দিল্লি: বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যের পর ইন্ডিয়ান ওভারসিজ কংগ্রেসের চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দিলেন স্যাম পিত্রোদা। গত ‘দ্য স্টেটসম্যান’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভারতীয়দের চেহারা নিয়ে মন্তব্যের জেরে বিতর্কে জড়ান পিত্রোদা। লোকসভা ভোট চলাকালীন তাঁর এই বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যকে হাতিয়ার করে কংগ্রেস ও রাহুল গান্ধীকে আক্রমণ করেন বিজেপি নেতারা। কংগ্রেস পিত্রোদার এই মন্তব্য থেকে দূরত্ব বজায় রাখলেও ঘরে বাইরে চাপের মুখে পড়ে যান রাহুল গান্ধীর মেন্টর। বাধ্য হয়ে গতকাল বুধবার আমেরিকাবাসী কংগ্রেসের আন্তর্জাতিক নেতা ইন্ডিয়ান ওভারসিজ কংগ্রেসের চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন।
প্রসঙ্গত পিত্রোদার পদত্যাগের পর কংগ্রেসের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করে বলেন যে,”স্যাম পিত্রোদা ইন্ডিয়ান ওভারসিজ কংগ্রেসের চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। কংগ্রেস সভাপতি তাঁর সেই পদত্যাগ গ্রহণ করেছে।
সম্প্রতি স্যাম পিত্রোদা ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এর প্রতিনিধি সন্তু দাসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতীয়দের গাত্রবর্ণ ও চেহারা নিয়ে মন্তব্য করেন। তিনি ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য বোঝাতেই এই মন্তব্য করেন। সেই মন্তব্যকে হাতিয়ার করে বিপরীতভাবে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি। পিত্রোদা এদিন বলেন,’আমরা ইতস্তত কিছু সংগ্রাম ছাড়া গত ৭৫ ধরে একটি মনোরম পরিবেশে বাস করছি। আমরা দেশের নানা বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য রেখে চলেছি। যেখানে দেশের পূর্ব অঞ্চলের মানুষকে চীনাদের মতো দেখতে, উত্তরের মানুষগুলোকে শ্বেতাঙ্গদের মতো দেখতে, পশ্চিমের মানুষগুলোকে আরাবীয়দের মতো দেখতে এবং দক্ষিণের বাসিন্দাদের আফ্রিকানদের মতো দেখতে। এটা কোনও ব্যাপারই নয়। আমরা সবাই ভাই বোনের মতো।”
ভারতীয়দের চেহারা ও গায়ের রং চীনা ও আফ্রিকানদের সঙ্গে তুলনা করায় বিতর্ক দানা বাঁধে। লোকসভা ভোট চলাকালীন স্যাম পিত্রোদার সেই বিতর্ক দেশে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক ঝড় তোলে। বিজেপির জাতীয় কমিটির মুখপাত্র শেহজাদ পুনাওয়ালা থেকে শুরু করে একের পর এক নেতারা পিত্রোদার মন্তব্যকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস ও রাহুল গান্ধীকে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করেন। এমনকি বিষয়টি নিয়ে মাঠে নামেন স্বয়ং মোদী। তিনি বুধবার তেলঙ্গানার ওয়ারঙ্গলে বিজেপির ভোটপ্রচারে যান প্রধানমন্ত্রী। সেখানে মোদী বলেন, ‘‘কংগ্রেসের শাহজাদার পরামর্শদাতা গাত্রবর্ণ তুলে ভারতবাসীকে আক্রমণ করেছেন। আমি ক্রুদ্ধ। আমাকে আপনারা অনেক কটু কথা বলেছেন। আমি কিছু মনে করিনি। কিন্তু আমার দেশের মানুষকে আক্রমণ করলে সহ্য করব না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমাদের গায়ের রং যা-ই হোক না কেন, আমরা সকলেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পুজো করি।’’
‘শাহজাদাকে এর জবাব দিতে হবে। দেশের মানুষ গাত্রবর্ণ নিয়ে অপমান বরদাস্ত করবে না।’ এপ্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের প্রসঙ্গও টেনে আনেন প্রধানমন্ত্রী। মোদি কংগ্রেসকে কটাক্ষ করে বলেন, ‘এখন বুঝতে পারছি, রাষ্ট্রপতি ভোটে দ্রৌপদী মুর্মুকে প্রার্থী করার বিরোধিতা কংগ্রেস কেন করেছিল। শাহজাদার এক কাকা থাকেন আমেরিকায়। সেই কাকা বলেছেন, যাঁদের ত্বক কৃষ্ণবর্ণের, তাঁরা আফ্রিকার লোক। এখন বুঝতে পারছি, ওরা রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে আফ্রিকান ভেবেছিল। সেজন্য গায়ের রং কালো বলে তাঁকে হারাতে চেয়েছিল।’ পিত্রোদার এই মন্তব্যে তিনি বেজায় ক্ষুব্ধ বলেও দাবি করেন মোদি। এপ্রসঙ্গে কর্ণাটক ও তেলেঙ্গানার কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এবং ডিএমকে’কেও একহাত নিয়েছেন। মোদী চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেন, এধরনের মন্তব্যের প্রতিবাদে এমকে স্ট্যালিন কি কংগ্রেসের সঙ্গ ছাড়তে পারবেন?
এর প্রতিক্রিয়ায় ডিএমকে পিত্রোদার মন্তব্যকে গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করলেও মোদিকে পাল্টা জবাব দিতে ছাড়েনি তারা। স্ট্যালিনের দল বলে, অতীতে এক বিজেপি সাংসদ যখন এই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন, তখন মোদী মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন।
এক্স হ্যান্ডলে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংও পিত্রোদার মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁরা এই মন্তব্যকে বর্ণবিদ্বেষী বলে অভিহিত করেন। এক্স হ্যান্ডেলে হিমন্ত বিশ্বশর্মা পোস্ট করে বলেন,”শ্যাম ভাই, আমি একজন উত্তর-পূর্ব ভারতের বাসিন্দা এবং আমি একজন ভারতীয়দের মতোই দেখতে। আমাদের বৈচিত্রময় দেশ। আমরা দেখতে বিভিন্নরকম। কিন্তু আমরা সবাই এক। আমাদের দেশ সম্পর্কে এই ছোট্ট বিষয়টা অনুধাবন করুন।” এদিকে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন একইভাবে এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘আমি দক্ষিণ ভারতের। আমাকে দেখতে ভারতীয়দের মতো।’
প্রধানমন্ত্রীকে পাল্টা জবাব দেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও। তিনি বলেন, অহেতুক বিষয় ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী বরং চাকরি-বাকরি, মুদ্রাস্ফীতি ও মহিলাদের উপর নির্যাতনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলুন।
যদিও এতে বিজেপির আক্রমণ থামেনি। বিজেপির মুখপাত্র শেহজাদ পুনাওয়ালা বলেন,”এটাই ভারতীয়দের সম্পর্কে রাহুল গান্ধীর কথা এবং চিন্তাভাবনা। কারণ, আজকাল রাহুল গান্ধীও বিভাজনের রাজনীতি করছেন। এর আগে তাঁরা বর্ণ ও ভাষার ভিত্তিতে বিভাজন করেছেন। এখন তাঁরা ভারতীয়দের মধ্যে বিভাজন করছেন।”
এদিন বিজেপি মুখপাত্র প্রশ্ন করেন, “ভারতীয়দের চীনাদের মতো দেখতে মন্তব্য করাটা কি বর্ণবৈষম্যমূলক মন্তব্য নয়? এটা কি অপমানজনক নয়?”
পুনাওয়ালা আরও বলেন,”ভারতীয়রা দেখতে আফ্রিকানদের মতো। এই মন্তব্য করাটা কি তাঁদেরকে অপমান করা নয়? ” তিনি ব্যাখ্যা করেন, এই মন্তব্যের মাধ্যমে এটাই প্রমাণ করে যে, কংগ্রেসের “মহব্বত কি দুকান”-এ আসলে “নফরত কা সামান” আছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে কংগ্রেসের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করেছেন। এবং পিত্রোদাকে দল থেকে বহিষ্কারের আওয়াজ তুলেছেন। পুনাওয়ালা বলেন,” যতক্ষণ না কংগ্রেস বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা না দিচ্ছে এবং পিত্রোদাকে দল থেকে বহিষ্কার করছে, ততক্ষণ এটাই কংগ্রেসের উক্তি বলে ধরে নেওয়া হবে।”
যদিও কংগ্রেসের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এক্স হ্যান্ডেলে বলেন, পিত্রোদার মন্তব্যের সঙ্গে কংগ্রেস বিন্দুমাত্রও সহমত নয়। তবুও শেষ রক্ষা হল না। শেষমেশ পিত্রোদাকে কংগ্রেসের পদ থেকে ইস্তফা দিতে হল।