবে বিধাননগর-বাগডোগরা-নকশালবাড়ি থেকে শুরু করে শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি-মালবাজার-আলিপুরদুয়ার অবধি বিস্তৃত। এই অংশের কৃষ্টি, জনসংখ্যায় বিবিধ জাতিসত্তার অনুপাত, ভাষা- কোনোটিই একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতির প্রাধান্য সূচিত করে না। তিনটি দাবিই তাই এই অঞ্চলকে নিজেদের বলে দাবি করে। এই অঞ্চলের ভূমিপুত্রকন্যাদের বঞ্চনার কথা বারংবার সামনে এনে বিচ্ছিন্নতার দাবিকে যৌক্তিক বলা হয়। সুচতুরভাবে রাজবংশী জোতদারদের হাতে রাজবংশী কৃষকের নিপীড়নের ইতিহাস বিচ্ছিন্নতার দাবি তোলার সময় ভুলে যাওয়া হয়। গোটা ব্যাপারটিকে দাঁড় করাতে চাওয়া হয় বাঙালি উদ্বাস্তু দ্বারা নিপীড়নের ফলে ভূমিপুত্রকন্যাদের প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতর হয়ে চলার ইতিহাস হিসাবে।

এই ভূমির ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখা যায় যে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি চা-বাগান পত্তনের আগে তরাই ও ডুয়ার্স কখনো সিকিমের, কখনো ভুটানের, কখনো নেপালের, কখনো কোচবিহারের, আবার কখনো কথিত কামতাপুর রাজ্যের ছিল। সুতরাং যে ভূমি বারংবার রাজনৈতিকভাবে এক হাত থেকে অন্য হাতে গেছে, সেই অঞ্চলের ভূমিপুত্রকন্যা ব্যাপারটি অনেকাংশেই একটি নির্মাণবিশেষ। তরাই ও ডুয়ার্সের ভূমিপুত্রকন্যার ধারণা নির্মাণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে এখানকার অর্থনীতি বিকাশে বিবিধ জনজাতির ভূমিকা।

এই অঞ্চলেরই ঐতিহাসিকভাবে ‘বহিরাগত’ মদেশীয় জনজাতির মানুষ। চা-বাগান পত্তনের সময় যাদের ছোটনাগপুর ও ছত্তিশগড় থেকে জোর করে তুলে এনেছিল ইংরেজরা। এই অঞ্চলের অর্থনীতির বিকাশে মদেশীয়দের ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে আজকে এই অঞ্চলের প্রেক্ষিতে মদেশীয়রা ভূমিপুত্রকন্যা। একই কথা প্রযোজ্য গোর্খাদের ক্ষেত্রেও। মজার ব্যাপার এই যে জন বার্লা গোর্খা, বিহারি, মাড়োয়ারি কাউকে এই অঞ্চলের ‘বহিরাগত’ বলে দেগে দেননি, তিনি সুনির্দিষ্টভাবে ‘বাংলাদেশি’ শব্দটি ব্যবহার করে বাঙালি উদ্বাস্তুদেরই চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।

১৯৬০-এর আগে এই অঞ্চলের তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা অববাহিকার গ্রামগুলির বিন্যাস ও এখনকার গ্রামগুলির বিন্যাস দেখলে কিছু লক্ষণীয় পরিবর্তন চোখে পড়ে। ধানি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, আলু চাষের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, বিবিধ তরিতরকারী চাষের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, ছোটো চা বাগানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, পেয়ারা-আনারস-কাঁঠাল বাগানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া। প্রতিটি ক্ষেত্র সূচিত করে এই অঞ্চলে উদ্বাস্তু বাঙালি ভাটিয়াদের শ্রম। এই শ্রমের অর্থনৈতিক অবদান অনস্বীকার্য। আবার চাষের জমির জন্য এই অঞ্চলে বিবাদও গত পঞ্চাশ–ষাট বছর ধরে হয়েই আসছে। স্বাভাবিকভাবেই চাষের জমির দখলদারিতে সংঘর্ষ হয়েছে মূলত ভাটিয়া ও রাজবংশীদের ভিতর, কারণ ধানি জমিতে স্বার্থ এই দুই গোষ্ঠীর যতটা ছিল, গোর্খা, মদেশীয়দের ততটা ছিল না । ফলত পারস্পরিক অবিশ্বাস ও হিংসা রাজবংশী ও ভাটিয়া গোষ্ঠীর মধ্যে অনেক বেশি প্রবল।

বিজেপির একাংশ যতই উত্তরবঙ্গকে ভাগাভাগি করার কথা বলুক না কেন, এখানে বেশ কিছু বাধা রয়েছে । প্রথমত পশ্চিমবঙ্গ কখনোই খুব একটা বড় রাজ্য নয় । পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক বড় রাজ্য ভেঙে ছোট করা হয়নি । তাহলে শুধু পশ্চিমবঙ্গকেই কেন ভাঙা হবে ? এই সাধারণ প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে । আর তাছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই বা এত সহজে ছেড়ে দেবেন কেন ? এমন কোনও সম্ভাবনা তৈরি হলে কড়া প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । আর সেক্ষেত্রে রাজ্যে হিংসার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে । তার উপর বাঙালির অখণ্ড বঙ্গের সেন্টিমেন্টটাও মমতা পেয়ে যাবেন । এমনটা হলে আখেরে বিজেপিরই ক্ষতি ।

রাজ্য রাজনীতিকে যাঁরা খুব কাছে থেকে দেখেছেন, তাঁদের মতে, আরও একটি বড় বাধা থাকছে কেন্দ্রের সামনে । কেন্দ্র কখনও এমনটা বলতে পারে না যে, উত্তরবঙ্গে আমরা বেশি আসন জিতেছি, তাই ওটা আলাদা রাজ্য করে আমাদের সরকার গঠন করা হবে । সেখানে কেন্দ্রকে বাংলা ভাগের জন্য শক্তপোক্ত কোনও একটা কারণ দেখাতে হবে । মানে ওই প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক – এই ধরনের কোনও একটা মজবুত কারণ । কিন্তু গোর্খাল্যান্ড বা কামতাপুর বা গ্রেটার কোচবিহার… প্রতিটি ক্ষেত্রেই পৃথক পৃথক দাবিদাওয়া রয়েছে । পৃথক কারণ রয়েছে । সেই সবক’টি একসঙ্গে করতে গেলে কেউ না কেউ বঞ্চিত হবে । আর যে বা যারা বঞ্চিত হবে, সঙ্গে সঙ্গে ফোঁস করে উঠবে ।

সুতরাং, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা মোদির সরকার বিষয়টিকে নিয়ে খুব একটা নাড়াচাড়া করবে না বলেই মনে করছেন অনেকে । কারণ এটা বুমেরাং হয়ে বিজেপির দিকে ফিরে আসার সম্ভাবনাই বেশি । তাঁদের মতে, বরং যে চাপা-উত্তেজনাটি তৈরি হয়েছে, বিজেপি এটিকে এভাবেই লালিত-পালিত করে যাবে আরও অনেকদিন ধরে। হয়ত পরের নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক বাড়াতে এটাকেই হাতিয়ার করবে । কিন্তু কোনও স্থায়ী সমাধানের দিকে হয়ত বিজেপি এগোবে না।