জালিয়াতির জালে সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক

পার্থপ্রতিম সেন: ভিয়েতনামের সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কে প্রতারনার জাল বিস্তার করে কিভাবে এক নারী কোটি কোটি ডলারের জালিয়াতি করে ব্যাঙ্ক পতনের রাস্তা সুগম করেছেন, সেই গল্পই আজ বলব৷ তবে সেটা গল্প হলেও সত্যি৷ ভিয়েতনাম দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় কমিউনিস্ট একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় শাসিত একটি দেশ৷ ভিয়েতনামের উত্তরে চীন এবং পশ্চিমে লাওস ও কম্বোডিয়া অবস্থিত৷ ভিয়েতনামের দক্ষিণ ও পূর্বদিকে সাগর৷ ভিয়েতনাম থাইল্যান্ডের সাথে থাইল্যান্ডের উপসাগর এবং দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্য দিয়ে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ায় সাথে সামুদ্রিক সীমানা ভাগ করে নিয়েছে৷ ভিয়েতনামের জনসংখ্যা প্রায় দশকোটি৷ ভিয়েতনাম বলতে মনে পডে় কমিউনিস্ট নেতা হো চি মিন-এর কথা, মনে পডে় ভিয়েতনামী-দের মার্কিন সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা৷ ১৯৪৫ সালে হো চি মিন-এর নেতৃত্বে ভিয়েতনামে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়৷ ১৯৫৪ সালে ফরাসীদের ‘দিয়েন বিয়েন ফু’ যুদ্ধে পরাস্ত করে ভিয়েতনামের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র চূড়ান্ত জয়লাভ করে৷ তারপর ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা আমেরিকানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে উত্তর ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের সংযুক্তিকরণ হয়৷ দুই ভিয়েতনাম একত্রিত হবার পর ১৯৭৬ সালে উত্তর ভিয়েতনাম ধীরে ধীরে তার পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুরো ভিয়েতনামের মধ্যে চালু করে৷ অর্থনীতিতে কিছুটা অচলাবস্থা আসার ফলে ১৯৮৬ সালে কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার প্রবর্তন করে ভিয়েতনামে একটি মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করা হয়৷ তারফলে দেশে আর্থিক বৃদ্ধির গতি বেডে় যায়৷ ভিয়েতনামের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার দিকে নজর দিলে দেখা যায় ১৯৭৬ সাল থেকে ভিয়েতনামের ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ‘স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ভিয়েতনাম’ নাম নিয়ে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের দায়িত্ব পালন করা শুরু করে৷ ভিয়েতনামে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাঙ্কগুলির মধ্যে আছে ‘ব্যাঙ্ক ফর ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড ট্রেড (ভিয়েটিনব্যাঙ্ক)’ যা শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে ঋণ প্রদান করে, ‘ব্যাঙ্ক ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট’ যা কৃষিক্ষেত্রে ঋণ প্রদান করে৷ তাছাড়া অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়ার জন্য আছে আরও অন্যান্য ব্যাঙ্ক৷ ১৯৮৬ সাল থেকে অর্থনীতি ক্ষেত্রে খোলা হাওয়ায় ভিয়েতনামের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন, যৌথ-স্টক, যৌথ-উদ্যোগ এবং বিদেশি ব্যাঙ্কগুলির সংমিশ্রণ ঘটেছে৷ তবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাঙ্কগুলিতে অনাদায়ী ঋণ বা NPA বেশি হওয়ায় সরকারকে ব্যাঙ্কগুলিতে সময় সময় পুঁজি ঢালতে হয়েছে৷

এবার আসি সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক ও সেই নারী ট্রুং মাই ল্যান-এর কথায়৷ আজকের ৬৭ বছর বয়সী ট্রুং মাই ল্যান কৈশোর ও যৌবনকালে নিজের মায়ের সাথে রাস্তায় প্রসাধনী এবং অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রি করতেন৷ ১৯৮৬ সালে দেশে যখন অর্থনৈতিক সংস্কার বা ভিয়েতনামী ভাষায় ‘দোই মোই’ শুরু হল, তখনই ট্রুং মাই ল্যান-এর ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করল৷ ভিয়েতনামী ভাষায় ‘দোই মোই’-এর অর্থ হল ‘উদ্ভাবন করা’ বা ‘সংস্কার করা’৷ ‘দোই মোই’ পলিসি প্রকৃতপক্ষে ভিয়েতনামের আদেশযুক্ত অর্থনীতিকে সমাজতন্ত্র ভিত্তিযুক্ত বাজার অর্থনীতিতে পরিবর্তিত করল৷ সেই সময় সোভিয়েত রাশিয়াতেও মিখাইল গর্বাচেভ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রৈকা শুরু করেছিলেন৷ ভারতে ১৯৯১ সালে শুরু হয়েছিল লিবারেলাইজেসন, প্রাইভেটাইজেশন এবং গ্লোবেলাইজেশন নামক অর্থনৈতিক সংস্কার৷

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে এই খোলামেলা অর্থনীতির পরিবেশে দেশের শিল্পপতি, ব্যবসায়ীরা অনেকেই প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছেন৷ ট্রুং মাই ল্যানও ভিয়েতনামে এই খোলামেলা অর্থনীতির সুযোগ নিয়েছিলেন৷ ১৯৯০-এর দশকে তিনি একটি বড় হোটেল ও রেস্তোরাঁর মালিক হন৷ সেইসময় তিনি হংকংয়ের বিনিয়োগকারী এরিক চু ন্যাপ-কির সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন৷ তারপর তাঁর ব্যবসা ও ধনসম্পত্তি আরো বাড়তে থাকে৷ অন্যান্য ধনী ব্যক্তির মতোই ট্রুং মাই ল্যান জমি ও আবাসন ব্যবসার মাধ্যমে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে লাগলেন৷ রাষ্ট্রীয় বড় কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জমিও ব্যবহারের সুবিধা নিতে শুরু করেন৷ তাঁর প্রতিষ্ঠিত “ভ্যান থিন ফ্যাট কোম্পানি” ভিয়েতনামের অন্যতম ধনী রিয়েল এস্টেট ফার্মে পরিণত হয় যার বিলাসবহুল আবাসিক ভবন, অফিস, হোটেল এবং শপিং মল-এর মতো প্রকল্প তৈরি করার অভিজ্ঞতা যেমন রয়েছে, তেমনি সে ধরণের প্রপার্টির মালিকানাও আছে৷


এখন আসি ভিয়েতনামের সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের কথায় যে ব্যাঙ্কে একজন সিনো-ভিয়েতনামী নারীর প্রতারণার জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ একটি আর্থিক ও ব্যাঙ্ক জালিয়াতি সংগটিত হয়েছে এবং সেটাও কিনা একটি কমিউনিস্ট দেশে! ২০১১ সালে ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটিতে ছোট ছোট তিনটি ব্যাঙ্ক মিলে একটি নতুন ব্যাঙ্কের জন্ম হয়৷ ব্যাঙ্কটির নাম হয় ‘সাইগন জয়েন্ট স্টক কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক’ বা সংক্ষেপে ‘সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক’৷ ট্রুং মাই ল্যান ততদিনে রিয়াল এস্টেটের ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন, সঙ্গে আছেন তাঁর ব্যবসায়ী স্বামী৷ তাছাড়া গত কুডি় বছর এই রিয়েল এস্টেট ব্যবসার প্রাঙ্গণে বিচরণের ফলে ট্রুং মাই ল্যানের পরিচয় হয়েছে অনেক ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের সাথে, তার সঙ্গে আছে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং উচ্চাশা৷ সবমিলিয়ে সুযোগ পেলেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি৷ অর্থের পিছনে এই বল্গাহীন দৌঁডে় একসময় নিয়মনীতি বিসর্জন করে এগিয়ে যেতে হয়৷ ঠিক সেইভাবেই ট্রুং মাই ল্যানের টার্গেট হয়েছিল সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক৷ নিজের নামে, নিজের গ্রুপের বিভিন্ন কোম্পানির নামে, ছোট ছোট কোম্পানি তৈরি করে তাঁদের নামে সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের শেয়ার কিনে ট্রুং মাই ল্যান ব্যাঙ্কটির নব্বই শতাংশের উপর মালিকানা নিজের হাতে নিয়ে আসেন যদিও ভিয়েতনামে ব্যাঙ্কিং-এর বিধিনিয়ম অনুযায়ী যেকোনো ব্যাঙ্কের শেয়ার বা মালিকানা কোন এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ৫ শতাংশের বেশি হতে পারেনা৷” শীর্ষ বৈশ্বিক অডিট সংস্থা আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং, কেপিএমজি এবং ডেলয়েট তাদের সম্পদের দিক থেকে ভিয়েতনামের বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক ‘সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক’-এর অডিটে ব্যাঙ্কের বিষয়ে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেনি”, সাউথ চায়না মর্ণিং পোস্ট এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে৷

উল্লেখ্য তিনটি ব্যাঙ্কের মিলনে সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের সৃষ্টিতে ভিয়েতনামের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের অনুমোদন ছিল এবং ট্রুং মাই ল্যান-এর ব্যাঙ্কের শেয়ার ও ঋণ কুক্ষিগত করার ব্যাপারটা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের অবগত ছিল৷

তবে ট্রুং মাই ল্যান ছলনাময়ীর রূপ ধরে সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক ও কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সহ পুরো ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে অসদুপায়ে ম্যানেজ করেছেন৷ এই ঘটনা থেকে একটি ব্যাপার স্পষ্ট হল যে কমিউনিস্টদের দ্বারা শাসিত দেশেও এই ধরণের বড় মাপের জালিয়াতি হয়৷ অর্থাৎ বলা যায় মানুষের লোভী মন দেশ, আদর্শ ও মতবাদ নিরপেক্ষ৷ সব দেশে, সব জায়গায় দুর্নীতি হয়৷ নীতি আদর্শ মানুষের লোভী মনকে বদলাতে বা দমন করতে পারেনা, সেটাই হয়তো পরম সত্য৷ ব্যাঙ্কের নব্বই শতাংশের উপর মালিকানা নিয়েও সন্ত্তষ্ট থাকতে পারেননি ট্রুং মাই ল্যান৷ তারপর তিনি তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন ব্যাঙ্ক থেকে কতবেশি ঋণ বের করতে পারেন, সেইদিকে৷ শুনলে আশ্চর্য হবার মতো ঘটনা যে ২০১২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক ট্রুং মাই ল্যানের মূল কোম্পানি ‘ভ্যান থিন ফ্যাট’ সহ তাঁর সৃষ্ট অন্যান্য ভুতুডে় কোম্পানিদের ২৫০০ টি ঋণ প্রদান করেছিল যার মূল্য ছিল চুয়াল্লিশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা কিনা সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের লোন পোর্টফোলিও-এর ৯৩ শতাংশ৷ সত্যি ভাবা যায়না ভিয়েতনামের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক (স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ভিয়েতনাম) ও গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের নাকের ডগার উপর দিয়ে কিভাবে এতবড় মাপের দুর্নীতি দশবছর কাল ব্যাপী সংগটিত হল! রাষ্ট্রীয় মিডিয়া আউটলেট VnExpress জানিয়েছে যে ল্যানের বিরুদ্ধে ঘুষ, ব্যাঙ্কিং নিয়ম লঙ্ঘন ও আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে৷ ট্রুং মাই ল্যান যখন সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কে ঋণের আবেদন করতেন, তখন তাঁর ঋণের আবেদন এবং আনুষঙ্গিক কাগজপত্র ভালো করে খতিয়ে দেখা হত না৷ তার জন্য তিনি বড় অঙ্কের ঘুষ দিয়ে ব্যাঙ্কের কর্মকর্তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতেন৷ এ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হলেন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সাবেক প্রধান পরিদর্শক৷ বর্তমানে তিনি ৫০ লক্ষ ডলার ঘুষ নেওয়ার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পেয়েছেন৷

নিজের অনুকূলে ব্যাঙ্কের শেয়ার কুক্ষিগত করা ও ব্যাঙ্ক থেকে বিশাল পরিমাণ ঋণ নেওয়া ছাড়াও ট্রুং মাই ল্যান ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তিনবছরের মধ্যে তাঁর গাডি়চালককে দিয়ে ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার (১০৮ ট্রিলিয়ন ভিয়েতনামী ডং) তুলে তাঁর বিল্ডিং-এর বেসমেন্টে রেখেছিলেন৷ এত পরিমাণ ব্যাঙ্ক নোটের ওজন ছিল দু’টন৷ এ যেন ব্যাঙ্ককে দেউলিয়া করার এক ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিত প্রচেষ্টা!

কয়েক বছর ধরে তদন্ত চালানোর পর ২০২২ সালের ৬ অক্টোবর অবৈধভাবে বন্ড ইসু্য করা এবং সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক থেকে ১২.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ জালিয়াতি করার জন্য ট্রুং মাই ল্যানকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ তাঁর গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গে সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের অনেক আমানতকারীরা ব্যাঙ্কে তাঁদের জমা অর্থ তোলার জন্য একসাথে আবেদন করে ফলে ব্যাঙ্ক পতনের সম্মুখীন হয়৷ সেইসময় ব্যাঙ্কের কয়েকজন কর্মীও আত্মহত্যা করে৷ ২০২৪ সালের ৫ মার্চ থেকে ট্রুং মাই ল্যান-এর বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলার শুনানি শুরু হয় হো চি মিন শহরের পিপলস কোর্টে৷ এই ব্যাঙ্ক দুর্নীতিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি সবচেয়ে বড় স্ক্যান্ডাল হিসেবে গণ্য করা হয়েছে৷ এই মামলায় আরো ৮২ জন অভিযুক্ত ছিলেন যার মধ্যে সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের ছিলেন ৪৫ জন, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ভিয়েতনামের (ভিয়েতনামের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক) ১৫ জন, ৩ জন সরকারি ইন্সপেক্টর, সরকারি অডিট অফিসের একজন অফিসার ও অন্যান্যরা৷ তাছাড়া সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের পাঁচজন অফিসার আত্মগোপন করে ছিলেন৷ ২০২৪ সালের ১১ এপ্রিল ব্যাঙ্কের অর্থ তছরূপ করা ও অন্যান্য অভিযোগে ট্রুং মাই ল্যানকে মৃতু্যদন্ডে দন্ডিত করা হয়৷ অন্যান্য অভিযুক্তদের তিনবছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা প্রদান করা হয়৷ ট্রুং মাই ল্যান-এর স্বামী ও ভাইজিকে যথাক্রমে নয় এবং সতেরো বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়৷ মামলা চলাকালীন এই দুর্নীতি প্রসঙ্গে জুরি বলেন, “ল্যানের কাজকর্ম পার্টি ও রাষ্ট্রের নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করেছে৷” ল্যানের বিরুদ্ধে ১২.৫ বিলিয়ন ডলার আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছিল কিন্ত্ত সেদিন প্রসিকিউটররা বলেন, দুর্নীতির ফলে সৃষ্ট মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এসে দাঁডি়য়েছে মোট ২৭ বিলিয়ন ডলারে যা কিনা গোটা দেশের ২০২৩ সালের জিডিপি’র ছয় শতাংশ৷ এই ঘটনার ফলে ভিয়েতনামের রিয়েল এস্টেট সেক্টর যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিম্নগামী হয়েছে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বিগ্নতার সঞ্চার হয়েছে৷
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের অক্টোবরে দুর্নীতির দায়ে ট্রুং মাই ল্যানের গ্রেপ্তারের পর যখন সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক পতনের মুখে পডে়, তখন থেকেই ভিয়েতনামের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কে পুঁজি বা অর্থ বিনিয়োগ করে ব্যাঙ্কের আমানতকারিদের আমানত তুলে নিতে সাহায্য করছে৷ ফলস্বরূপ ব্যাঙ্কের আমানত আশি শতাংশ কমে ২০২৩-এর ডিসেম্বরে ছয় বিলিয়ন ডলারে দাঁডি়য়েছে এবং ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণ দাঁডি়য়েছে ৯৭ শতাংশ৷ সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ককে বাঁচানোর জন্য ২০২৪-এর এপ্রিল পর্যন্ত ভিয়েতনামের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ককে ২৪ বিলিয়ন ডলার স্পেশিয়াল লোন দিয়েছে৷ এইভাবে কোনো দেশে ব্যাঙ্কের পতন ঘটলে জনগণের করের অর্থ দিয়ে সরকার ব্যাঙ্ককে বাঁচায় কারণ ব্যাঙ্কের পতন হলেও ব্যাঙ্ককে আমানতকারীদের আমানত ফেরত দিতে হয়৷ তাই ব্যাঙ্ক দেশের অর্থনীতিতে যেমন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থা তেমনি ব্যাঙ্ক একটি ঝুঁকিপূর্ণ সংস্থাও বটে৷ সেজন্য ব্যাঙ্কে পর্যাপ্ত ক্যাপিটাল ও ক্যাশ ও সিকিউরিটি রিজার্ভ যেমন রাখতে হয়, তেমনি ব্যাঙ্ককে খুব দক্ষতার সাথে ক্রেডিট, মার্কেট, অপারেশনেল ও অন্যান্য রিস্ক ম্যানেজ করতে হয়৷ সর্বোপরি কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ককে দেশের সমস্ত ব্যাঙ্কগুলির উপর নিয়মিতভাবে কঠোর অফসাইট ও অনসাইট নজরদারি চালিয়ে যেতে হয়৷
ভিয়েতনামে সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের জালিয়াতির জন্য এই যে প্রতারণার দায়ে ট্রুং মাই ল্যানকে মৃতু্যদণ্ড দেওয়া হল, তা নাকি ভিয়েতনামে চলা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানের একটি অঙ্গ৷

ভিয়েতনামে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি নগুয়েন ফু ট্রংয়ের নেতৃত্বে দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ব্লেজিং ফার্নেস’৷ দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের নাম ‘ব্লেজিং ফার্নেস’ থেকে ভিয়েতনামে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা যেমন একদিকে আন্দাজ করা যায়, অন্যদিকে তেমনি ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির যেনতেন প্রকারে দুর্নীতি দমনের বেপরোয়া ভাবটিও প্রকাশ পায়৷ আসলে ১৯৮৬ সাল থেকে ভিয়েতনামের বদ্ধ অর্থনীতির দরজা ধীরে ধীরে খোলে দেওয়ার ফলে প্রাইভেট ক্যাপিটেলের জন্ম ও বাড় বাড়ন্ত শুরু হয়৷ ফলে সবদিকে একটা চকচকে ঝকঝকে ভাব আসে, কাজের গতি ত্বরান্বিত হয়৷ একটি মেশিনকে মসৃণভাবে ও দ্রুত কাজ করাতে গেলে যেমন মেশিনে সময় সময় ঘন তেল বা গ্রীজ দিতে হয়, তেমনি সরকারি মেশিনারি দিয়ে দ্রুত ও মসৃণভাবে কাজ করাতে তেমনি প্রণোদনা মূল্য দিতে হয়৷ অন্যান্য দেশের মতো ভিয়েতনামেও এইভাবে দুর্নীতির পথচলা শুরু হয় এবং দুর্নীতি উঁচুতলায় পৌঁছে গিয়ে বিশাল আকার ধারণ করে যার একটা জলজ্যান্ত উদাহরণ হল সাইগন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের কেলেঙ্কারি৷ তারপর ভিয়েতনাম ২০০৭ সালে ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন’ বা ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা’র সদস্য’ হয়৷ তারপর থেকে বিভিন্ন দেশের ‘মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি’ ভিয়েতনামের অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করা শুরু করে৷

ফলে দেশের ‘জিডিপি’ বা অর্থনীতির বৃদ্ধি আরো ত্বরান্বিত হতে থাকে৷ তবে সাথে সাথে স্বাভাবিক ভাবেই দুর্নীতির মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে৷ ২০১৬ সালে ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির ১২তম কংগ্রেসে যখন দলের রক্ষণশীল অংশের সহায়তায় নগুয়েন ফু ট্রং পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন, তখন থেকেই ‘ব্লেজিং ফার্নেস’ নাম দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্র্যাকডাউন বা কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়৷ একজন কট্টর কমিউনিস্ট এবং দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নগুয়েন ফু ট্রং দল ও সমাজের মধ্যে কিছু সংখ্যক ব্যক্তির আদর্শগত ও নৈতিক মূল্যবোধের পতন যেমন দুর্নীতি ও অন্যান্য সামাজিক অসুখ দূর করার চেষ্টায় ব্রতী হন৷ ২০১৬ থেকে ভিয়েতনামী সরকার ট্রাডিশনাল ও অনলাইন মিডিয়া এবং সিভিল সোসাইটির উপরও তাদের নিয়ন্ত্রণ আঁটসাঁট করে৷ ফলে প্রশাসন, ব্যবসা, কর্মক্ষেত্র, মিডিয়া সবক্ষেত্রে শ্লথগতি ও একধরণের ভয়ের পরিবেশ বিরাজ করা শুরু হয়৷ এদিকে ভিয়েতনামের সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টি ভিয়েতনামকে ২০৪৫ সালের মধ্যে প্রযুক্তি ও জ্ঞান ভিত্তিক অর্থনীতি সহ একটি ধনী দেশে পরিণত করার লক্ষ্য স্থির করে৷ তবে অভিজ্ঞতা বলে যত দ্রুত অর্থনীতির বৃদ্ধি হবে, তত দুর্নীতি বাড়বে৷ আবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে খুব কড়া ব্যবস্থা নিতে গেলে, অর্থনৈতিক কাজকর্ম গতি হারাবে৷ এই পরিস্থিতিকে ভিয়েতনাম অর্থনীতির প্যারাডক্স বা সমস্যা বলছেন অনেকেই৷ কিভাবে দুর্নীতিকে শূন্যতে রেখে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি একশোতে পৌঁছানো যায়, সেটাই আজকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ভিয়েতনামের সরকার ও ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টির কাছে৷ এই মুহূর্তে আমার কেন জানি শুধু রবীন্দ্রনাথ নাথের এই গানটি মনে পড়ছে” তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি/ আমি ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে রাজি আছি৷ ” যদিও রবীন্দ্রনাথ এই কথাগুলো অন্য প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তবে এখানে অর্থনীতিতে খোলা হাওয়া লাগলে দুর্নীতির সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে বলেই ভাবনা৷ সেটা থেকে পরিত্রাণের কি উপায়? অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞজনেরা কি সেই পথের সন্ধান করছেন? মনে জাগিছে সেই প্রশ্ন বারবার৷ ­