• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

ডানে ঝুঁকে থাকা স্টারমার এবং লেবারের বামেরা

প্রবীর মজুমদার ব্রিটেনে এমন একটি নতুন লেবার সরকার গঠিত হচ্ছে, যার শ্রেণিগঠন আগের সরকারগুলোর চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর পর স্যার কিয়ের স্টারমারের নেতৃত্বে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে লেবার পার্টি। ইতিমধ্যে স্টারমার তাঁর মন্ত্রীসভা গঠন করেছেন। কিয়ার স্টারমারের মন্ত্রিসভার প্রায় ৪৬ শতাংশ সদস্য ব্রিটেনের দরিদ্র অথবা মধ্যবিত্ত ‘শ্রমিক শ্রেণি’ভুক্ত মা–বাবার সংসারে

প্রবীর মজুমদার

ব্রিটেনে এমন একটি নতুন লেবার সরকার গঠিত হচ্ছে, যার
শ্রেণিগঠন আগের সরকারগুলোর চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। দীর্ঘ
চৌদ্দ বছর পর স্যার কিয়ের স্টারমারের নেতৃত্বে নির্বাচনে
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে এসেছে লেবার
পার্টি। ইতিমধ্যে স্টারমার তাঁর মন্ত্রীসভা গঠন করেছেন।
কিয়ার স্টারমারের মন্ত্রিসভার প্রায় ৪৬ শতাংশ সদস্য
ব্রিটেনের দরিদ্র অথবা মধ্যবিত্ত ‘শ্রমিক শ্রেণি’ভুক্ত
মা–বাবার সংসারে বেড়ে উঠেছেন। বৃহত্তর শ্রমিক শ্রেণিভুক্ত
জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতকে বিবেচনায় নিয়ে হিসাব করলে দেখা
যাবে, গড় হিসেবে শ্রমিক শ্রেণির যে পরিমাণ প্রতিনিধির
মন্ত্রীসভায় থাকার কথা, নতুন মন্ত্রিসভায় তার চেয়ে অনেক
বেশি থাকছে। অথচ বিদায়ী কনজারভেটিভ সরকারের মন্ত্রীসভায়
শ্রমিক শ্রেণি থেকে উঠে আসা সদস্য ছিল মাত্র ৭
শতাংশ।বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের কনজারভেটিভ
সরকারে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের ৬৯ শতাংশই কোনও না কোনও স্তরে
অভিজাত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন। আর
স্টারমারের মন্ত্রীসভায় যাঁরা থাকছেন, তাঁদের মাত্র ১৭ শতাংশ
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করেছেন। এটি আগেকার লেবার
মন্ত্রীসভার তুলনায়ও উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
নতুন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার সব সময় তাঁর দলকে
‘পরিবর্তিত লেবার পার্টি’ হিসেবে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করে
আসছেন। স্টারমার লেবার পার্টির দীর্ঘদিনের নীতিতে পরিবর্তন
এনে দলকে মধ্যপন্থী ধারায় নিয়েছেন। ফলে তাঁর পররাষ্ট্র ও
অভিবাসন নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা
ক্ষীণ। অন্য অনেকে এটিকে ‘শুদ্ধ লেবার পার্টি’ বলে থাকেন।
কারণ, দলটি তার বেশির ভাগ বাম ঘরানার নীতি বাদ দেওয়ার পর
সরকারি ব্যয় সীমিত করা ও ঐতিহ্যগত দেশপ্রেমকে থিম হিসেবে
নিয়ে প্রচারণা চালিয়ে পার্লামেন্টে আসনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ

করেছে। নতুন পার্লামেন্টে বিপুল সংখ্যক এমপি সজ্জিত লেবার
পার্টিতে কয়েক ডজন এমপি-কে বামপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা
হয়। অবশ্য বামপন্থী তকমাটি যথাযথভাবে প্রয়োগ করা এখন
একটু কঠিন হতে পারে। কারণ, আগে যে সংখ্যক নেতাকে
বামপন্থী বলে ধরে নেওয়া যেত, এখন হয়তো সংখ্যাটা সে
জায়গায় নাও থাকতে পারে।

ব্রিটিশ রাজনীতির অদ্ভূত নতুন পরিসরে স্টারমার যে কঠোর
বাস্তববাদকে গ্রহণ করেছেন এবং সংস্কারের মাধ্যমে যে
ডানপন্থী ফ্যান্টাসির দিকে তিনি ঝুঁকেছেন, তাতে প্রশ্ন উঠছে,
লেবার দলের বাম এবং সাধারণভাবে বামদের কি এখন কোনও
ভবিষ্যৎ আছে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সবচেয়ে ভালো
উপায় হল নির্বাচনের ফলের দিকে নজর দেওয়া। নির্বাচনের
ফলাফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে
লেবার পার্টির সমর্থনে সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটে গেছে।

স্টারমারের নেতৃত্বে দলটি ডানে ঝুঁকে বিপুল জয় পেলেও
বামপন্থীদের প্রতি ভোটারদের আস্থা এখনও আশাবহ পর্যায়ে
আছে। লক্ষণীয়ভাবে লেবার এমপি-দের মধ্যে বেশ কয়েকজন
বামপন্থী আছেন। তাঁদের মধ্যে জন ম্যাকডোনেলের মতো প্রবীণ
রাজনীতিক থেকে শুরু করে অলিভিয়া ব্লেক, রিচার্ড বার্গন ও
জারাহ সুলতানার মতো তরুণ রাজনীতিক আছেন। তাঁদের মধ্যে
জারাহ সুলতানাকে লেবার পার্টির নেতৃত্বের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ
প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মনে করা হচ্ছে।

এই নির্বাচনে যেখানে লেবার সমর্থকদের মধ্যে
কনজারভেটিভদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ বাইরে অন্য কিছুতে
দেখা যাচ্ছিল না, সেখানে কিছু জায়গায় বামেরা ভোটারদের সঙ্গে
জোরালোভাবে সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলেন। লেবার পার্টি
থেকে সরে এসে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ইজলিংটন নর্থে
প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে বড় ব্যবধান নিয়ে জিতেছেন ভূতপূর্ব নেতা
জেরেমি করবিন। তিনি বেশির ভাগ সমীক্ষাকে, এমনকি নিজের
প্রচারকর্মীদের অবাক করে দিয়ে সেখানে সাত হাজারের বেশি
ভোটে জিতে এসেছেন। ইজলিংটন নর্থের মতো ব্রিটেনের অন্য
শহরকেন্দ্রিক এলাকাগুলোতে গাজা পরিস্থিতি, জলবায়ু সংকট,
আবাসনসংকট এবং আর্থিক সুবিধা ব্যবস্থার
নিষ্ঠুরতা—ইত্যাদি ইস্যুতে স্টারমার কম নজর দিয়েছিলেন এবং
সে কারণে লেবার পার্টির সমর্থন কমেছে।
লেবার পার্টি যখন মধ্যপন্থা অনুসরণ করে কোনও সাধারণ
নির্বাচনে জয়লাভ করে, তখন দলের মধ্যে থাকা বাম ঘরানার
কিছু লোকের মধ্যে সব সময় একধরনের মিশ্র অনুভূতি কাজ
করে। তাঁরা রক্ষণশীলদের নিষ্পেষিত হওয়াকে স্বাগত জানাতে
থাকেন। মধ্যপন্থীরা মাঝেমধ্যে ভুলে যান, লেবার দলের বামরা
একটি নির্দিষ্ট তীব্রতায় টোরিদের ঘৃণা করে। লেবার পার্টির
ভেতরকার বামপন্থী আশাবাদীরা প্রায়ই আশা করেন, লেবারদের
বিজয় নতুন সমাজতান্ত্রিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে;
অন্তত তাঁদের কিছুটা হলেও মানসিক স্বস্তি দেবে।

তবে
বামপন্থীদের একটি অংশের এই ধরনের উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি
আরেকটি অংশের নেতিবাচক অনুভূতি প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে।
লেবার পার্টি অনেক বেশি সংখ্যক আসন পেলেও
আশ্চর্যজনকভাবে জাতীয় পর্যায়ে তাঁদের ভোটপ্রাপ্তি
তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এবারের ভোটে তাঁরা পেয়েছেন এক-
তৃতীয়াংশের কিছু বেশি (৩৪ শতাংশ), যা ২০১৭ সালে করবিনের
নেতৃত্বে দলটির পাওয়া ভোটের চেয়ে অনেক কম এবং ২০১৯ সালে
পরাজিত হওয়ার বছরে পাওয়া ভোটের চেয়ে খুব একটা বেশি নয়। এ
অবস্থায় বাম দিকে ঝোঁক থাকা নেতাদের লেবার নেতৃত্বকে
বোঝাতে হবে, বাম ঘরানার নীতিকে দল থেকে বিদায় করা হলে তা
দলের জন্য ভালো হবে না। লেবার নেতৃত্ব কৌশলগত কারণে বাম
নীতিগুলো সরিয়ে ডানপন্থার দিকে ঝুঁকলে তা দীর্ঘ মেয়াদে লেবার
দলের একনিষ্ঠ সমর্থকদের মধ্যেও বিরক্তি সৃষ্টি করতে পারে।
সেটি বামঘেঁষা উদারপন্থীদের পাশাপাশি মধ্যপন্থীদেরও বড়
ক্ষতির কারণ হতে পারে।

লেবার সরকারের মন্ত্রী সভার এই বৃহৎ পরিবর্তনকে মূর্ত
করেছেন স্বয়ং স্টারমার। শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে তাঁর নাড়ির
সম্পর্ক, এমনটা বোঝাতে তিনি নির্বাচনী প্রচারণার সময়
বার বার বলেছেন, তিনি একজন ‘টুল মেকার’-এর ছেলে। ঋষি
সুনাকের বিরুদ্ধে প্রথম বিতর্কে স্টারমার বলেছিলেন, ‘আমরা
এমন অবস্থায় ছিলাম যে, আমরা ঠিকমতো আমাদের পরিষেবা বিল
মেটাতে পারতাম না। এ কারণে আমি সে ধরনের অবস্থায় পড়া
মানুষের মনের অবস্থা বুঝতে পারি।’

এটি ঠিক যে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠে পরে
অভিজাত পরিমণ্ডলে পা রাখা বা নেতৃত্বের আসনে বসা
ব্যক্তিদের পরিবর্তিত জীবন রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব
ফেলতে পারে। এক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছিল, শুধু শ্রমিক শ্রেণি
নয়, ব্রিটিশ অভিজাত পরিবার থেকে উঠে আসা নেতাদের মধ্যেও
রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বামপন্থার দিকে একধরনের ঝোঁক
থাকে। তাঁরা সাধারণত ধনীদের ওপর কর বাড়ানোর পক্ষে থাকেন।
দারিদ্র্য হ্রাসের ওপর জোর দেন এবং তাঁদের মধ্যে ব্রিটেনকে
একটি বর্ণবাদী দেশ মনে করার প্রবণতা বেশি থাকে।

পারিবারিক উৎসের এই প্রভাব রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে
অধিকতর তীব্র হতে পারে। শ্রমিক শ্রেণির পরিবার থেকে উঠে
আসা লেবার এমপি-দের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎকারগুলো স্পষ্ট
করেছে যে, তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়ের শেকড় তাঁদের প্রথম
দিককার জীবনের অভিজ্ঞতা এবং তাঁদের বামের দিকে ঝুঁকে থাকা
মা–বাবার প্রভাবের সঙ্গে জোরালোভাবে প্রোথিত।
স্টারমার সরকারের শ্রেণিগঠন যে তাঁর নীতিনির্ধারণকে
প্রভাবিত করবে। ইতিমধ্যেই তার কিছু নিদর্শন দেখা গিয়েছে।
যেমন ভাবি এই প্রধানমন্ত্রী প্রাইভেট স্কুলগুলোয় কর বাড়ানো
এবং ‘নন-ডোম’ ট্যাক্স অব্যাহতি (নন-ডমেস্টিক, অর্থাৎ যাঁরা
ব্রিটেনে থাকেন, কিন্তু অন্য দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের
আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন) বাতিল করার বিষয়ে দেওয়া
প্রতিশ্রুতিতে অটল রয়েছেন। এই দুটো এমনই সমস্যা যা অতীতে

লেবার সরকারগুলোর আমলে নিতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু এর মানে
এই নয় যে, নতুন সরকার একটা শ্রেণিযুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছে।
রাজনীতিবিদরা ঘন ঘন অবস্থান পাল্টালেও বেশির ভাগ অভিজাত
ব্যক্তি তুলনামূলকভাবে বেশি সময় নিজেদের নীতিগত অবস্থান ধরে
থাকেন। ফলে স্টারমার, দলের দ্বিতীয় প্রধান নেতা অ্যাঞ্জেলা
রেনার ও ছায়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওয়েস স্ট্রিটিংয়ের মতো লেবার
নেতাদের অভিজাত আমলা ও ব্যবসায়িক জগতের লোকদের সঙ্গে
আপন হয়ে কাজ করতে হবে। নতুন প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই এ
সত্য বুঝবেন এবং অভিজাত শ্রেণি ও শ্রমিক শ্রেণিকে মুখোমুখি
করা থেকে বিরত থাকবেন।